চ্যাংরাবান্ধা গ্রামের ভূত
বাসুদেব দাশ
হাদুরাম কারখানায় চুরির দায়ে শাস্তি পেয়ে বদলি হয়ে আসে উধমপুর গ্রামে l চাকরি যাবার উপক্রম হয়ে পিড়েছিল কিন্তু অন্য সব শ্রমিকদের অনুরোধে ওর চাকরিটা বাঁচে যায় l ওর বৌ বাচ্চার কথা চিন্তা করে মালিক শেষ পর্যন্ত ওকে চাকরিতে রেখে দেয় l কিন্তু এই কারখানায় ওকে মালিক রাখতে চায় না l সবাই মিলে মালিককে পরামর্শ দেয় উধমপুরের কারখানায় বদলি করে দিতে l উধমপুর এসে কিছু দিন কাজ করার পর ও এক শ্রমিক বন্ধুর পরামর্শে এই কারখানার কাজ ছেড়ে দিয়ে পাশের চ্যাংরাবান্ধা গ্রামের অন্য একটা কারখানায় একটু বেশি মজুড়িতে কাজে যোগ দেয় l চ্যাংরাবান্ধা গ্রামের কারখানায় ওর থাকার একটা সমস্যা হয় l কারখানার পাশে একটা ঘর বহু দিন ধরে বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে l হাদু চাইছে ঐ ঘরটা খুলে পরিষ্কার করে তাতে থাকতে l কিন্তু অন্য সবাই ঐ ঘরে ওকে থাকতে বারুন করে l তবুও হাদু ঐ ঘরেই থাকার জন্য পিরাপীড়ি করে l শেষ পর্যন্ত মালিক ঐ ঘরটা হাদুরামের জন্য খুলে দেয় l ঘয়টা খোলার পর দেখা যায় প্রায় এক ইঞ্চি মোটা হয়ে ধুলো জমে আছে l হাদু ঝাঁটা দিয়ে জল দিয়ে ভাল করে পরিষ্কার করে নেয় l দেওয়ালের ঝুল কালি সব পরিষ্কার করে l একটা জানলা ছিল সেটা খুলে দেয় l ঘরে একটা তক্তপোষ ছিল সেটায় দুটো একটা পেরেক মেরে ঠিকঠাক করে নিয়ে তার মাল পত্র ঢুকিয়ে দেয় l রান্নার ব্যবস্থা হিসাবে একটা স্টোব কিনে আনে l প্রথম দিন কাজ করতে গিয়ে একটু অসুবিধা হয় l পাশের এক জন ওকে দেখিয়ে দেয় l একবার দুবার দেখাবার পর আস্তে আস্তে হাদু কাজটা ধরে নেয় l সন্ধ্যাবেলা কাজ শেষ হয়ে গেলে সবাই যে যার ঘরে ফিরে যায় l হাদু এই নতুন ঘরে একা একা থাকতে একটু শঙ্কা বোধ করে l চাল ডাল আলু পিয়াজ কাঁচা লংকা আনা ছিল l হাদু ঘরে ঢুকে হাত পা ধুয়ে একটা হাড়িতে করে চাল বসিয়ে দেয় স্টোবে l আলুর চোখলা ছাড়িয়ে চার ভাগ করে কেটে হারির মধ্যে দিয়ে দেয় l ভাত হয়ে গেলে একটা বাটিতে ডাল ফুটিয়ে নেয় l রাত আট টার সময় খাবারটা খেয়ে নেয় হাদু l গ্রামের বাড়ীতে আটটাতেই অনেক রাত l চারি দিকটা নিঝুম হয়ে আছে l মাঝে মাঝে ঝোপ ঝাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পাওয়া যায় l কারখানার পিছনে একটা জঙ্গল আছে l হাদু শুনেছে যে ঐ জঙ্গলে সাপ আছে আর রাতে শিয়াল ডাকে l তাই একা একা একটা অচেনা জায়গায় থাকতে একটু কেমন কেমন লাগছে l শরীরের মধ্যে একটু শির-শিরে ভাব l শিয়ালের ডাক শুনে থেকে হাত-পা আরস্ট হয়ে আসে l হেদু মনে মনে ভেবে নিল থাকতে থাকতে ঠিক হয়ে যাবে l এখানে যারা আছে তারা তো আছে l তবে সে কেন পারবে না l ঠিকই পারবে l
হাদু রাতের খাবার খেয়ে হাত মুখ ধুঁয়ে তক্তপোষে হেলান দিয়ে আদ শোয়া হয়ে পড়ে থাকলো কিছুক্ষণ l একটু ঝিমুনি আসতেই শুনতে পেল জানলায় কে যেন ঠক ঠক শব্দ করছে l হঠাৎ আওয়াজ শুনে বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে l উঠে বসে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে l আদ ঘন্টা হয়ে যায় তবু কিছু শুনতে পায় না l ভাবলো আমার কোথাও ভুল হচ্ছে তাই আবার শুয়ে পরে l সাড়া রাতে আর কোন শব্দ শুনতে পায় নি l তবে রাত ভর শিয়ালের ডাক কানে এসেছে বহু বার l তার যেহেতু হাঁস মুরগি কিছু নেই তাই তার চিন্তার কারণ নেই l সে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ে l পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে রান্না করতে বসে যায় l রান্না হয়ে গেলে স্নান করে খেয়ে কারখানায় চলে যায় l কাল রাতের ঘটনা শুনলে বন্ধুরা প্যাক দেবে সেই লজ্জায় বন্ধুদের কাছে বলতে পারেনি হাদু l সাড়া দিন কাজের পর সন্ধ্যা হলেই হাদুর মন খারাপ হয়ে যায় l বাসায় গেলে আবার কি হবে সেই চিন্তায় তার শরীরটা ঝিমিয়ে যায় l যাই হোক বাসায় তো যেতেই হবে l আজ আর রান্না করবে না হাদু l ফেরার পথে রুটি আর ডিমের ঝোল কিনে নিয়ে এসেছে l রাতের খাবার খেয়ে তক্তপোষের উপর বসে থাকে হাদু l আজ আবার শিয়ালের ডাক শুরু হয়ে গেছে l বুকের ভিতরটা দুরু দুরু করে l অনেক্ষন বসে থাকার পর সারা দিনের ধকলে ঘুম এসে যায় l রাত একটু বাড়তেই শিয়ালের চিৎকার বাড়তে থাকে l গভীর রাতে আবার জানালায় ঠক ঠক আওয়াজ l হাদু কে কে বলে চিৎকার করে ওঠে কিন্তু কেউ কোন সাড়া দেয় না l হাদু আবার শুয়ে পরে l আবার জানালায় ধাক্কা l এবার বেশ জোরে জোরে l জানলাটা সামান্য একটু ফাঁক করে হাদু দেখার চেষ্টা করে বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কিনা l না কারোকে দেখা যাচ্ছে না l মোবাইলের টর্চ জ্বালায় তাও কিছু দেখতে পায় না l হাদুর হাড় হীম হয়ে আসে l ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকে হাদুরাম l
তবে কি ওদের কথাই ঠিক l এই ঘরে কোন অশরীরির বাস আছে l সেই এই সব কান্ড কারখানা গুলো করছে l জঙ্গলের ওপারে বাঁশ ঝড়ের পরে একটা কবরখানা আছে l অতো দূরে দৃষ্টি ভাল যায় না l আবছা আবছা দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় না l ওখান থেকে কি তেঁনারা উঠে আসতে পারেন ? না কি এই ঘরে কারো অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল ? শুনেছি অপঘাতে মৃত্যু হলে সেই অশরীরি আত্মা সেই জায়গার আসেপাশে ঘুরে বেড়ায় আর সুযোগ পেলেই মানুষের ঘাড় মটকে দেয় l এই সব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে হাদুরামের হাটু কাঁপতে থাকে l কারখানায় গিয়ে হাদু সবাইকে এক এক করে জিজ্ঞেস করতে থাকে যে এই জায়গায় কোন ভূত-প্রেত আছে কিনা ? সবাই একটা কথা বলে যে ভূত প্রেতের কথা তারা কেউ কখনো শোনে নি l তবে এখানে মাঝে মাঝে লাশ পরে l হাদু– ” লাশ পরে মানে ? “মানে খুন করে এই জঙ্গলে লাশ ফেলে দিয়ে যায় খুনিরা l তারপর এখানকার মানুষ এই কবরস্থানে লাশটা কবর দিয়ে দেয় l ব্যস হাদুকে আর পায় কে l হাদু বুঝে নিল যে ঐ লাশ গুলোর মধ্যে থেকেই তেঁনারা বেরিয়ে আসেন l ভয়ে হাদুর আত্মারাম খাঁচা হয়ে যায় l হাদু কারখানার দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে… “আচ্ছা এই ঘরে এর আগে কেউ থাকেনি ? ” দারোয়ান….. “বহু আগে একজন থাকতো l তার অকাল মৃত্যু হবার পর আর কেউ এই ঘরে থাকেনি l” হাদু…. ” তাহলে তেঁনার আত্মাও এখানে থাকতে পারে l” পরের দিন হাদু কারখানা থেকে ঘরে ফিরে হাত পা ধুঁয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে রাতের খাবার রান্না করতে বসে l মনের মধ্যে একটু দুরু দুরু ভাব নিয়েই সে কাজ করতে থাকে l রান্না শেষ হাওয়া মাত্র দরজায় কে বা কারা জোরে জোরে ধাক্কা মারতে থাকে l মনে হচ্ছে দরজা না খুললে ভেঙে ফেলবে l হাদু ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখে কেউ কোত্থাও নেই l হাদু ভয়ে রাম নাম জব করতে থাকে l সে শুনেছে যে রাম শুনে ভূত পালিয়ে যায় l তার হাত পায়ে খিল ধরে আসে l
পরের দিন হাটবার l হাদুরাম হাটে যায় প্রয়োজনীয় জিনিস পত্তর কিনতে l সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা l এই চ্যাংরাবান্ধা গ্রামে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যাও খুব কম l হাদু হাটে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খায় l পাশে বসা লোকটার কাছে হাদু জানতে চায় যে এই গ্রামে এতো কম লোক বাস করে কেনো l লোকটা বলে… “আগে এই গ্রামে অনেক লোক বাস করতো l এই গ্রামে ভূতেশ্বরী ” নামে একটা কারখানা আছে l সেই কারখানার পিছনে যে জঙ্গলটা আছে আর সেই জঙ্গলটার পরে একটা কবরস্থান আছে সেখান থেকে অশরীরি আত্মারা বেড়িয়ে এসে গ্রামের মানুষের উপর খুব উৎপাত করে l সেই জন্য এই গ্রাম থেকে মানুষ এক এক করে ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে গেছে l হাদু…. ” আমিও তো ঐ ভূতেশ্বরী কারখানায় কাজ করি l ” লোকটা….. ” উড়ে বাপরে কি সাংঘাতিক ব্যাপার l ” এই বলে লোকটা দৌড়ে পালিয়ে যায় l হাদু কিম্বকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে যায় লোকটার কথা শুনে l
প্রতিদিন হাদু সবার আগে কারখানা থেকে বেড়িয়ে যায় l আজ হাদু ঠিক করেছে সবার সঙ্গে সে বের হবে l সেই রকম চিন্তা করে হাদু সন্ধ্যাবেলা ছুটির ঘন্টা বাজার পর বের না হয়ে সবার জন্য বসে অপেক্ষা করতে থাকে l ছুটির পর ঘন্টা খানিক সবাই মিলে এক সঙ্গে বসে আড্ডা মারে l তারপর এক এক করে কারখানা থেকে বের হতে শুরু করে l হাদু সবার পিছনে ছিল l সে দেখতে পায় সবাই কারখানা থেকে বের হয়ে এক এক করে জঙ্গলের পাশে যে কবরখানা আছে তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে l হাদু এই দৃশ্য দেখে চমকে যায় l সে আর কিছু ভাবতে পারে না l হুঁশ হারিয়ে মেঝের উপর পরে যায় l দারোয়ান ছুটে এসে হাদুর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে স্বাভাবিক করে l হাদু উঠে বসলে দারোয়ানও কবরে ঢুকে যায় l হাদু বুঝতে পারে যে সে যে কারখানায় কাজ করে সেই কারখানার সব শ্রমিকই ভূত l হাদু আর না দাঁড়িয়ে প্রাণটা হাতে নিয়ে ঐ কারখানা ছেড়ে চ্যাংরাবান্ধা গ্রাম ছেড়ে ফিরে চলে আসে তার নিজের গ্রামে l
==সমাপ্ত ==