অস্ত্র
বাসুদেব চন্দ
ঘুম আসছিল না, এপাশ-ওপাশ করে শেষে অনির্বাণ উঠেই বসল। ইকবাল ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে ওকে আর জাগাল না। কিন্তু অন্ধকার একটা ঘুপচি-ঘরে কতক্ষণ আর এভাবে বসে থাকা যায়! আলো জ্বালিয়ে যে বই পড়বে তারও উপায় নেই। অগত্যা অস্থির মন স্থির করতে ধ্যানে বসল। কিন্তু তাতেও কী মনঃসংযোগ হয়!
হঠাৎ কানে এল জন্তু-জানোয়ারের আওয়াজ, কোনও এক বড় জন্তুর হাত থেকে বাঁচতে প্রাণ হাতে নিয়ে পালাচ্ছে! অনির্বাণ কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করল…….শুকনো পাতার আওয়াজ…… বেশ কয়েক জোড়া বুটজুতো এগিয়ে আসছে……! বাকিটা বুঝতে আর অসুবিধা হলো না! এক মুহূর্তের মধ্যে ইকবালের মুখ চেপে ধরে দৌড় লাগাল বিপরীত দিকের জঙ্গলে……….!
অনির্বাণ এবং ইকবাল গভীর রাতে ঘন জঙ্গলের মধ্যে পালাতে গিয়ে দল থেকে আলাদা হয়ে গেছিল! ওঁরা বিপ্লবী, ভয়-ডর ওঁদের নেই। সামনে বড় লড়াই, তাই বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা!
গোপন সূত্রে খবর পেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে ডেরা ছেড়ে পালাতে হয়েছে! কষ্ট করে জোগাড় করা অস্ত্রশস্ত্র একটাও সাথে নেই। ভরসা শুধু দুটো মোটা বই, অনির্বাণের গীতা আর ইকবালের কুরআন। যেগুলো বনে-বাদাড়ে লুকিয়ে থাকার সময় মাথার-বালিশেরও কাজ করে।
পুলিসের তাড়া খেয়ে পালাবার সময় বইগুলোকে ওঁরা পিঠে বেঁধে নেয়। এভাবে দুয়েকবার ব্রিটিশ পুলিশের গুলির হাত থেকে বেঁচেও গেছে! তাই কখনও বই দুটোকে কাছ-ছাড়া করে না।
আজ যে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পালাচ্ছে, সেখানে আগে কখনও আসেনি। তবে বারীনদার কাছে শুনে শুনে একরকম চেনা হয়ে গেছে। এটাই বিপ্লবীদের পালাবার একমাত্র পথ।
নেমক-হারাম দেশীয় পুলিশ এবং খোঁচরগুলো সঙ্গে না থাকলে সাহেব পুলিশগুলো এ-জঙ্গলে ঢুকতে সাহস করে না, কারণ ওরা জানে যে সাহেবদের মাংস বাংলা-বাঘের খুব প্রিয় খাদ্য! সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে খোঁচর সঙ্গে আছে। কিন্তু এভাবে আর পারা যাচ্ছে না! ছুটতে ছুটতে দুজনেই হাঁপিয়ে উঠেছে! বুদ্ধি করে অনির্বাণ ইকবালকে টেনে নিয়ে একটা ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। ইকবাল বলল- “শালা এ তো পাগলা কুত্তার মতো তাড়া করেছে! কী হবে ভাই”! দুজনেই পিঠে বাঁধা বইটাকে খুলে বুকে আগলে নিল। অনির্বাণ বলল- “ঘাবড়িও না, দেখোই না কী করি”- এই বলে বাঘের ডাক নকল করতে শুরু করল। বেশ কয়েকবার ডাকার পরেই ফল পাওয়া গেল, পড়িমরি করে পালাল ব্রিটিশ-পুলিশ!
এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হলো! দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে “বন্দে….. মা..… তরম” ধ্বনিতে পুনর্জন্ম লাভ করার আনন্দ প্রকাশ করল! অনির্বাণ কাপড়ে মোড়া গীতাকে চুম্বন করল! ইকবাল করল কুরআনকে! কিন্তু এ কী, ঝোঁপের বাইরে বেরিয়ে আসতেই দুজনের আবার ঘাম ঝরতে শুরু করল!
সামনেই জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ! নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও ইকবাল মজা করতে ছাড়ল না! বলল- “শেয়াল নয়, কুকুর নয়, একেবারে বাঘের ডাক নকল করলে! এবার ঠেলা সামলাও”! অনির্বাণের মুখ থেকে একটা শব্দও বেরল না, গীতাটাকে বুকে আগলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!
বাঘটা কেমন যেন শান্ত প্রকৃতির, রাগ-গর্জন কিছুই তেমন নেই! প্রথমে ওঁদের ভালো করে শুঁকল। তারপর চারপাশে কয়েক পাক ঘুরে নিয়ে শুয়ে পড়ল! ইকবাল বলল- “বুঝেছো অনির্বাণ, এখন ওর খিদে নেই, দেখেশুনে মজুত করে রাখল, কাল সকালে আরাম করে খাবে”! অনির্বাণ কোনও কথাই বলল না, শুধু ইশারায় ইকবালকে চুপ থাকতে বলল। ও একমনে বাঘটাকে বোঝার চেষ্টা করল, আর বারীনদার কাছে শোনা গল্পের সঙ্গে বাঘের স্বভাব এবং গতিবিধি মেলাতে লাগল। হঠাৎ বাঘটা রেগে গিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল, মনে হয় কোনও জানোয়ারের গন্ধ পেয়েছে। এই ফাঁকে ইকবাল অনির্বাণের হাত ধরে পালাবার জন্য টানাটানি শুরু করল! অনির্বাণ বলল- “বোকামি কোরো না, আমরা কি পালিয়ে বাঁচতে পারব? যাকে বুকে আগলে রেখেছো, তাঁর উপরেই ভরসা রাখো, একটা উপায় ঠিকই বেরবে”! ওঁদের দুয়েক কথা শেষ হতেই বাঘটা এসে আবার নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল। অগত্যা ওঁরাও বসে পড়ল সুবোধ বালকের মতো!
অনির্বাণ ইকবালের কাঁধে মাথা রেখে একটু ঝিমিয়ে পড়ল, ইকবাল কিন্তু টানটান হয়ে বসে রইল বাঘের দিকে তাকিয়ে, যেন কখন ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে তারই অপেক্ষায়! মনে মনে আল্লার কাছে দোয়া করল “অনির্বাণ যেন বেঁচে ফিরতে পারে”!
এভাবে কয়েক ঘণ্টা কাটতেই পাখিদের ডাক কানে এল, সূর্যের আলো ডালপালার ফাঁক দিয়ে বনের ভেতরে ঢুকতে লাগল। চারদিক একটু পরিষ্কার হতেই বাঘটা এগিয়ে গিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল-
বুদ্ধিমান অনির্বাণ বাঘের ইশারা বুঝতে পেরে ইকবালকে সঙ্গে নিয়ে ওর পেছন পেছন এগোতে লাগল………।
ইকবাল জিজ্ঞাসা করল-
ভাই কোথায় যাচ্ছি বলবে?
-নদীর দিকে,
-কেন, চান করতে?
-ঠিক তাই।
-ব্রাহ্মণ বাঘ বুঝি, শিকারকে চান না করিয়ে খায় না?
-গোটা একটা রাত কাটিয়ে বুঝতে পারলে না ব্রাহ্মণ না কায়েস্থ?
-এখন মশকরা করার সময় নয় ভাই, যা বলছি মন দিয়ে শোনো- বারীনদা কিন্তু তোমার জন্য দুশ্চিন্তায় আছেন, তুমি যে ভাবেই হোক, এখান থেকে পালাও, আমার জন্য ভেবো না।
-ঠিক আছে, আর কথা না বাড়িয়ে চলো এগিয়ে যাই…..।
মাইল খানেক হাঁটার পর ওঁরা নদীর কাছে পৌঁছল। দূর থেকে একটা নৌকো দেখা যাচ্ছে….., মাঝির সঙ্গে আরেকজন কে ও, হাত নাড়ছে? মনে হচ্ছে তুহিন, বারীনদাই পাঠিয়েছেন! ইকবাল বলল- “আমি জানতাম, অনির্বাণ, এই সুযোগ, তুমি পালাও”! অনির্বাণ বলল- “তুমি এখনও বুঝলে না, বাঘ আমাদের মারতে নয় বাঁচাতে এসেছে! ঐ দেখো- নৌকোর দিকে তাকিয়ে কীভাবে বসে আছে! ওর গল্প বারীনদার কাছে অনেকবার শুনেছি, এখন বুঝলাম ইনিই সেই ‘দেশপ্রেমিক বাঘ’! ইকবাল আনন্দে কী করবে বুঝতে পারছে না! দুজনেই বাঘের সামনে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল! বাঘটা কয়েকবার হেঁকে-ডেকে কিছু বলার চেষ্টা করল, তারপর লেজ নাড়তে নাড়তে জঙ্গলে ফিরে গেল। ওঁরা জল ভরা চোখে তাকিয়ে রইল……., যত দূ……র দেখা যায়…….!
হঠাৎ অনির্বাণ আর ইকবালকে পেছন থেকে কে যেন এসে জড়িয়ে ধরল!
ফিরে দেখে তুহিন!
ওরা তিনজন নৌকোর দিকে এগোতে থাকল, কাদায় পা আটকে যাওয়ায় অনির্বাণ নিজেকে আর সামলাতে পারল না, পড়ে গিয়ে প্রায় সারা শরীরেই কাদা মাখিয়ে ফেলল! হাতের গীতাটাও ছিটকে পড়ল! “ভাগ্যিস কাপড়ে জড়ানো ছিল, নইলে যেত নোংরা হয়ে”- এ কথা বলে অনির্বাণ কাদামাখা কাপড়টা ফেলে দিল, তারপর অবাক দৃষ্টিতে উভয় উভয়ের দিকে তাকিয়ে রইল! কারণ অনির্বাণের হাতে গীতা নয়, রয়েছে কুরআন, আর ইকবালও কাপড় খুলে দেখে গীতা, যেটাকে কুরআন মনে করে বুকে আগলে রেখেছে দিনের পর দিন! ওরা বিন্দুমাত্র অবাক না হয়ে, তিনজন তিনজনকে জড়িয়ে ধরে, আকাশ বাতাস মুখরিত করে তিন-মুঠো হাত উঁচিয়ে গর্জে উঠল- “বন্দে…….. মা……. তরম…….”!
ততক্ষণে জোয়ার এসে গেছে……., এগিয়ে চলল নৌকো….., বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে ওরা তখন মাঝনদীতে…………
“ওপারেই স্বাধীনতা”!
—oooXXooo—