সেদিন সকালে সবে স্নান টান সেরে কারখানায় বেরোতে যাবে ও, বাপটা কোথা থেকে বেরিয়ে এল। রোজ সকালে উঠে কাজে চলে যায়। পয়সা ঘরে দিক বা না দিক কারখানায় বেরোনোতে খামতি ছিল না। আর এতে বাড়ির লোকগুলো ভালো থাকত। তো সেদিন হঠাৎ অসময়ে লোকটাকে দেখে কী রকম যেন একটা ভয় লেগেছিল শিখার। এ এখন কোত্থেকে এল ? একটা বিপদের আশঙ্কা যেন মুহূর্তে ঘিরে ধরেছিল ওকে। তাও আমল না দিয়ে বেরিয়ে আসছে তখনই দেখল শিখা অন্য লোকটাকে। বাপের পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল সে। কালো মোটা ধুমসো চেহারা। একটা চোখ যেন গলে বেরিয়ে এসেছে। আবার বাহারি পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে এসেছে। এক দৃষ্টিতে শিখার দিকে চেয়েছিল লোকটা। “ এ হল নিকুঞ্জ বাবু। খুব ভালো লোক। ” ভ্রু কুঁচকে উঠেছিল শিখার। ভালো লোক। বেশ কথা। তো এখানে কী চায় ? আর এই সাত সকালে কাজে বেরোবার সময় এরকম কেষ্ট ঠাকুর সেজে আসার মানেটা কী? “ নিকুঞ্জ বাবুর তোকে পছন্দ। বাজারে তিনটে দোকান। আরো কত কী? রানী করে রাখবে তোকে বলেছে।” শিখা তখনও বুঝতে পারে নি যে ওর বাপ ওকে বেচে দেবার চেষ্টা করছে। তাই এক কথায় স্পষ্ট বলে দিয়েছে “ আমাকে ? কেন ? আমার রানী হবার দরকার নেই। ” “ কেন নয় ?” এবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে ওর এখনকার মা। যে কিনা প্রায় ওরই বয়েসী। “ দু হাত দিয়ে টাকা ঢালছে লোকটা? কেন দরকার নেই ? কী এমন বিদ্যেধরী তুই যে ওকে তোর মনে ধরছে না।” ব্যাপার দেখে স্তম্ভিত শিখা। এরা স্বামী স্ত্রী কখন তলায় তলায় এক হয়ে ওকে বেচে খাবার মতলব করছে ও তো জানতেই পারে নি। কাল অব্দি তো ওই মেয়ে মানুষটা ওর কথায় চলত। এই একদিনে পাল্টে গেল ! কিন্তু মতলব যাই হোক নিজেকে বাঁচাতে গেলে রুখে দাঁড়াতে হবে। নইলে এরা পেয়ে বসবে। “ তোমাদের মতলব টা কী ? কী চাও? কী বলতে এসেছে ওই লোকটা?” গতিক দেখে ওর বাপ বুঝে গেছে এ মেয়েকে ভয় দেখিয়ে বা সোজা কথায় হবে না। বরং বুঝিয়ে বলল হয়ত বুঝবে। “ নিকুঞ্জ বাবু তোকে রাখতে চায়। বাজারের কাছে একটা গোটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। ঝি চাকর রেখে দেবে। তোকে কুটিটি নাড়তে হবে না। টাকা পয়সা , সোনা গয়না, শাড়ি জামা কিছুর অভাব হবে না।” “ রাখতে চায় ? মানে পোষা বেশ্যা ?” রাগে চিৎকার করে ওঠে শিখা। বাপটা ধমকে কুঁকড়ে গেলেও হাঁ হাঁ করে ওঠে নিকুঞ্জ ঘোষ। “ না না। সেকি ! বিয়ে করা পরিবারের মত থাকবে তুমি। কিচ্ছু অভাব রাখব না। তোমার বাবার দেনাও আর কিছু থাকবে না। ” “ ও। আমায় বেচে দেনা শোধ করবে? তো বেশ তো বাজারের বাড়িতে কেন নিজের বাড়িতে নিয়ে তোল আমায় নিকুঞ্জ বাবু। বিয়ে করে নিয়ে চল। তাতে আমি রাজি। কি করবে বিয়ে?” জোঁকের মুখে নুন পড়ার মত চুপসে যায় নিকুঞ্জ ঘোষ। বাড়িতে তার বিয়ে করা পরিবার। ছেলে মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। প্রতিষ্ঠিত লক্ষী নারায়ন। নিত্য সেবা হয়। সেখানে এই বস্তির মেয়েকে তুলবে কী করে? আর ছেলে মেয়ে বউ সবার সামনে মুখ দেখাবেই বা কী করে? এবার সোজাসুজি শিখার বাপের দিকে তাকায় ও। এরকম কথা তো ছিল না। লোকটা বলেছিল মেয়ে ওর কথায় ওঠে বসে। ভীষন বাধ্য। ওর এক কথাতেই রাজি হয়ে বাজারের ঘরে এসে বসবে। রোজ রাত্রি গুলো সুখে কাটিয়ে সকালে আবার নিজের ঘরে ফিরে যাবে নিকুঞ্জ ঘোষ। ঘরে সব ঠিক রইল। আর ওরও নিজের সুখ টুকু ভোগ করা হল।এখন তো দেখছে উল্টো। এ মেয়ে তো সোজা মেয়ে নয়। আর ও নিজেও কেমন বেকুব। এই লোকের কথায় বিশ্বাস করে এতগুলো টাকা ধার দিয়েছে লোকটাকে ! আফশোষে তখন হাত কামড়াচ্ছে নিকুঞ্জ ঘোষ। শুনতে শুনতে এইখানে বাধা দিয়েছে সুখেন। “ যদি সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাইতো ? তখন কী করতে?” তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে শিখা। ওসব লোক হল কেঁচোর মত। দম আছে নাকি এদের? এরা জানে চোরের মত মেয়েদের সম্মান নিতে। বাড়িতে বিয়ে করা বউ রেখে বাইরে ফুর্তি করতে। এদের মুখের সামনে শুধু রুখে দাঁড়াতে হয়। তাহলেই এরা ভয় পেয়ে যায়। ওর মুখের দিকে চেয়ে শুকনো গলায় সুখেন শুধু বলতে পারে, “ তারপর ?”
মুগ্ধতা