“শূন্য থেকে অজানা দিগন্তে”
(নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্প)
নবু
গুরুজি একদিন ডেকে বললেন, “দেখো, অন্যকে নকল করে, কিংবা অন্ধভাবে অনুসরণ করে কখনও নিজের পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজের ভেতরে ডুব দিতে হবে। জানতে হবে, তুমি আসলে কে, আর কোথায় যেতে চাও। আর সেই পথটা তোমাকেই বানাতে হবে নিজের হাতে।”
তার কথা শুনে মনে হলো, এটা তো আসলেই সত্যি। আমরা অনেক সময় এমন একটা মুখোশ পরে থাকি, যেটা আসলে আমাদের নয়। অন্য কারও জীবনের গল্প নকল করতে গিয়ে, নিজের গল্পটাই হারিয়ে ফেলি। কিন্তু, নিজের পথে চলতে গেলে সাহস লাগে। কারণ, সেই পথে কোনো মানচিত্র থাকে না। থাকে না কোনও পথ্প্রদর্শক।
তাই ভাবলাম, আর নয়। ছোট ছোট পদক্ষেপেই হোক, নিজের জন্য একটা নতুন পথ তৈরি করব। ভুল হবেই, তবুও সেটা আমার নিজের ভুল হবে। কাউকে দোষ দেবার নেই। আনন্দ বা দুঃখ যাই আসুক, সেটা আমার নিজের পথের গল্প হবে। আর এই গল্পে কোনো জটিল কথা নয়, শুধু মন থেকে বলা সহজ সত্যি কথা থাকবে। থাকবে নিজের ভাবনার কথা, নিজের বিশ্বাস, নিজের মনন সাগরের থেকে তুলে আনা অনুভুতি।
একটা সময় বুঝলাম, নিজের পথে চলতে গেলে মাথার ভেতর হাজারটা প্রশ্নের ঝড় উঠবেই। “আমি পারব তো?” “এই রাস্তা ঠিক তো?” এসব প্রশ্ন আসবেই। কিন্তু, মনে জোর রেখে এগিয়ে গেলে, প্রতিটা বাঁকেই দেখা মিলবে নতুন আলো। প্রতিটা রাত পেরোলেই আসে আবার একটা নতুন সকাল।
তোমাদের বলি, নিজের ভেতরের শক্তিকে চিনে নাও। নিজের পথে হাঁটতে ভয় পেয়ো না। অন্যের মতো হওয়ার চেষ্টায় নিজেকে হারিয়ে ফেলো না। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মজা তখনই বোঝা যায়, যখন নিজের তৈরি পথেই নিজের গল্পটা নিজের হাতে লেখা হয়।
নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্প – অধ্যায় ২: প্রথম পদক্ষেপ-
গুরুজির কথায় পরে যেন মনে একটা আলো জ্বলল। কিন্তু নিজের পথ তৈরি করা কি এত সহজ? এক সকালে উঠে ঠিক করলাম, যা যা করিনি জীবনে, তা-ই করতে হবে। নিজেকে চিনতে গেলে অচেনা পথে পা বাড়াতেই হবে।
আজই ঠিক করলাম, আজ বছর শেষ, ছোট্ট একটা কাজ দিয়ে শুরু করি। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম ছবি আঁকব। কিন্তু মনে হতো, আমি কি পারব? আঁকার সরঞ্জাম পারে আণব, আগে যা আছে তাই দিয়ে শুরু করি। প্রথম দিন তুলি ধরতেই যেন মনে হলো, নিজের মনে কত কথা জমে ছিল, যা ক্যানভাসে ফুটে একটু একটু করে উঠতে চাইছে।
প্রথম কয়েকটা আঁকা হয়তো মানমত হয়নি, কিন্তু প্রতিটা স্ট্রোকে নিজের ভেতরে একটা মুক্তির অনুভূতি পেলাম। মনে হলো, এই ছোট্ট পদক্ষেপেই আমি নিজের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে শুরু করেছি। আমি আজ থেকে নিজেই নিজের বন্ধু।
অধ্যায় ৩: নিজের ভয়কে জয় করা-
নিজেকে খোঁজার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ভয়। ভয় কি বলবে মানুষ? ভয় যদি ব্যর্থ হই? এটাই বুঝলাম, এই ভয়গুলোকে অগ্রাহ্য না করলে পথ চলাই সম্ভব নয়।
একদিন সাহস করে একটা বন্ধুকে নিজের আঁকা ছবি দেখালাম। ভাবছিলাম, সে হয়তো হাসবে। কিন্তু সে বলল, “তুই তো দারুণ করেছিস! আরও চেষ্টা কর।” শুনে মনে হলো, ভয়টা আমার নিজের বানানো। অন্য কেউ তো সেটা দেখেই না।
এরপর ধীরে ধীরে আরও অনেক কিছুতে হাত দিতে শুরু করলাম। গান শিখলাম, গল্প লিখতে বসলাম। একসময় বুঝলাম, এই চেষ্টাগুলোর মাঝেই আমি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি। আর নিজেকে হারানোর ভয় নেই। নিজেকে নিজেই বাহবা দিতে শিখলাম। শিখলাম নিজের চোখ দিয়ে সবকিছু দেখার, অন্যের চোখে নয়।
অধ্যায় ৪: নিজের গল্প লেখা-
নিজের পথ চলার মধ্যে একটা মজার বিষয় আছে। এখানে কেউ তোমায় বলবে না, এটা কর বা ওটা কর। নিজেই নিজের জন্য প্রতিটা অধ্যায় তৈরি করতে হয়। ভুল মনে হলে, নিজেকে সেই ভুল মুছতে হয়।
আমার পথের গল্পটা তখনই শুরু হলো, যখন বুঝলাম নিজের পছন্দের জন্য কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না। ছবি আঁকা, গান শেখা, কৃষি কাজ শেখা, গল্প লেখা—সবই যেন নিজের ভেতরের একটা নতুন দরজা খুলে দিচ্ছিল। আর প্রতিটা দরজার পেছনে একটা নতুন আমি ছিল। সে বলল কথা বলার সুর থেকে মানে খুঁজে নিতে শিখে নাও।
তোমাদেরও বলি, প্রথম পদক্ষেপ নিতে ভয় পেও না। ছোট ছোট পদক্ষেপ থেকেই বড় গল্প তৈরি হয়। নিজের ভয় কাটিয়ে যখন নিজের গল্পটা লেখা শুরু করবে, তখনই বুঝবে, জীবনের আসল মানে কোথায়। ঘাপটি মেরে বসে আছে, শুধু ব্যাবহারের অপেক্ষায়। তাকে ফেলে রাখা মানে নিজের চরম ক্ষতি।
সংশয়ের মত শত্রু আমাদের আর কেউ নেই। যখনই এগিয়ে যেতে চাই, সংশয় পেছন থেকে টেনে ধরে বলে লোকে কি বলবে? মুখ দেখানো যাবে না সমাজে। সমাজ! সমাজ আমাদের নিয়ে । আমি তার ব্যাতিক্রম নই।
সংশয়: আমাদের পথের বাঁধা-
সংশয় যেন একটা অদৃশ্য দানব, যা মনে সবসময় ছায়ার মতো ঘিরে থাকে। যখনই কিছু নতুন শুরু করতে চাই, সংশয় চুপিচুপি এসে কানে কানে বলে ওঠে, “লোকে কি বলবে?” এই একটা প্রশ্ন যেন আমাদের কল্পনার ডানাগুলো কেটে ফেলে। মনে হয়, যদি ব্যর্থ হই, যদি মানুষ হাসে, যদি সমাজে মুখ দেখানো না যায়?
তখন ভাবি এত শিল্পী, এত লোকের মাঝে তাদের শিল্প নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছে.। তারা কেউ লোকের কথার ধার ধারে না। ধারলে তাদের শিল্প প্রকাশ পেত না। সংশয়, সঙ্কোচ কে তারা কেউ তাদের প্রতিবেশী করেনি।
কিন্তু সত্যি বলতে, এই সংশয়ের শিকলটাই আমাদের পায়ে বাঁধা সবচেয়ে বড় শত্রু। যে কাজটা আমরা করতে চাই, যে স্বপ্নটা দেখতে চাই, তা করার পথে প্রথম বাধা এই সংশয়। এবং এর শক্তি কেবল তখনই টিকে থাকে, যদি আমরা সেটাকে গুরুত্ব দিই। লোকে কি বলবে?
এই কথাটা আসলে কোথা থেকে আসে? আমরা তো জানি না, মানুষ আমাদের কাজ নিয়ে কতক্ষণ ভাবে। হয়তো কেউ আমাদের দিকে একবার তাকায়, হয়তো দু-চারটে কথা বলে। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। মানুষ তার নিজের কাজেই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। তাহলে এই সংশয় কেন? এটা আমাদের নিজের ভেতরকার ভয়। আমরা নিজেই নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি না, আর সেই সুযোগেই সংশয় মাথা তোলে।
সংশয় কাটানোর উপায় জানতে হবে-
তাহলে কিভাবে কাটাব এই সংশয়ের জাল? প্রথমেই জানতে হবে, সবকিছুর একটা প্রথম দিন থাকে। যে মানুষটা বড় শিল্পী, লেখক বা সংগীতজ্ঞ, সেও প্রথম দিনে হয়তো ভুল করেছে। সংশয়ের কণ্ঠস্বরকে থামিয়ে প্রথম পদক্ষেপটা নেওয়া সবচেয়ে জরুরি।
যখনই সংশয় মনে আসবে, নিজেকে প্রশ্ন করো—আমি যা করছি, তা কি আমাকে খুশি করছে? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে বাকিদের কথা ভাবার কোনো দরকার নেই। মনে রাখো, সফলতা বা ব্যর্থতা সবই তোমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা। অন্যের মন্তব্য তা বদলাতে পারে না।
সংশয়ের শত্রু হয়ে উঠতে হবে-
সংশয়কে বন্ধু না বানিয়ে, তার শত্রু হয়ে উঠতে হবে। যখন সংশয় বলবে, “মুখ দেখানো যাবে না,” তখনই বলো, “দেখাবই। নিজের পথেই চলব।” একবার সাহস করে সংশয়কে অগ্রাহ্য করো, দেখবে, তার শক্তি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
জীবন তো একটা পরীক্ষামূলক যাত্রা। যদি সংশয়ের জালে আটকে থাকি, তাহলে নিজের গল্পটাই কখনও লেখা হবে না। তাই সংশয়কে সরিয়ে রেখে নিজের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরো। কারণ, দিন শেষে, লোকে কি বলবে সেটা নয়, তুমি নিজে নিজের সম্পর্কে কি বলছ, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তোমার জীবনে।
নতুন শুরুর গল্প-
ঠিক করেছি, নতুন বছরে একদম শূন্য থেকে শুরু করব। শূন্য মানে, কোনো বোঝা নেই, কোনো অতীতের ভার নেই। এমন একটা জীবন, যেখানে না আমি কাউকে চিনি, না কেউ আমাকে চেনে। অচেনা পৃথিবীর অচেনা কোনো কোণে, একটা নতুন সকাল হবে। সেই সকাল আমার জন্য একদম নতুন, যেমন প্রথম আলোয় পৃথিবী উন্মোচিত হয়।
অচেনা এই জীবনে থাকবে কেবল নিজেকে নতুন করে চেনার চেষ্টা। প্রতিটা দিন হবে একটা নতুন অধ্যায়। কোনো পুরনো দুঃখ, না বলা কথার ভার, কিংবা ভাঙা স্বপ্নের ছায়া থাকবে না। থাকবে কেবল এক অদ্ভুত মুক্তি—নিজেকে গড়ার, নিজের স্বপ্নকে নতুন করে বুননের।
অচেনা জীবনের অন্তিম স্বপ্ন-
এই নতুন যাত্রায় শেষ স্বপ্নটা কি? সেটা কোনো বড় কিছু নয়। জীবনের সেই সহজ, শান্তিময় মুহূর্ত খুঁজে পাওয়া, যেটা আমার জন্য একেবারে নিজের। যেখানে আমি কাউকে প্রমাণ করতে যাব না যে আমি কে। বরং নিজেকে অনুভব করি, প্রতিটা শ্বাসের আনন্দে। ভুলে যেতে হবে তাদের, যারা ফেলে চলে গেছে আমাকে।
অচেনা এই পথটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, সবকিছু ফেলে নতুন করে শুরু করা সহজ নয়। কিন্তু সেই শূন্য থেকেই জীবনের আসল মানে খুঁজে পাওয়া যায়।
তোমাদেরও বলি, একবার শূন্যে ফিরে তাকাও। যা যা তোমায় আটকে রেখেছিল, যা যা তোমার পথ রোধ করেছিল, তা সব ঝেড়ে ফেলো। নতুন করে দেখো, নতুন করে শুরু করো।