দেবীপুরের ‘মা করালিনী’ খুবই জাগ্রত দেবী। দেবীর মহিমা পরখ করতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসেন! প্রায় প্রতিদিনই। ছুটিরদিন হলে তো কথাই নেই, মন্দির’প্রাঙ্গন দেখতে দেখতে নামিদামি গাড়িতে ভরে ওঠে! কেউ আসেন মানত করতে, কেউ আবার মনস্কামনা পূরণ হওয়ায় মানত রাখতে!
***
রূপ ও সজ্জায় মায়ের দর্শন আক্ষরিক অর্থেই নয়নাভিরাম! মাথার চূড়া থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত পুরোটাই স্বর্ণালঙ্কারে মোড়া! লাল টকটকে জিভটুকু ছাড়া! সবই ভক্তদের শর্তসাপেক্ষে দেওয়া!
এখানে প্রার্থনা-আরতি আর বাদ্যযন্ত্রের ঝংকারে সৃষ্টি হয় অপূর্ব এক মায়াবী পরিবেশ! যেন মর্তের মাটিতে এক টুকরো স্বর্গ বিশেষ!
শুধু মায়ের রূপের কথাইবা বলি কেন- ভগবানের মুখোমুখি দাঁড়ানো ভক্তদের রূপও উন্মুখ হয়ে দেখার মতো! বিশেষকরে মা-জননীদের পরনের শাড়ি, গায়ের রং এবং গয়নার উজ্জ্বলতা মন্দিরের গরিমা’কে আরও গর্বিত করে তোলে!
***
এক রোববারের সকালে মন্দিরের এক কোণে আমি বসে আছি। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাতড়ে বেড়াচ্ছি- কিছু যদি খুঁজে পাই!
আর আমার ঠিক উল্টোদিকেই বসে আছেন প্রধান পুরোহিত ‘তারিণী চট্টরাজ’। হাতে কিছু একটা রয়েছে, দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
নব্বইয়ের ভারে নুয়ে পড়েছেন, তাই পূজার্চনার দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধান শিষ্য ‘কাশীনাথের হাতে।
কাশীনাথ পুজো সেরে উঠে দাঁড়িয়েছেন, পঞ্চপ্রদীপ হাতে নিয়ে এবার আরতি শুরু করেছেন। ঠাকুর’মশাই উঠে দাঁড়াতেই ভক্তরাও একে একে উঠে দাঁড়িয়ে করজোড়ে প্রার্থনা শুরু করলেন! ঐ মানত, আর কী!
আমি আমার প্রার্থনায় মগ্ন রয়েছি…
হঠাৎ ছন্দ পতন ঘটিয়ে মন্দিরে ঢুকে পড়ল বাতাসি এবং ওর দুই ছেলেমেয়ে- ‘পালান আর পিপলি’!
বাতাসি আসতে চায়নি, পালান’টাই এমন বায়না ধরল যে আসতে বাধ্য হলো! ওর খুব ইচ্ছে- বোনকে ‘ইয়া বড় জিভআলা’ কালী’ঠাকুর দেখাবে! শুধু তাইই নয়, নিজেরও খুব জানার ইচ্ছে- এখানে এমন কোন ঠাকুর থাকে, যাকে দেখার জন্য দূর দূর থেকে লোকগুলো ছুটে আসে!
বাতাসি ঢোকার আগে যতটা ভীতু ছিল, ঢোকার পরে আরও ভীতু হলো! মনে মনে ভাবছে- ও’দুটোকে নিয়ে কতক্ষণে এখান থেকে পালাবে! পালানেরও ‘পালাই পালাই’ মন! এত উঁচু ঠাকুর, এত বড় বড় সব মানুষজন দেখে ও বেচারা ঘাবড়ে গেছে! একমাত্র ‘পিপলি’ই ভাবলেশহীন! মায়ের দুটো পায়ের মাঝখানে ঢুকে গিয়ে ঘাড় উঁচু করে সব দেখছে! যত না ঠাকুরটাকে, তারথেকেও বেশি দেখছে মানুষগুলোকে-
“এরা কারা! কোথায় থাকে!”
এক সঙ্গে এত সুন্দর সুন্দর মানুষ এর আগে কখনও ও দেখেনি! মনে মনে ভাবছে-
“এমন করে ঠাকুরের কাছে ওরা কী চাইছে!”
উত্তর কিছু না পেয়ে ও’ও ওঁদের দেখাদেখি হাতজোড় করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল-
বাতাসি ওর দুঃসাহস দেখে সঙ্গে সঙ্গেও বড় বড় দুটো চোখ এবং একটা গোটা জিভ বার করে বুঝিয়ে দিল- “এটা করা ভারি অন্যায়, ওঁদের নকল করতে যেয়ো না বাপু!”
কিন্তু কে কার কথা শোনে! আবার নম করতে শুরু করল!
এবার পালান বোনের হাত দুটো পিছন থেকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
পিপলিও কম যায় না, পুরো জিভখানা বের করে ঠাকুরটাকে দিল ভেঙিয়ে। তারপর দাদার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে দিল!
বাতাসি’র তো লজ্জা আর ভয়ে কাপড় নষ্ট হওয়ার মতো অবস্থা! সেটা হলেও তো রক্ষে নেই, ‘নরবলি’ নির্ঘাত!
কিন্তু না, যা ঘটল তাতে আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম!
ততক্ষণে তারিণী’ঠাকুর একজন শিষ্যের হাত ধরে পিপলির সামনে এসে দাঁড়ালেন, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে ওর হাতে একটা সন্দেশ দিলেন! বাতাসি-পালানকেও দিলেন! বুড়ো’বাবার আচরণে বাতাসি খানিক ভরসা পেলেও, দাঁড়িয়ে থাকার আর সাহস পেল না!
হঠাৎ নজর গেল পিপলি’র পায়ের দিকে- একটা জীবন্ত জবাফুল ওর দুটো পায়ের ঠিক মাঝখানে এমন করে পড়ে আছে, যেন- শুয়েপড়ে পোনাম কোচ্ছে’!
বুড়ো’বাবার চোখে চোখ পড়তেই বাতাসির বুকটা কেঁপে উঠল! সঙ্গে সঙ্গে ছোঁ মেরে পিপলিকে কোলে তুলে নিয়ে ওখান থেকে ছুটে পালাল! পেছন পেছন পালান’ও!
ইতোমধ্যে গুরুদেবের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন আরও কয়েকজন শিষ্য।
আনন্দাশ্রুর সাথে সাথে গুরুদেবের সারা শরীর দুলে উঠল, কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বললেন- এতদিনে আমার মানত পূরণ হলো……! তোমরা আমাকে ঘরে নিয়ে চলো…… আমি ঘুমোব……..! শান্তিতে ঘুমোব……!