আপন জন (পর্ব পঞ্চদশ)
কাকলী ঘোষ
তাড়াতাড়ি হাত চালাচ্ছিল শিখা। আজ অনেক গুলো পদ রাঁধতে হবে। এমনিতে এরা লোক দু জন। খুব কিছু ঝামেলা নেই। ভাত, ডাল , ভাজা আর একটা মাছের পদ । শেষের পাতে অম্বল বা চাটনি। এটা অবশ্য রোজ চাই দুজনের। বয়স হয়েছে তো। একটু শেষ পাতে চাটনি না হলে মন ভরে না। কখনও সখনও একটু তেতো বা শুক্তো ও করতে বলেন কাকিমা। কিন্তু ঝামেলা সেরকম কিছু নেই। কিন্তু লোক জন এলে মেলা ফিরিস্তি। ছেলে মেয়ে দুজনেই বাইরে থাকে। বছরে দু তিন বার আসে যায়। এছাড়াও আছে অগুনতি আত্মীয় স্বজন। বাপ রে বাপ ! যেন পিল পিল করে আসতে থাকে সব। প্রত্যেক সপ্তাহে কেউ বা কেউ লেগেই আছে। এই যেমন আজ এসে হাজির হয়েছে তিন জন। আর এলে সবাইকে এখানে খেতে বলা কাকিমার বদ স্বভাব। আর তখনই চাপ পড়ে শিখার। দু তিন রকমের মাছ, মাংস ,ভাজা ভুজি প্রথম পাতে তেতো শেষ পাতে চাটনি তো আছেই। যদিও লোক জন এলেই শিখার হাতে আলাদা টাকা গুঁজে দেন কাকিমা। প্রথম প্রথম নিতে লজ্জা করত ওর।এখন আর করে না। করবেই বা কেন? এত লোকের রান্না করার জন্য তনকে রাখেনি। ও তো দুজন দেখেই ঢুকেছিল। এখন আর বেশি লোক দেখলে বিরক্ত লাগে না। বরং মনে মনে আনন্দ হয়। এক্সট্রা কটা টাকা আসবে হাতে। একটু একটু করে এইভাবেই তো জমিয়েছে ও। খুব ইচ্ছে ঘরে একটা টিভি কিনবে। সুখেনের রোজগারেই কোনক্রমে সংসার চালিয়ে নেয় ও। নিজের টাকাগুলো জমাবার চেষ্টা করে। সবসময় হয় না।কিছু কিছু দুমদাম খরচ হয়ে যায়। তবু চেষ্টা করে। কাকিমা মানুষ ভালো। শুধু টাকাই দেন না। ভালো কিছু রান্না বান্না হলে বাটি করে দিয়ে দেন ওদের জন্যও। এইভাবেই চলে যাচ্ছে। আর সত্যি কথা বলতে কী ভালই চলছে। কিন্তু কাল এমন একটা কাণ্ড করল সুখেন ! এই সংসারে একটা বাড়তি লোক কেমন করে টানবে শিখা? এই বাজারে? একটু যদি ঘটে বুদ্ধি থাকত লোকটার! পিসি বলল তো বেড বাক্য যেন! বললেই নিয়ে আসতে হবে! তুমি ভাববে না তোমার ঘরে কোথায় শুতে বসতে দেবে? ওই তো একটু খানি ছোট্ট ঘর। নিজের দুজন গা ঘেঁষা ঘেঁষি করে হয়ে যায় কোনমতে। তার মধ্যে এত বড় একটা ধুমসো মেয়ে কেউ ঢোকায়? পিসিরও বলিহারি আক্কেল ! সমাজসেবা করার দায়িত্ব নিয়েছে যেন! যার যেমন কপাল তেমনি তো হবে! চলে এসে ওই মেয়ের কী হাত পা গজাবে? বরং ওই লোকটাকে বিয়ে করে দেশে থেকে গেলে পেটে দুটো পড়ত তো। মাথায় তেল, সিঁদুর, পরনে কাপড় জুটত তো ! তা নয় পা উঠিয়ে চলে এল। কোথায় থাকবে , কোথায় শোবে, কী খাবে কোন ব্যবস্থা নেই। এসে উঠলেই হল। যেন দান ছত্তর খুলে রেখেছে সুখেন।
খুন্তি নাড়তে নাড়তে আড় চোখে একবার তাকায় শিখা। এক মনে শাক বাছছে রিন্টি। নটে শাক ভাজতে বলেছে কাকিমা। এই শাক বাছা বড় বিরক্তিকর লাগে ওর। ভাগ্যিস সঙ্গে করে আসার সময় মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিল। অবিশ্যি কাল রাতেই মনে মনে ভেবে রেখেছিল কাজের বাড়ি যাবার সময় নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। অনেক দিন থেকেই কাকিমা বলে, “ তোর মত একটা চটপটে নেয় থাকলে বলিস তো। আমার বোনের বাড়ি কাজে দেব। খুব দরকার ওদের।”
সেই কথাটা মাথায় ছিল বলেই নিয়ে এসেছে। কাকিমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেখানে রান্না করতে যায় সেই দোলা বৌদিও বলে রেখেছে। ওর থেকেও নাকি কে কাজের মেয়ে চেয়েছে। থাকলে যেন শিখা বলে। এতদিন তো শিখা ঘাড় নেড়ে চলে এসেছে। কাল রাতে এই ঘটনা না ঘটলে আনতও না কখনও। ওসব ঝামেলায় কেউ যায় নাকি? শেষে কী করতে কী করবে — বিপদ হবে ওর। কিন্তু ঠিক ওর ঘাড়েই এসে পড়ল ঝামেলা। তাই সকাল হতেই বাধ্য হয়ে নিয়ে এসেছে মেয়েটাকে।
ও তো ভেবেছিল কাকিমাই নিয়ে নেবে মেয়েটাকে।কিন্তু সেটা হল না। কদিন আগেই নাকি কাকিমার বোন লোক পেয়ে গেছে। পাবেই তো। কে আর কার জন্য বসে থাকে? এখন দেখা যাক দোলা বৌদি কী বলে ? এখানকার রান্না সেরে ওর ওখানে যেতে হবে।
শাক বেছে ধুয়ে ওর সামনে জল ঝরতে দিল রিন্টি। দ্রুত হাতে মাছের মশলা করছিল শিখা। ফিরে তাকিয়ে বলল…