সকাল থেকেই মুখভার সুরমার। মেয়েটার রেজাল্ট বেরোবে। অনলাইন না কি যেন বলে তাতেই নাকি জানা যাবে মণির উচ্চ মাধ্যমিক এর রেজাল্ট। সুরমা এগুলো ঠিক বোঝেনা। সেই কবে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে দিয়েছে সে। তাদের আমল আর এই আমল অনেক তফাত। তখন কত ই বা বয়স ওর। সত্যিই ওর ভাগ্যের চাকা কতরকমের পাক খাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। সুরমা একান্নবর্তী পরিবারে বড়ো হয়েছে। মায়ের কথা কেউ পাত্তাই দিত না। তার মা শুধুই পাঁচবেলা অন্ন ব্যঞ্জনের জোগান ব্যস্ত। সুরমা সবে তেরোতে পা দিয়েছে। বাপকাকাদের চিন্তা এমন কালো কুৎসিত মেয়েটার কী গতি হবে। সত্যিই বলতে কী সুরমার আপনজনেরাই সুরমার রূপ নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য করত। তাও আবার আড়ালে আবডালে নয়, একেবারেই প্রকাশ্যে। তবে বাইরের কেউ এমন বলতো না। সবাই তাকে পছন্দ করত। এই তো সেদিন কার কথা। সুরমা তখন সপ্তমশ্রেনি থেকে অষ্টমে উঠেছে। দুর্গাপুজোর নারকেল নাড়ু তৈরি হচ্ছে। কাকীমা বললে “অ সুরো। নারকেল কুড়ে দে। কুড়ুনিটা আন” সুরমা বললে “আমি তো কখনও নারকেল কুড়িনি। আমি পারি না”। কাকীমা চোখ তুলে বললে “তবে আর কি? ধিঙ্গি মেয়ে হয়েছ। সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় টোকলা সেজে বেড়াও। “ জেঠিমা মুখটা বেঁকিয়ে বললে “ভালো শিক্ষা দিয়েছে তোর মা। কথাতেই আছে জানিনা, পারিনা নেইকো ঘরে। এই তিনেতে দেবতা হারে। বলি গিলতে তো পারো?” এই প্রথম সুরমার মা প্রতিবাদ করে উঠল “কী কথায় কী কথা বলছেন বড়দি। সুরো আমার দুধে বালিকা মেয়ে। অমন করে বলবেন না”। জেঠিমা ঝঙ্কার দিয়ে বলেছিল “বেশ তো। আমাদের কথা শোনার দরকার নেই। যখন বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির লোকজন বসিয়ে দিয়ে যাবে তখন না হয় আমাদের কথা স্মরণ করিস মেজোবউ। গরীবের কথা বাসি হলে খাটে”। মায়ের সেদিনের প্রতিবাদ সুরমাকে খুশি করেছিল। তার মনে হয়েছিল যার মা থাকে তার আবার ভয় কি? তারপর একদিন গোধূলিলগ্নে সুরমার বিয়ে হয়ে গেল। তখনও সুরমা জানতো না বিবাহ মানে কি। শুধুই মনে হল এই কালো রোগা ছেলেটা এখন থেকে ওর স্বামী। আর ওই শ্বশুর বাড়ির কাজ রান্নাবান্না খেতে দেওয়ার দায়িত্ব এখন থেকে ওর। যেমন করে মা সবকিছুই সামলায়। সুরমাকে যারা এতদিন শাসন করে এসেছে, সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি দেখলে ছুঁড়ে দিয়েছে বাক্যবাণ তারা বিয়ের সময় মুখ ঢেকেছে। কোনও সাহায্য তো দূরের কথা কোনও উপহার পর্যন্ত দিল না। শাসনের সময় ছিল। সোহাগে নেই।
অবহেলার অনেক শক্তি। সংসারে যারা অবহেলিত তাদের অন্তরের একাকীত্ব একদিন বিস্ফোরণ ঘটায়। তখন তাকে কেউ আটকে রাখতে পারে না। নদীকে বাঁধ দিলে যেমন দুকুল ছাপিয়ে বন্যা আনে। ছোট্ট সুরমা বউ হয়ে গেল। যাকে বলে বালিকাবধূ। ছোটোবেলার খেলনাপাতি খেলার মতো যেন কুটুমবাড়িতে এলো। পাড়া প্রতিবেশীরা ছুটে এল নতুন বউ দেখতে। গাঁয়ের ঠাকুর তলায় প্রণাম সেরে বর কনে চলল ঘরের দিকে। বরণ করার সময়ই শাশুড়ির মুখ ভার। অমন কার্তিক ঠাকুর এর মতো ছেলের বিয়ে দিয়ে কী ঠকাটাই না ঠকেছে। সরু সরু কটা চুড়ি, পিতপিতে একটা হার।কানের দুলটাও তথৈবচ। বরযাত্রীর দল এসে বললে দানের আঙটি পরাতে গিয়ে ভেঙে গেছে। তাড়াহুড়ো করে বরণডালাটা মাথায় ঠেকানো শুধু। দুমদুম করে ঘরে ঢুকে গেল শাশুড়ি। কে একজন বললে ভিড়ের মধ্য থেকে “বউ খুব ছোটো নয় । মেঘে মেঘে বেলা হয়েছে”।
ছোট্ট সুরমার মনে যেন জোয়ার ভাটা চলে। এ কোথায় এসে পড়েছে সে। ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বর হাওয়া। সুরমার খুব ভয় করছিল। অবশেষে ওর বয়সী একটা মেয়ে এসে বললে “আমি তোমার ননদের মেয়ে। মানে ভাগ্নি। চলো। তোমাকে বিয়ের শাড়ি খুলিয়ে একটা অন্য শাড়ি পরিয়ে দিই। তা তোমার বাক্সটা কোথায়”?
সেই সময়ই আবার শাশুড়ির আবির্ভাব। টিনের তোরঙ্গে কয়েক টা কমদামী কাপড়। খনখনে গলায় বললে “আচ্ছা ঠকান ঠকেছি বটে। ভাবলাম পাঁচবাড়ির মেয়ে। জ্যাঠা কাকা মিলে পাওনা গন্ডা ভালোই দেবে। তাই মুখ ফুটে চাইনি কিছু। তাই বলে এমনধারা। শোনো বৌমা। ও বাড়ি যাবার নাম করবে না। বলি বিয়ে মানুষের কতবার হয়। এটুকু কী দিতে নেই “। বলেই শাশুড়ি দুটো সোনার বালা সুরমার দুই হাতে পরিয়ে দিলে। ছলছল চোখে বৌকে চুম্বন করলে। এতক্ষণ যে শাশুড়িকে সুরমার ভীষণ ভয় হচ্ছিল এখন সেটা কেটে গেল। শাশুড়ির পায়ের ধুলো নিলে ছোট্ট সুরমা। শাশুড়ি দেখলে লাল শাড়িতে শ্যামলা মুখ টা যেন লাবণ্য মাখা। বললে “আজ থেকে তুই আমার মেয়ে।শুধুই আমার “। জীবন বড়ো বিচিত্র। ঠিক নদীটার মতো। ভাঙা গড়া আছে বলেই তো জীবন এত সুন্দর। ভালোবাসার অসীম শক্তি। ভালোবাসা পেলে মানুষের আত্মশক্তির বিকাশ ঘটে। শাশুড়ির প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল সুরমার হৃদয়। তার মনে হল “মাতৃত্ব সবার মধ্যে থাকে না। মেয়ে মানেই মা হয় না। “
সুরমার কত ইচ্ছা ছিল সে লেখাপড়া করবে। সব ইচ্ছা মরতে বসেছিল। কিন্তু অবাক কান্ড। সেদিন একটা বই এনে শাশুড়ি মা বললে “এই বইটা তোর জন্য। পড়িস। যখন অবসর পাবি তখন ই পড়বি”। সুরমা দেখলে বই এর মলাটে লেখা “পথের পাঁচালী”। যত পড়ে ততই কে যেন সুরমার অস্তিত্ব কে বলে ” এ পথ হল জীবনের পথ। ফুলে ঢাকা নয়। অপু দুর্গা আসলে প্রতিটি মানুষের জীবন “।