সিরিয়াল দেখার গল্প
নিলয় বরণ সোম
যদি বলি, টিভি সিরিয়াল নিয়ে কিছু লিখব , তাহলেই অনেকের মনে হবে, এই শুরু হল, হামলোগ, নুক্কড় নিয়ে নস্টালজিয়া, “আমরা কী সুখে দিন কাটাইতাম ” মার্কা আরো একটা লেখা। তাদের আশ্বস্ত করে বলি , এটা ঠিক সেই লেখা নয় , এটা হচ্ছে সিরিয়াল দেখার গল্প। তবে গৌরচন্দ্রিকা হিসাবে বলা যেতেই পারে , ভারতে সবথেকে জনপ্রিয় সিরিয়াল বোধহয় ছিল রামায়ণ আর মহাভারত। এই দুটি সম্প্রচারের সময় রাস্তা ঘাট একদম কার্ফুর মত হয়ে যেত; সিরিয়াল না দেখা পাবলিক আমি , রবিবারের এই সময়টা মাসের জিনিস কেনা অথবা অথবা অন্য কোনো ভিড় ভাট্টার কাজগুলো এই সময়ে সেরে নিতাম !
সিরিয়াল মূলত মহিলারা দেখেন , তারাই সিরিয়াল আসক্ত , এরকম একটা ধারণা আমার ছিল বটে , তবে সে ধারণা আমার ভেঙে যায় গোস্বামীদাকে দেখে। গোস্বামীদার সঙ্গে আমার আলাপ প্রবাসে, পেশায় ছিলেন , একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ম্যানেজার। বিভিন্ন বিনিয়োগ সম্পর্কে ওঁর বেশ ভালো রকমের জ্ঞান ছিল , ব্যাংকের বিদেশী শাখায় কাজ করার সুযোগে কারেন্সির সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাও ঈর্ষণীয়। প্রবাসের বঙ্গ সমাজের অনেকেই অনেক সময় ওর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা মারার ফাঁকে কিছু পরমার্শ হাতিয়ে নিয়ে আসতেন।
এমনিতে অতিথিবৎসল গোস্বামীদার শুক্রবারের সন্ধ্যাগুলিতে কড়া নিষেধ ছিল তার বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে। কারণটা কী , না , সে সময় ‘কুসুম ‘ বলে একটা জনপ্রিয় সিরিয়াল হত , গোস্বামীদা সেই সিরিয়াল ,এবং বিশেষভাবে , সেই অভিনেত্রীর অনুরাগী ছিলেন। সে সময় ফোন এলেও উনি দায়সারা একরকম উত্তর দিয়ে রেখে দিতেন। একবার নাকি , গোস্বামীদার প্রাইম টাইমে , দেশ থেকে ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের ফোনের উত্তর এমন করে দেওয়ায় উনি ঝামেলায় পড়েছিলেন খানিকটা।
গোস্বামীদার কুসুম প্রীতি এতটাই জোরদার ছিল যে উনি একবার ছুটিতে দেশে ফেরার পথে, কোন এক সূত্রে কুসুমের চরিত্রাভিনেত্রীর ঠিকানা জোগাড় করে , দেখা করে তবে কলকাতায় ফিরেছিলেন। তখন তো স্মার্টফোন তেমন ভাবে আসে নি , সেলফিরও চল হয় নি ; আজকের দিনে হলে নিশ্চয়ই উনি কুসুমচিহ্ন রেখে দিতেন !
গোস্বামীদার কুসুমে মজাকে অনেকে ঠাট্টা করে বলতেন , গল্পে নয় , উনি মজেছেন অভিনেত্রীতে , কিন্তু কুসুম সিরিয়ালটির নিশ্চয়ই কোনো অমোঘ আকর্ষণ ছিল , না হলে , আমার এক বাঙালী বসের বাড়িতে , আফ্রিকান মেডটি কাজ টাজ সেরে কেন মালকিনের সঙ্গে বসে কুসুম দেখত ? এ কুসুম অনেক চরণচিহ্ন ছাড়িয়ে গেছে , সন্দেহ নেই !
ঝুলির আরেকটি ঘটনা আমার এনির কাছে শোনা , এনি আমার সহকর্মী ছিল , জন্মসূত্রে জিম্বাবোয়ান। তখন , সাউথ আফ্রিকান টিভি চ্যানেল SABC-2 তে খুব জোর কদমে কিছু একটা সিরিয়াল চলছিল। এমনিতে ভারতীয়দের তুলনায় আফ্রিকান রা ডিনার পর্ব আগেই সমাপ্ত করে ; কিন্তু সেই সিরিয়াল দেখার জন্য এনি তার বাড়িতে ডিনারের সময় পিছিয়ে দেয়। এনির স্বামী জর্জ সেটা নিয়ে এনির পেছনে লাগত , বলত , এটা তো পুরোটাই কাল্পনিক গল্প , এই কাল্পনিক গল্পের জন্য আমাদের জীবনধারা পাল্টাব কেন ?
বলতে গেলে এই গল্পটা দেশকাল নিরপেক্ষ , গল্পের কুশীলব এনি আর জর্জ না হয়ে অনুপমা আর সিদ্ধার্থ অথবা রাকেশ আর সিমরানও হতে পারত!
টিভি সিরিয়াল ভাষা শিক্ষার বাহন হিসাবেও মন্দ কাজের নয়। বলতে গেলে , বাঙালীদের হিন্দি শেখার অনেকটাই হিন্দি সিনেমা ও সিরিয়ালের হাত ধরে। সিনেমার তুলনায় সিরিয়ালের ভূমিকা আরেকটু বেশি এই জন্য যে , সিনেমা দেখা , সবসময়ই একটা প্রক্রিয়া , অর্থাৎ , খেয়াল রাখো সিনেমা কবে অব্দি কোন হলে চলছে ,টিকিট কাটো , সাজগোঁজ করে দেখতে যাও , ফেরার পথে নিদেনপক্ষে দুটো এগ রোল সাটাও , অনেককিছু ! সেদিক থেকে বাড়ির সোফায় রংচটা ম্যাক্সি আর কষে বাঁধা নীল সাদা খোপ খোপ লুঙ্গি পরে দিব্যি ভাষা শেখা যায় !
বাঙালির হিন্দি শেখার ব্যাপারটা জানা ছিল ,কিন্তু আমার সঙ্গে একটি মালয়ালী মেয়ে কাজ করে , চেন্নাইতে কাজ করে বলে সহকর্মীদের সঙ্গে অধিকাংশ সময় তামিলেই কথা বলে সে ; কিন্তু আমি অবাক হলাম যখন সে বলল সে বাংলাও মোটামুটি বুঝতে পারে !
স্বভাবতই আমি জিজ্ঞাসা করলাম,বাংলা সে শিখলকেমন করে!তার চটজলদি জবাব,’শ্রীময়ী’ সিরিয়াল দেখে !যদিও পরবর্তীকালে বিভিন্ন ভাষায় সিরিয়ালটি অনূদিত হয়েছে , হিন্দীতে অনুপমা নামে সিরিয়ালটি সমান জনপ্রিয় হয়েছে , আমার সহকর্মী নাকি মূল বাংলা সিরিয়ালটি দেখেছিল। তবে আমার জানাশুনা অনেকে বলেছেন , সিরিয়ালটি নাকি অতীব খাজা , গাঁজাখুরি পর্যায়ের। যাদের থেকে মতামত পেয়েছি, তাদের সাংস্কৃতিক মানদন্ড নিয়ে আমার ধারণা খানিকটা উচ্চমানের , তাই মনে হয়েছে , এরকম একটি সিরিয়াল বানিয়ে পরিচালক প্রযোজকের যে পাপ জমেছে , একটি মালায়লী কন্যাকে বাংলা শেখাতে পেরে তাদের সে পাপ ধুয়ে গেছে খানিকটা !
দেশি সিরিয়ালে অতটা নয় , বিদেশী সিরিয়ালে অনেক সময় একটু খোলামেলা ব্যাপার স্যাপার থাকে। এক বন্ধু ড্রয়িং রুমে বসে কোনো বিদেশী চ্যানেলের সিরিয়াল দেখছিল, তার মধ্যে এরকম একটি দৃশ্য , আর সে সময়ই তার নয় বছরের ভাইপোর আবির্ভাব। সে পিসির থতমত অবস্থা দেখে আশ্বাস দেয় , পিসি কিছু না , আমার মত তুমি চোখ বুঁজে ফেল , কিচ্ছু হবে না
এক কথিতভাবে নামকরা সিরিয়াল অভিনেতাকে অবশ্য আমার এক সহকর্মী , রাজা প্রচন্ড আশাহত করেছিল। সেই অভিনেতা পেশায় চার্টার্ড একাউন্টেন্ট , তার কোন একটি কেস নিয়ে রাজার কাছে এসেছিলেন। উনি প্রথমেই নিজের পরিচয় দিলেন, আমি অমুক সিরিয়ালে তমুক রোল করি। রাজা বেশ , বেশ বলে উত্তর দিলেও , ওর শরীরী ভাষা থেকে অভিনেতা বুঝতে পারেন, ও চিনতে পারছে না। তাতে না দমে। উনি আরো কয়েকটা হিট সিরিয়ালের নাম করেন , সেখানেও রাজার স্কোর জিরো।
ভদ্রলোক নাকি খুব হতাশ হয়ে বলেন, তার মানে আপনি আমার কোনো সিরিয়ালই দেখেন নি !
রাজা ওকে স্বান্তনা দিয়ে বলেছিল , আসলে আমি কোনো সিরিয়ালই দেখি না ! রাজার মুখে গল্পটা শুনে আমি বলেছিলাম , এত কথা না বাড়িয়ে ,একটা সিরিয়াল দেখেছি বলে দিলেই পারতি; হোয়াইট লাই বই তো নয় ,বেচারা খুশি হয়ে যেত !
রাজা বললো , পাগল ! তখন যদি আবার সিরিয়ালের চরিত্রের তৃতীয় বৌ বা চতুর্থ গার্লফ্রেন্ড নিয়ে প্রশ্ন করত , ধরা পরে যেতাম যে !
রাজা যেরকম একেবারেই টিভি সিরিয়াল দেখেনি , তার ঠিক উল্টো , সিরিয়ালকে গভীরভাবে ভালবাসে এমন একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমি শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলাম , তোমার হবি কী ?
উত্তরে বলেছিল , আমার অনেক ক’ টা হবি !
বিস্তারিত বলতে বলায় বলেছিল , টিভি সিরিয়াল দেখা , টিভি সিরিয়াল দেখতে দেখতে চিল করা ,জাঙ্ক ফুড খেতে খেতে সিরিয়াল দেখা , বন্ধুদের সঙ্গে সিরিয়াল দেখা , একা ঘরে সিরিয়াল দেখতে দেখতে দুঃখে চোখের জল ফেলা , সিরিয়াল দেখতে দেখতে ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠা , সিরিয়াল সম্পর্কে গল্প করা , আর লোকজনকে টিভি সিরিয়াল দেখতে অনুপ্রাণিত করা !
পাছে তার বিনোদন নিয়ে আমাকে প্রনোদিত করতে আসে , সে ভয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব আর এগোয়নি অবশ্য।
আমার কাছে সেই সিরিয়াল কিলারের ফোন নম্বর আছে , উৎসাহী হলে বলবেন !
পুনশ্চ : OTT প্ল্যাটফর্মের রমরমার পর ,টিভি সিরিয়াল ব্যাপারটা বোধহয় একটু প্রবীণতর প্রজন্ম আর একটু মধ্যম মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। সমাজতাত্বিকরা ভাবতে পারেন।
—oooXXooo—