রুদরাংশু পতিতুন্ড দীর্ঘ দিনের জামরুল বাগানের বাসিন্দা l জামরুল বাগানের পূর্ব দিকে একটা চিরহরিৎ ঘন অরণ্য আছে l দীর্ঘ দেহি সুন্দর সুন্দর বৃক্ষ রাজির সমাহার ঘটেছে এই চিরহরিৎ অরণ্যে l দিনের বেলাতেও সূর্যের আলোর প্রবেশ করার সাধ্য নেই l তবে বাঘ ভাল্লুক কিছু নেই বলেই শোনা যায় l আছে বেশ কিছু নিশাচর পাখি, বাদুড়, প্যাঁচা আর দাড়কাক l মাঝে সাঝে দু একটা হায়নার দেখা পাওয়া গেছে বলে শোনা যায় l গভীর রাতে শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক আর ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ পরিবেশটাকে ভয়াল করে তুলে রাতের অন্ধকারের ঘনত্বকে বাড়িয়ে দেয় l সূর্যাস্তের পর সন্ধ্যা রাতের নীরবতা অন্ধকারকে আরও গভীর করে তোলে l তবে ঘন গভীর অরণ্য থেকে গ্রীষ্ম কালে গা জুড়ানো শীতল বাতাস বয়ে আসে লোকালয়ে l সেটা বাড়তি পাওনা এই অঞ্চলে বসবাস করা মানুষদের l একটু হলেও স্বস্তির হয় l প্রতি দিন রাতে খাওয়ার পর রুদরাংশু বাবু বাড়ীর ছাদে গিয়ে সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে কিছুক্ষণ সময় কাটান l ওনার সঙ্গে ওনার কুকুরটাও থাকে l কুকুরটা ওনার বড় নেওটা l এটা ওনার দীর্ঘদিনের অভ্যাস l কুকুরটারও অভ্যাস হয়ে গেছে রাত্রি বেলা ওনার সঙ্গে ছাদে যাওয়া l এটা না হলে রাতে ঘুম আসতে চায় না l না প্রভুর না পোষ্যর l এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত ভোর হয়ে যায় l ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে প্রাতকৃত্য সেরে হাত মুখ ধুঁয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় আর প্রাত ভ্রমণে l এই দুই অভ্যাসকে সম্বল করেই বেঁচে আছেন রুদরাংশু বাবু l ফ্ল্যাটে ওনার পরিবার বলতে ওনি ওনার স্ত্রী আর এক মাত্র সন্তান রীতম l স্ত্রীর একটু আগে ভাগে বর্ধক্য নেমে এসেছে দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে l পুত্র রীতম অবিবাহিত l একটা দোকান চালায় l ট্রেনের টিকিট, এয়ার টিকিট, ভলভো বাসের টিকিট ও হোটেল বুকিং এর কাজ করে l পেনশনারদের ডিজিটাল লাইফ সার্টিফিকেট ও স্কুল কলেজের ছাত্রদের ফিস জমা দেবার কাজটাও করে l চাকরির চেষ্টা করে বিফল হওয়ার পর রীতম এই ব্যবসা শুরু করেছে l অল্প দিনের দোকান বলে এখনো পাশার জমিয়ে উঠতে পারেনি l রোজগার প্রয়োজনের তুলনায় কম হবার কারণে বিয়ে করতে পারে নি এখনো l বয়স একটু বেশি হয়ে গেছে কিন্তু আর্থিক নিরাপত্তা ছাড়া বিবাহিত জীবন সুখের হয় না বলেই রীতম মনে করে l ওর এক জন গার্লফ্রেন্ড ছিল কিন্তু তার বাড়ী থেকে বয়স জনিত কারণে চাপ সৃষ্টি করে তাকে অন্য পাত্রর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে l বান্ধবীর বিয়েটা রীতম আটকাতে পারেনি অপর্যাপ্ত রোজগার হয়ে যাওয়ার কারণে l এই একটা যন্ত্রনা রীতমের মনের মধ্যে খচ খচ করে সব সময় l ইদানিং কালে আর একটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে রুদরাংশু বাবুর ফ্ল্যাটে l ওনার পোষ্য কুকুরটার চরিত্রে কিছু অসংলগ্ন পরিবর্তন এসেছে l এতো দিন পর্যন্ত রাত এগারোটার সময় রুদ্রায়াংশু বাবু ও ওনার কুকুরের ছাদে যাবার সময় নির্ধারিত ছিল কিন্তু কয়েক দিন হলো কুকুরটা রাত আড়াইটা তিনটার সময় তার প্রভুকে ডেকে তুলছে l রুদরাংশু বাবু উঠলে তাকে টেনে নিয়ে ছাদে চলে যাচ্ছে l প্রথমে কিছুক্ষণ সারা ছাদময় দৌড়োদৌড়ি করে কোন গন্ধ শোকার চেষ্টা করে তারপর পূর্ব দিকে মুখ করে দু বার ঘেউ ঘেউ করে ডাক ছেড়ে ছাদের মাঝ খানে বসে পড়ে l ভোর হবার আগে ছাদ থেকে নেমে আসে l ঘরে ফিরে এসে কুকুরটা ঘুঁটিসুটি মেরে বসে কোন একটা অদ্ভুত ভাষায় কিছু একটা বলতে চায় l কিন্তু সেটা কেউ বুঝতে পারে না l সন্ধ্যার পর থেকে ও ছটফট করতে থাকে l মাঝে মাঝে চিৎকার করে অজানা ভাষায় কিছু বলার চেষ্টা করে l দিনের পর দিন কেমন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে l এই সব করতে না দিলে কুকুরটা চিৎকার করে ফ্ল্যাট বাড়ী মাথায় তুলে ফেলে l হঠাৎ পোষ্যর এই বিচিত্র পরিবর্তন কি ভাবে এলো তা কেউ কিছু আইডিয়া করতে পারে না l এটা নিয়ে ফ্ল্যাট ওনারদের মধ্যে নানা রকম কিউরিসিটি দেখা দিয়েছে l ফ্ল্যাট ওনাররা অনেকে অনেক রকম গল্প শোনাচ্ছে তার কোনটা যে ঠিক আর কোনটা যে বেঠিক সেটা বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে l রুদরাংশু বাবু দু এক জন পশুর ডাক্তার এনে দেখিয়েছেনও l কিন্তু ডাক্তার বাবুরা যা ওষুধ দিয়েছেন তাতে কাজ হয় নি l নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে কিন্তু কিছুতেই কিছু ধরা পরে নি l ভোর বেলা অন্ধকার থাকতে থাকতে মর্নিং ওয়াকের সময় রুদরাংশু বাবু কুকুরটাকে সঙ্গে করে নিয়ে বের হন তখন কোন অশুভ শক্তি ওর মধ্যে ভর করলো কিনা সেটাও বোঝা যাচ্ছে না l সকলের কথা মতো একজন ওঝা এনে ঝাড়ানো হয়েছে কিন্তু তাতেও কিছু হয় নি l রুদরাংশু বাবুরা যখন ফ্ল্যাট কিনে এই বাড়ীতে আসেন তার বেশ কিছু বছর পর হরি চরণ ঘোষ বাবুও ফ্ল্যাট কিনে এই বিল্ডিং এ আসেন l ওনার খুব স্থূলকায় চেহারা ছিল l ব্লাড সুগার ব্লাড প্রেসার খুব বাড়াবাড়ি মাত্রায় ছিল l মাঝে মাঝেই ওনার যায় যায় অবস্থা হতো l ডাক্তার ডেকে কোন মতে সামাল দেওয়া গেছে বেশ কয়েক বার l হরি চরণ বাবুরও অভ্যাস ছিল সন্ধ্যার পর ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটানো l ঘন্টা খানেক সময় ছাদে কাটিয়ে নেমে আসতেন l রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়তেন l উনি আর ওনার স্ত্রী এই দুটি মাত্র প্রাণী ছিলেন ওনার পরিবারে l ওনাদের কোন সন্তান ছিল না l দুটিতে মিল বেশ ভালই ছিলেন l ওনার স্ত্রীর একটু রুগ্ন চেহারা কিন্তু কোন রোগ বালাই ছিল না l এক দিন সন্ধ্যার পর হরি চরণ বাবু ছাদে গিয়ে বসে ছিলেন গ্রীষ্ম কালের ফুরফুরে হাওয়ায় শরীরটাকে শীতল করার জন্য l নির্মল আকাশে হঠাৎ কোথা থেকে একটা দমকা হাওয়া এসে সব উলোট পালোট করে দিয়ে যায় l হরি চরণ বাবু তড়িঘড়ি ছাদ থেকে নামতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে হার্টফেল হয়ে মারা যান মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে l অনেকে বলেছেন হরি চরণ বাবুর অকালে অপঘাতে মৃত্যু হয় l ওঁনার অতৃপ্ত আত্মা হয়তো কুকুরটার শরীরে প্রবেশ করে যেতে পারে l সেই অতৃপ্ত আত্মা কুকুরটাকে দিয়ে এমন সব পাগলামো করাচ্ছে l তখন একজন বলে যে পশ্চিম পাড়ায় তারা শঙ্কর দত্ত নামে এক জন তান্ত্রিক আছেন ওনাকে এনে যজ্ঞ করালে কিছু একটা প্রতিকার হতে পারে l রুদরাংশু বাবু ঠিকানা নিয়ে তারা শঙ্কর দত্তর কাছে যান তার প্রিয় পোষ্যকে অশুভ আত্মার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য l তারা শঙ্কর দত্ত সব কথা শুনে আসতে রাজি হন l তারা শঙ্কর দত্ত প্রয়াস ফ্ল্যাট বাড়ীটাতে যে বাড়ীতে রুদরাংশু বাবুরা থাকেন ঢুকেই কোন একটা অশুভ প্রেতের ছায়া দেখতে পান l তিনি বুঝতে পারেন যে অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ীটার চার দিকে l যখন কুকুরটার শরীরে প্রবেশ করে তখন কুকুরটা পাগলামো শুরু করে দেয় l তিনি বলেন ছাদে একটা যজ্ঞ করতে হবে l তার আয়োজন করতে হবে l আগামী অমাবস্যার দিন গভীর রাতে যজ্ঞ করতে হবে l কুকুরটাকে জাগিয়ে রাখতে হবে l রাত দুপুর হলে যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার গ্রাস করে ফেলে রাতটাকে তখন তারা শঙ্কর দত্ত যজ্ঞ শুরু করেন l আগুন জ্বালিয়ে মন্ত্র পড়তে থাকেন তান্ত্রিক l হিরিং বিড়িং ফিরিং l অং বং চং তিন বার এই মন্ত্র উচ্চারণ করে সর্ষে পোড়া দিয়ে কুকুরটার গায় ছিটিয়ে দিতেই অশুভ আত্মাটা চিৎকার করে ওঠে l ওরে বাবা রে মা রে,মরে গেলাম রে বলে কুকুরটার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলে…. “আমাকে ছেড়ে দাও l” তান্ত্রিক….” তোকে ছেড়ে দিতে পারি যদি তুই কুকুরটাকে ছেড়ে এই পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় চলে যাস l ” অশুভ আত্মা…. “হ্যাঁ আমি চলে যাবো l আমাকে ছেড়ে দাও l” তান্ত্রিক ওকে ছেড়ে দিলে ও অন্য পাড়ায় চলে যায় l কুকুরটা মুক্তি পায় l