সেই রাতটা খাওয়া দাওয়া , হইহই করে কাটিয়ে পরের দিন সকালেই এই বাড়িতে উঠে এসেছিল ওরা। ওই ব্যারাকেরই একজন জীবন বাবুর সঙ্গে কথা বলে সব ঠিক করে দিয়েছিল। কল পায়খানা সমেত আলাদা ঘর। ভাড়া একটু বেশি। কিন্তু শিখার যে দেখেই ভীষন পছন্দ হয়ে গেল। অগত্যা। নতুন বিয়ে করা বউয়ের সামনে কি আর টাকার কথা বলা যায়? তাছাড়া ঘরটা দেখে শিখার চোখে মুখে এক অদ্ভুত আনন্দ খেলা করছিল যেন। সারা জীবন এক গাদা ভাই বোনের সঙ্গে গাদাগাদি করে জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়েছে ও। হয়ত এখন একটু খোলা মেলা থাকতে চায়। মনের মত করে সাজিয়ে নিতে চায় নিজের সংসার। এটুকু দেবে না সুখেন? শুধু পয়সার হিসেবে করবে? অভাব তো আছেই। থাকবেও সারা জীবন। তবু এই প্রথম কারুর হাত ধরে সংসার বাঁধতে চলেছে ও। সেখানেও হিসেব করবে? নাহ ! মন স্থির করে ফেলেছিল সুখেন। এই ঘরই নেবে। সব কিছু সেপারেট। কারখানা থেকে কাছে। ভদ্র পাড়া। আর কী চাই ? নিমাই দা অবশ্য একটু খুঁতখুঁত করছিল। “ এত কিছু তো বেশি রোজ না তোর কারখানায়। নতুন চাকরি। জমানো টাকা ও সব জিনিস পত্র কিনতে, লোক খাওয়াতে খরচ করে ফেল্লি।আরো একটু কম ভাড়ার ঘর দেখলে হতো না ? এত বড় মানুষি করলে চলবে ?” শিখার মুখ দেখে ততক্ষণে বুঝে গেছে সুখেন। তাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদায় করল নিমাই দা কে। তখন অবশ্য জানে না শিখার মতলব টা কী? দু তিন দিন পরেই কথাটা খোলসা করল শিখা। রান্নার কাজ করবে ও। আগেই ডাক পেয়েছে কয়েক জায়গা থেকে। ও অনেক ভেবে দেখেছ রান্নার কাজই সব থেকে ভালো। নির্ঝঞ্জাট ভদ্র পরিবার দেখে কাজ ধরবে। রান্নার কাজে সম্মানও আছে আর পয়সাও। খাটনি তত কিছু নয়। কারখানার কাজের থেকে অনেক কম। তাছাড়া সুখেন বেরিয়ে গেলে সারাদিন করবেই বা কী ও ? শুধু খেয়ে ঘুমিয়ে সময় কাটে? বরং দুজনে রোজগার করলে দুটো পয়সার মুখ দেখা যাবে। আর কিছু হাতে জমানোও যাবে। তাই করেছে ও। এমনিতেই ভীষন হিসেবী আর গুছনো। আর এখন তো নিজের সংসার। চেয়ে চেয়ে দেখেছে সুখেন কী সুন্দর ঘর সাজিয়েছে শিখা। ব্যারাকের ওরা চাঁদা তুলে একটা তক্তা পোশ , তোষক, বালিশ, বিছানার চাদর উপহার দিয়েছিল। নিমাই দা মাঝে একদিন এসে দিয়ে গেল একটা টেবিল আর দুটি চেয়ার। ক্রুশ দিয়ে বুনে তার ওপর ঢাকা তৈরি করল শিখা। ফেলে দেওয়া জলের বোতলের ওপর রং করে তৈরি করে ফেলল ফুলদানী। জামা কাপড় রাখার জন্য একটা টিনের ট্রাংক কিনেছিল সুখেন। তার ওপরে পুরোনো শাড়ি কেটে কেমন সুন্দর ঢাকা তৈরি করেছে ! সব দিকে নজর। খুঁটি নাটি সব হাতের সামনে জোগানো। এরই মাঝে একবার পিসিকে বউ দেখিয়ে এনেছে সুখেন। পিসি নিমাইয়ের কাছে সব শুনেছিল। দুঃখ পেলেও ব্যাপারটা বুঝেছে। শিখাকে অনাদর তো করেই নি। বরং নিজের এয়োতির চিহ্ন সোনার এক গাছা নোয়া, কানের কানফুল ,পায়ের চুটকি সব বার করে দিয়েছে। শিখাও নিয়ে গিয়েছিল পিসির জন্য। তসরের কাপড়, গঙ্গাজল, চন্দন কাঠ। পিসি তো বেজায় খুশি ! বুদ্ধি বটে শিখার ! কী দিয়ে কাকে বশ করা যায় সেটা খুব ভালো জানে। শুধু রাগটা বেশি। এই যে রিন্টিকে নিয়ে এসেছে ও । যতই রাগ দেখাক ব্যবস্থা ঠিক একটা করে দেবে ও। যে দুটো বাড়িতে রান্না করে ও তারা তো শিখা বলতে অজ্ঞান। কী বিশ্বাস ! সব সময় তো বলছে একটা তোমার মত লোক জোগাড় করে দাও। কারুর বোনের বাড়ি দরকার।কারুর আবার বাপের বাড়ি। সেসব কোথাও চালান করতে হবে মেয়েটাকে। তবে দেখে শুনে। নইলে পিসির কাছে মুখ দেখাতে পারবে না সুখেন। আর কাল থেকে বাইরের দাওয়ায় আর শোয়া হবে না শিখার। ওই মেয়েটা একাই শোবে। স্পষ্ট বলে দেবে সুখেন। শিখা অবশ্য বলবে “ তোমার কুটুম। কিছু মনে করবে আবার।” ওসবে পাত্তা দেবে না সুখেন। মনে করার কী আছে এতে? যার যেমন ঘর সে তেমনই জায়গা দেবে। আর ও মেয়ে কি পালঙ্কে শুয়ে কাটিয়েছে নাকি এতদিন? দাওয়ায় মাদুর পেতে শুতে ওর কোন কষ্ট হবে না। আজকের রাতটা কাটুক। ব্যস। কাল থেকে সব অন্য ব্যবস্থা করবে সুখেন। পাশ ফিরে পাশ বালিশ বুকে চেপে চোখ বন্ধ করে ও।