শিখা ঠিক সময়েই বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে। কেউ জানতে পারে নি। নিমাই দা ওকে বাস স্ট্যান্ড অব্দি নিয়ে এসে নিজেও বাসে উঠে পড়েছিল। বিরাজ দা সব চুপচাপ দেখে আর ওখানে দাঁড়ায় নি। ফলে ওই বাসেই ওরা চারজনে কালীঘাট পৌঁছেছিল। সুখেনের তো তখন হাত পো কাঁপছে। যা করার সব ওরাই করল। শিখার নতুন কাপড় চোপড়, সুখেনের ধুতি পাঞ্জাবি, ফুলের মালা টোপর সব জোগাড় করল। তারপর পুরুত ডেকে বিয়েটা হয়েও গেল। দুপুরে ওখানেই একটা হোটেলে মাছ ভাত খেয়ে বিকেলে এলো কসবায়। শিখাকে নিয়ে নিমাই দা দাঁড়িয়ে রইল। বিরাজ সুখেন কে নিয়ে চলল কারখানায়। সেখানে গিয়ে কথাবার্তা বলে ফিরতে বেশি দেরি হল না। তাতেই ফিরে এসে দেখে শিখার মুখ কাঁদো কাঁদো। ও বোধহয় ভাবছিল ওকে ফেলে কেটে পড়েছে সুখেন। তারপর যাওয়া হল থাকার জায়গায়। ঘর একটা পাওয়া গেল ঠিকই মানে কোম্পানির বাসস্থান। কিন্তু সেখানে আরো অনেকে লোকের বাস। বউ নিয়ে থাকার মত নয়। একটা বাথরুম পায়খানা। সেটাই এই দশ পনেরো জন লোককে ব্যাবহার করতে হয়। চান করার কোন আলাদা জায়গা নেই। মেয়েদের পক্ষে খুব অসুবিধে। তাছাড়া কারখানার সবার এক সময় ডিউটি নয়। অর্থাৎ সারা দিন ওখানে কয়েকজন থাকেই। কে কী রকম লোক এখন তো কিছুই জানে না সুখেন। কী করে এই অবস্থায় শিখাকে একলা রেখে কাজে যাবে? ওদের দেখে ওখানকার লোকেরাও যে বেশ অবাক হয়েছে বোঝা যাচ্ছিল। শিখার নতুন কাপড়। কপালে সিঁথিতে সিঁদুর মাখামাখি। সুখেনের নতুন ধুতি পাঞ্জাবি। নিমাইয়ের হাতে টোপর, ফুলের মালা। ওরা যেন হঠাৎ কী রকম একটা আনন্দ পেয়ে গেল ! হইহই করে উঠল ব্যারাক শুদ্ধু লোক ! “ দাদা কি বিয়ে করে কাজে ঢুকলেন নাকি?” “ কী কাণ্ড ! এই বুঝি বৌদি ! বাহ বাহ !” “ তাহলে কালকে বউভাতের অনুষ্ঠানটা এখানেই হোক। কী বলেন ?” কলকল করে কথা বলছিল ওরা। হা হা করে হাসছিল। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছিল লোক গুলো খুব আন্তরিক। “ বেশি কিছু না দাদা। পাঁঠার মাংস আর ভাত। শেষ পাতে আমের চাটনি আর মিষ্টি।” কথা শেষ হতে না হতেই আর একজন হেসে উঠল। “ বাব্বা ! এ যে রীতিমত ভোজ রে!” “ তো দিতে হবে না ? আমরাও চাঁদা তুলে উপহার দেব। কী বলিস গনশা ?” এতক্ষণে কথা বলতে পারে নিমাই দা। “ দাঁড়ান মশাইরা। সদ্য বিয়ে করেছে। চাকরিও সদ্য। এক্ষুনি ভোজ হবে কী করে? হাতে এক হপ্তার মাইনেটা অন্তত পেতে দিন।” আবার হইহই করে উঠল দলটা। “ সেকি মশাই ! বিয়ে আজ করেছে আর ভোজ দেবে এক হপ্তা পর ? সেকি হয় নাকি ? তাতে তো বিয়ের মজাই মাটি !” ভারি ভালো লাগছিল সুখেনের। ওর বিয়ে নিয়ে সকলে এত আনন্দ করছে আর ও চুপ করে থাকবে? কত আর খরচ হবে? টাকা তো আছে হাতে। হ্যাঁ বেশ কিছুটা জিনিসপত্র কিনতে খরচ হয়েছে। আর কিনতেও হবে। তবু জমানো কিছু আছে তো ওর। হোক না একটা ভোজ। ছোট থেকেই তো দেখে আসছে বিয়ে বাড়ি মানে আলো সানাই, লুচি ভাজার গন্ধ, রজনীগন্ধার মালা। সেসব তো কিছুই হল না। অন্তত কিছু মানুষ খাওয়া দাওয়া করুক এই উপলক্ষ্যে। নিমাইদা কে আড়ালে ডেকে বলল ও। সব ব্যবস্থা এরাই করে নেবে। শুধু টাকা দিলেই হবে। করুক না। ওর নিজেরও ইচ্ছে। একটু হইচই হলে মন্দ কী? নিমাই দা শুনল। তারপর বলল “ দাঁড়া। তুই কিছু বলিস না।” তারপর কী জানি কী বিরাজের সঙ্গে পরামর্শ করল। শেষে বলল, “ দেখুন ভোজ তো দেওয়াই যায়। সেটা একটু অসুবিধে হলেও করে দেওয়া যাবে। কিন্তু এরা থাকবে কোথায়? এইখানে তো বউ নিয়ে থাকার অসুবিধে মশাই। এসব ব্যাচেলর লোকেদের জায়গা। এখানে কি মেয়েছেলে নিয়ে থাকা যায়? একটা ঘর টর কাছাকাছি পাওয়া যাবে না? দেখুন না ” এই ধরনের প্রস্তাব শুনে প্রথমে একটু থমকে গেল ওরা। এরকম কথা আশা করে নি বোধহয়। একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে শেষে একজন বলল “ এই জীবন বাবু ভাড়াটে বসাবে বলছিল না ? এরকম নির্ঝঞ্ঝাট ছোট্ট ফ্যামিলি খুঁজছিল তো। একবার বলে দেখলে হয় না ? এর থেকে ভালো আর কী পাবে? আর ঘর তো ওই টুকু !”