রঘুবীর একজন এমন মানুষ, যিনি সমসাময়িক সমাজের একেবারে ভিন্ন ধারার চিন্তাশীলতার প্রতিভূ। চল্লিশের কোঠায় বয়স, সামান্য ফর্সা গাত্রবর্ণ, চোখে মোটা কাচের চশমা এবং কাঁধে ঝোলানো পুরোনো ব্যাগ—একজন সাধারণ মানুষের চোখে তাকে প্রথমে খেয়ালই করা হয় না। কিন্তু, তার কণ্ঠে যদি শোনা যায় স্বামীজীর কথা, কিংবা জীবন গড়ার জন্য সেই প্রাচীন ভারতীয় দৃষ্টান্তের উদাহরণ, নচিকেতার কথা, তখন লোকেরা থমকে দাঁড়ায়।
রঘুবীরের ভাবনায় সমাজ হলো এক বিশাল শিক্ষাঙ্গন, যেখানে প্রত্যেকে নিজেকে নচিকেতার মতো তৈরি করতে পারে। তিনি বলেন, “জীবন যদি সত্যিকারভাবে সাজাতে চাও, তবে পবিত্রতা ও আত্মশ্রদ্ধার ভিত্তিতে গড়ো। যে জাতি ভয়কে জয় করতে পারে, তাদেরকে আর কেউ রুখতে পারবে না।” তিনি স্বামীজীর কথা উদ্ধৃত করে বারবার বলেন, “weakness is death” – দুর্বলতাই মৃত্যু। এটা তার প্রিয় বচন। যখনই কেউ তাকে সমস্যা নিয়ে আসে, তিনি বলেন, “যদি ছোট্ট নচিকেতা যমের দ্বারে দাঁড়াতে পারে, তাহলে তোমরা ভয় পেয়ে যাবে কেন?”
রঘুবীরের জীবনে অনেক কঠিন সময় এসেছে—মাঝে মাঝে তিনি নিজেই নিজের মধ্যে সেই দুর্বলতার ছায়া অনুভব করেন, কিন্তু তবুও তিনি নিজেকে নচিকেতার মতো ভাবতে বাধ্য করেন। শীতের সকালে তার সাথে রাস্তার ধারে দেখা হলে লোকেরা তাকে প্রশ্ন করে, “দাদা, এই দুর্বলতাকে কীভাবে জয় করব?” তিনি উত্তর দেন, “নিজেকে তৈরি করো, প্রথমেই আত্মশ্রদ্ধা আনো—তবেই ভয়শূন্য হয়ে সামনে এগোতে পারবে।”
রঘুবীরের চিন্তাশীলতা এবং দর্শনশক্তি বাংলা সমাজের অসহায়ত্বের শিকড় গুলিকে দেখিয়ে দিতে চায়। তার মতে, জীবন গড়তে হলে সেই পবিত্রতা ও ভয়শূন্যতার পথেই হাঁটতে হবে—যে পথের ধুলায় যুগে যুগে ভরে উঠেছে অসংখ্য মানুষের পদচিহ্ন।
রঘুবীরের এই চিন্তাধারায় যারা প্রথমে আকৃষ্ট হতো না, সময়ের সাথে সাথে তার কথার গভীরতা উপলব্ধি করে। বাজারের মোড়ে কিংবা পাড়ার চায়ের দোকানে তাকে ঘিরে প্রতিদিন নতুন মুখ দেখা যায়। কেউ একেবারে নিচু গলায় সংসারের অশান্তির কথা বলে, কেউবা কাজের চিন্তা নিয়ে আসে। রঘুবীরের কথা শুনে মনে হয়, তিনি যেন মানুষের মনে আলোর সন্ধান দিতে চান, যা একবার জ্বলে উঠলে আর নেভে না।
তিনি বলেন, “মানুষের জীবনে সমস্যার শেষ নেই, কিন্তু নচিকেতা কি থেমেছিল? সে তো একা, শিশু, অথচ যমের কাছে যাবার সাহস দেখিয়েছিল। আমাদের প্রতিটি সংকটের মধ্যেই রয়েছে সেই চ্যালেঞ্জকে জয় করার মন্ত্র। যমের মুখোমুখি হতে ভয় পায় যে, সে আসলে জীবনের মুখোমুখি হতে ভয় পায়।” এই বলেই তিনি হাসেন—মৃদু, শান্ত হাসি। যেন কোন চরম সত্য নিজেকে হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে।
একদিন বিকেলে, রঘুবীরকে ঘিরে থাকা কয়েকজন উঠতি বয়সী ছেলে তাকে বলে, “দাদা, আমরা তো আপনার মতো করে ভাবতে পারি না। আমাদের চারপাশের জীবন যে একেবারেই অন্যরকম!” রঘুবীর তার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলে, “কেন পারবে না? নচিকেতার মতো হৃদয় আনতে পারবে না কি? হৃদয়ের গভীরে যদি পবিত্রতা থাকে, তবে কোনো পরিস্থিতিই তোমাকে রুখতে পারবে না। দেখো, ভয়হীনতা বলতে শুধুই সাহস নয়—এটা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস, যে বিশ্বাস দিয়ে তুমি নিজেই নিজের শক্তি অনুভব করতে পারবে।” ছেলেগুলো চুপ করে থাকে, যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনছে।
এমনভাবে রঘুবীর আস্তে আস্তে গ্রামে গ্রামে একটি ছোট সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দিতে শুরু করে। মানুষ তার কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজেদের জীবনের মানসিক বাধাগুলো কাটানোর চেষ্টা করে। তার কাছে এসে কেউ শিখছে নচিকেতার সেই ভয়হীনতার পথ, কেউ শিখছে আত্মশ্রদ্ধার মর্ম।
এভাবেই রঘুবীর, নিজের ভেতরের নচিকেতাকে বাঁচিয়ে রেখে একে একে অন্যদের জীবনেও সেই আত্মশক্তি জাগিয়ে তুলতে শুরু করে।
রঘুবীরের এই সাহসী ও গভীর চিন্তাশীল মনোভাব যেন ক্রমে ক্রমে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের আলো হয়ে উঠতে শুরু করে। তার কথা, তার শিক্ষা, সব কিছু যেন গ্রামের মাটিতে ধীরে ধীরে শিকড় গেঁড়ে ফেলেছে। অনেকেই প্রথমে রঘুবীরকে তেমন গুরুত্ব দিত না, ভাবত সে হয়তো কথার ফানুস ওড়ায়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, যে সব লোকেরা সংকট আর হতাশার মধ্যে জর্জরিত ছিল, তারা তার পরামর্শে নতুনভাবে জীবনকে দেখতে শুরু করে।
একদিন হাটের মাঝে দাঁড়িয়ে রঘুবীরকে এক মাঝবয়সী লোক এসে জিজ্ঞেস করে, “দাদা, আমি তো খুব চেষ্টা করছি, কিন্তু দুর্বলতাগুলো কেমন যেন পিছু ছাড়ে না। অনেক সমস্যার সামনে এসে থমকে যাই, তখন নচিকেতার কথা মনে হয় না। কী করব?”
রঘুবীর একটু চুপ করে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর গভীরভাবে বলল, “জানো, দুর্বলতা তোমার দেহে নয়, মনে। নচিকেতা কখনো শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিল না, বরং তার শক্তি ছিল তার আত্মবিশ্বাসে। তুমি ভয় পেলে, সমস্যার পাহাড় আরো উঁচু মনে হবে। কিন্তু একবার ভয় ত্যাগ করতে পারলে, সেই সমস্যাই তোমার সামনে তুচ্ছ মনে হবে। তোমার কাছে কি তোমার বিশ্বাস আছে?”
লোকটি মাথা নীচু করে কিছুটা লজ্জিত মুখে বলল, “বিশ্বাস তো আছে, কিন্তু কোথাও যেন একটু দ্বিধা কাজ করে।”
রঘুবীর হেসে বলল, “তাহলে আর দ্বিধা কিসের? ভয় যদি তোমার শত্রু হয়, তবে আত্মবিশ্বাসই তোমার অস্ত্র। নিজেকে একবার নচিকেতার জায়গায় ভাবো, আর দেখো কি করে সে যমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তুমি যদি নিজের ভেতরের সেই সাহসকে খুঁজে পাও, তবে সব বাধাই সহজ হয়ে যাবে।”
এরপর থেকে সেই ব্যক্তি প্রতিদিন রঘুবীরের কাছে এসে বসে থাকত। গ্রামের আরও অনেক মানুষ তার কাছে এসে নিজেদের দুঃখ-কষ্ট শেয়ার করতে শুরু করল, আর রঘুবীর তাদের জীবনে ছোট ছোট পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিত। কেউ হয়তো জমির ফসল নিয়ে চিন্তিত, কেউ বা সংসারের টানাপোড়েনের মাঝে দিশেহারা। রঘুবীর তাদের কাছে কেবল একজন পরামর্শদাতা নয়, বরং একজন বন্ধু হয়ে উঠল, যে তাদের ভেতরে সেই ভয়হীনতার আলো জ্বালিয়ে দিতে পেরেছে।
রঘুবীরের গল্প এইভাবে ছড়িয়ে পড়তে লাগল গ্রাম থেকে গ্রামে। এক সময় তার কথা শুনতে অন্য গ্রামের মানুষও আসতে শুরু করল। রঘুবীর জানত, নচিকেতার মতো করে জীবন গড়তে হলে সবাইকে নিজের ভেতরের ভয়কে জয় করতে হবে। তিনি প্রতিদিন তাদের মনে করিয়ে দিতেন, “ভয়শূন্য হও, আত্মশ্রদ্ধা রাখো—তবে তোমার জীবনই তোমার জন্য পথ দেখাবে।”
এইভাবে রঘুবীর এক নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার চারপাশে এক নতুন সমাজের ভিত্তি গড়ে তুলতে লাগল, যেখানে প্রত্যেকেই নিজেদের ভেতরে আত্মবিশ্বাস আর ভয়হীনতার আলো খুঁজে পেল।
শেষ বিকেলের আলো যখন গ্রামের আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে, রঘুবীর তখন গ্রামের মাঝখানে এক বটগাছের নিচে বসে একদল মানুষকে স্বামীজীর কথা বলছে। তার কণ্ঠে যেন এক অদ্ভুত শক্তি—একটি অমোঘ টান। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে তার কথা, যেন স্বামীজীর আদর্শ ও সাহসিকতা তাদের মনের গভীরে প্রবাহিত হচ্ছে।
রঘুবীর বলল, “স্বামীজি আমাদের শুধু পথ দেখিয়ে গেছেন তা-ই নয়, তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কেমন করে নিজেদের মধ্য থেকে ভয়কে তাড়াতে হয়। তার চোখে প্রতিটি মানুষ ছিল এক একজন শক্তিমান, সম্ভাবনাময় যোদ্ধা। তিনি বলতেন, ‘যদি কোনোদিন ভয় পেয়ে বস, তবে নিজের ভেতরের শক্তিকে ডাকো, তার কাছে আত্মসমর্পণ করো, দেখবে ভয় নিজেই পালাবে।’ এই আত্মশ্রদ্ধা, এই সাহসিকতা যাকে স্পর্শ করেছে, সে-ই সত্যিকারের মানুষ।”
এ কথা বলার সময় রঘুবীরের চোখে যেন স্বামীজীর সেই অগ্নিময় দৃপ্ততা ফুটে ওঠে। তার কথায় শ্রোতাদের মনে প্রবলভাবে প্রজ্জ্বলিত হয় স্বামীজীর প্রতি ভক্তি, আর তাদের মনে আসে এক অদম্য আগ্রহ—নিজেদের জীবনেও তারা স্বামীজীর আদর্শকে ধারণ করতে চায়। তারা অনুভব করে, এই একজীবনে মানুষের ভয় পেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন নিজের ভেতরের আলোকে জাগ্রত করা।
রঘুবীর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্বামীজী আমাদের শিখিয়ে গেছেন, ‘ভয়ই একমাত্র শত্রু, আত্মবিশ্বাসই একমাত্র বন্ধু।’ তোমরা যদি এই সত্যকে নিজের মনে গ্রহণ করতে পারো, তবে তোমাদের জীবনে আর কোনো শক্তিই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। স্বামীজীর দেখানো পথেই সত্যিকারের মুক্তি, যেখানে মানুষ ভয়হীন, আত্মশ্রদ্ধাসম্পন্ন, আর তার জীবন যেন এক পবিত্র আলোর উৎস।”
তার কথা শুনে উপস্থিত মানুষের হৃদয়ে নতুন করে স্বামীজীর প্রতি ভক্তি আর শ্রদ্ধা প্রবলভাবে জেগে ওঠে। তাদের মনে যেন এক শপথ জাগে—এই জীবনে নিজেরা নিজেরাই গড়ে তুলবে এক নতুন সমাজ, যেখানে কেউই আর ভয়কে কাছে টেনে রাখবে না।