অনেকদিন পরে গুচ্ছের খানিক দাবি সামনে রেখে বিরোধীদল বাংলা বন্ধ ডেকেছে। রাজ্যের কতটা লাভ হবে জানিনা। তবে আমার একটু হলেও সুযোগ এল। কলেজের বন্ধুদের সাথে অনেকদিন দেখা সাক্ষাত হয় না। ফলে শিবু, দিলীপ,প্রবীর, জয়, নন্দদের আসতে বলেছি, সকালের দিকে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। মা বাড়িতে নেই, ব্রেকফাস্টের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। সুতরাং বেরিয়ে পড়লাম রেডিমেড ব্রেকফাস্টের সন্ধানে।
রাস্তাঘাট শুনশান, দু’একটা লোকাল বাইক, সাইকেল ছাড়া আর কিছুই চলছে না। মোড়েমোড়ে ক্যাডাররা দল বেধে ঝাণ্ডা হাতে দাঁড়িয়ে। একমাত্র ভজার চায়ের দোকান খোলা। নিজেদের স্বার্থে ঝান্ডাধারীরা ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য করেনি। সুবিধা হল ভজার কাছে চা ছাড়াও ঘুগনি, আলুরদম, পাউরুটি ইত্যাদি পাওয়া যায়।
তিন মাথার কাছে গলির মুখের দিকে যেতেযেতে দেখি, একটা বছর বারো তেরোর কৃষ্ণ বর্ণের ছেলে দুই হাতে ছয়টা বল নিয়ে জাগলিং করছে। শীর্ণকায় চেহরা, মলিন জামা গায়ে, একটা হাফ প্যান্ট পরা। বুঝলাম, দু’মুঠো অন্নের সংস্থানে সকাল সকাল খেলা দেখানোর কাজে লেগে পড়েছে। ওর দুর্ভাগ্য বাজার এলাকা হলেও পথচলতি মানুষ না থাকায় কেউই তার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে না। ছেলেটি খেলা থামিয়ে বল গুলো প্লাস্টিকের ঝোলায় ভরে, ঝোলা থেকে চারটি রুপোর মতো চকচকে ছুরি বার করল। তারপর গলার জোর বাড়িয়ে বলল-” আসুন আসুন নতুন নতুন খেলা দেখে যান।” এই বলে চারটে ছুরি ক্রমান্বয়ে শূন্যে ছুড়ে আবার দ্রুত বেগে হাতে ফেরত আনতে লাগল। কিছুক্ষণ এমন ভাবে খেলা চালাতে থাকল। এ বারও একই ঘটনা ঘটল। তাকে ঘিরে কোনো মানব শৃঙ্খল তৈরি হলোনা। আমি ভজার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। এবার ছেলেটি খেলা থামিয়ে খেলার সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে চায়ের দোকানে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। উপস্থিত সকলে চা খেতে খেতে খাস গল্পে মসগুল। ছেলেটির মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও কিছু একটা ভাবছে। কিছু সময় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর ভজার কাছে গিয়ে বলল-” কাকা, আমাকে রুটি আলুরদম বাকি দেবে? আমি কদিন পরে এসে টাকা দিয়ে যাব।” ওর কথা শুনে ভজা মুখ বাঁকিয়ে ব্যাঙ্গের সুরে বলল -” যা ভাগ এখান থেকে, নগদে মাল দিতে পারছিনা উনি আসলেন—–।” অনেকক্ষণ থেকে ছেলেটাকে লক্ষ্য করছি বলে একটু মায়া হল। ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, বাকি চাইছিস কেন? ও করুন মুখে বলল-” খিদে পেয়েছে খাব।” আমি পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বার করে ওর দিকে হাত বাড়াতেই, — না না বাবু, আমি ভিক্ষা করিনা। আমার বাবু, যে আমাকে খেলা শিখিয়েছে, বলেছে, খেলা দেখিয়ে রোজগার করবি।” আমি ওর আচরণে খুশি হয়ে বললাম৷ আমি তোর জাগলিং দেখেছি, আমার খুব ভাল লেগেছে। এবার ছেলেটি আমার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে এক মুখ কৃতজ্ঞতার হাসিতে হাতটা কপালে ঠেকিয়ে আবার ভজার কাছে গিয়ে বলল-” এই টাকাটা নিয়ে আমাকে পাঁচটা রুটি আর আলুরদম দাও, বাকি টাকা পরে দিয়ে যাব।” আবার ধার চাওয়ায় ভজা বিরক্ত হয়ে প্রায় মারতে যায়। এমতাবস্থায় ভজার সাথে আমার চোখাচোখি হলে আমি ঈশারায় ছেলেটি যা চাইছে দিয়ে দিতে বলি। রীতিমত আবাক হলাম, যখন দেখলাম ছেলেটি পাঁচ পাউন্ড রুটি এরং রুটির সামঞ্জস্যপূর্ণ আলুরদম নিয়ে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল। বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না। ওর খিদে পেয়েছে বলল, তবে অতো খাবার নিলো কেন!! পঞ্চাশ টাকার খাবারই তো ওর পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কৌতূহল দমন করতে না পেরে ভজাকে পয়সা মিটিয়ে ছেলেটির পিছু নিলাম। ছেলেটি এ রাস্তা ও রাস্তা টপকে বাজারের ভিতর দিয়ে গিয়ে একটা বস্তির মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমি ছেলেটির থেকে কম দ্রুততায় বস্তির মধ্যে ঢুকলাম, এবং যথারীতি বস্তির গোলকধাঁধায় ছেলেটিকে হারিয়ে ফেললাম। কৌতুহল বাধা মানতে চায়না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বস্তির মধ্যে ছেলেটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। এক সময় রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে আসতে মনস্থির করলাম, ঠিক তখনই এক মহিলাকে দেখলাম দাঁতে গুরাখু ঘষতে ঘষতে এগিয়ে আসছে। একটু ইতস্তত করে জানতে চাইলাম, তিনি পাউরুটি হাতে কোনো বাচ্চাকে দেখেছেন কিনা। মহিলাটি দাঁত মাজতে মাজতে আমার দিকে তাকালেন কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। ভাবলাম হয়তো আমার কথা বুঝতে পারেননি। আমি বোঝানোর জন্যে বললাম, ছেলেটি বল, রিং, ছুরির খেলা দেখায়। এবার মহিলাটি কথা না বলে গালের ভিতর থেকে আঙ্গুলটা বার করে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলেন, চাপা কলের পাশের ঘরটা। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে সেই দিকে এগিয়ে গেলাম। বাইরে থেকে কথার আওয়াজ শুনে, দরমার বেড়ার দেওয়ালের বড়বড় ফাঁক দিয়ে দেখি—- ঘরের মধ্যে একটা ভাঙা চৌকির উপর এক মাঝ বয়সিনী বৃদ্ধা বসে, সাথে দু’টি বছর তিরিশ পেরোনো মেয়েও আছে। আচরণে মনে হল তিনজনই অন্ধ। ছেলেটি রুটি আলুরদম বৃদ্ধার হাতে দিয়ে বলল-” মা, এই খাবারে আজকের দিনটা চালাতে হবে। রাস্তায় লোকজন বার হচ্ছেনা দোকানপাট সব বন্ধ।” একটা বাচ্চা ছেলে বৃদ্ধাকে মা বলে ডাকাতে কেমন যেন সন্দেহ হল– বাচ্চাটি কি বৃদ্ধার সন্তান!! কৌতুহল আরো বেড়ে গেল, অনুচিত বুঝেও ওদের কথাবার্তা লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতে থাকলাম। — জানি, তুই আর কি করবি। ওরা রাজনীতি করতে বন্ধ ডেকেছে, গরীব মানুষের কথা কেউ ভাবে না। একটা অন্ধ মেয়ে বলল -” তুই টাকা কোথায় পেলি?” — চায়ের দোকান থেকে বাকি করে এনেছি। পরে টাকা দিয়ে আসব। বৃদ্ধা বললেন-” বেশ করেছিস, তোর বাবু বলত, কাজ করে খেতে হয়, ভিক্ষা করা মহা পাপ।” ছেলেটি বলল-” খেলা দেখিয়ে আজ কোনো টাকা পাইনি, চায়ের দোকানে এক বাবু আমার খেলা দেখে খুশি হয়ে আমাকে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছে। বাকি টাকাটা ধার করেছি।” ধার করে আহার সংগ্রহ করার কথা শুনে বৃদ্ধা অশ্রু সজলনেত্রে বলল-” তোর বাবু তিনজন অন্ধ মানুষকে রেখে স্বার্থপরের মতো সগ্যে চলে গেল। আজ যদি তুই না থাকতিস?” বৃদ্ধার আবেগঘন কথা শুনে বাচ্চাটি বলল-” বাবুও তো আমাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে মানুষ করেছে, খেলা শিখিয়েছে, তা না হলে আমার কি হতো বলতো?” আরেকটি অন্ধ মেয়ে বলল-” আগের জন্মে তুই আমাদের কেউ ছিলি, তা না হলে—“ বৃদ্ধা বলল-” আগের জন্মে কি ছিল জানিনা, তবে এ জন্মে পেটে না ধরলেও সন্তানের থেকে কম কিছু না। “ এ ভাবে কথোপকথনের মধ্যে ছেলেটি তিনটি বাটি করে তিনজনকে আলাদা আলাদা রুটি আলুরদম ভাগ করে দিয়ে নিজের জন্যেও নিল। তিনজন অন্ধ মানুষকে তৃপ্তি করে রুটি আলুরদম খেতে দেখে ছেলেটির মুখমন্ডলে সফলতার হাসি ফুটে উঠল। যে হাসি আমার চোখের অশ্রুধারাকে রোধ করতে পারল না।