মণিদীপা…… আচ্ছা এখানে মহিতোষ মুখার্জী (মারা গেছেন) ওঁনার স্ত্রী মহিমা মুখার্জী,হাই স্কুলের হেড মিস্ট্রেস ছিলেন রিটায়ারমেন্ট করে গেছেন ,কোন বাড়ীতে থাকেন বলতে পারেন ? জনৈক ভদ্রলোক….. ওনার স্বামী কি করতেন ? মণিদীপা…… উনি প্রথম জীবনে কেন্দ্রীয় সরকারি ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন l এয়ার ফোর্সের অফিসার ছিলেন l রিটায়ারমেন্টের পর মহকুমা শাসকের (SDO অফিস) অফিসে চাকরি করতেন l জৈনিক ভদ্রলোক….. আচ্ছা গ্রামের নাম টা বলতে পারবেন ? মণিদীপা…. বিবেকানন্দ নগর , পুরুলিয়া l জনৈক ভদ্রলোক….না, আমি তো ওনার সন্ধান দিতে পারলাম না l আপনারা আর একটু এগিয়ে দেখুন l মণিদীপা….. ঠিক আছে l আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেও হদিস করতে না পেরে ওরা হতাশ হয়ে পড়ে l এবার ভাবনা এসে যাচ্ছে যে হয়তো পাওয়া যাবে না l খুঁজতে খুঁজতে অনেক বেলা হয়ে গেছে l মণিদীপা প্রায় ত্রিশ- পঁয়ত্রিশ বছর পর পুরুলিয়া এসেছে l সেই ছোট্ট বেলায়, পাঁচ ছ বছর বয়সে পুরুলিয়া ছেড়ে চলে আসে কলকাতার নারকেল ডাঙ্গা অঞ্চলে l তারপর আর ওখানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি l পুরুলিয়ার স্মৃতি প্রায় ঝাঁপসা হয়ে এসেছে l তা ছাড়া আজকাল সর্বত্রই পরিবেশের আমূল পরিবর্তন হয়েছে l আর পুরুলিয়ার যেই অঞ্চলটায় মণিদীপারা থাকতো অর্থাৎ যেখানে মনি মা.. মহিমা মুখার্জী এখনো থাকেন বলে মণিদীপার মনে হচ্ছে .. সেই অঞ্চলটারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে l দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই l আগের সঙ্গে কিছুই মেলানো যাচ্ছে না l রাস্তা ঘাট সব পাল্টে গিয়ে বিরাট বিরাট চওড়া রাস্তা হয়েছে l এবড়ো খেবড়ো মাটির পথের আর দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না l বাড়ী ঘর গুলো আর আগের মত ছোট ছোট নেই l গগন চুম্বী বাড়ী হয়েছে l নতুন নতুন দোকান পাট হয়েছে l প্রত্যেক বাড়ীর নীচেই দোকান, মল হয়েছে l প্রত্যেক দোকানে নিয়ন আলোর রোশনাই l হোটেল রেস্টুরেট এ ঝিকঝাক নানা বাহারি আলো জ্বলছে নিভছে l সে এক মায়াবী পরিবেশ l সবুজ গাছ পালার চিহ্ন মাত্র আর নেই l পুকুর ডোবা খানা খন্দ কিছুই নেই l পুরোপুরি নতুন এলাকা বলে মনে হয় l পরিবর্তন হয়েছে মণিদীপারও l সেই ছোট্টো পাঁচ ছয় বছরের খুকুমণিটি সে আর নেই আজ l মনিমাদের পাশের বাড়ীতেই থাকতো মণিদীপারা l সেই সুবাদে মণিদীপা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতো মনিমাদের বাড়ী l সকাল বেলা মনি মা স্কুলে যাবার আগে মণিদীপা একবার মনিমার ঘরে এসে মনিমার সাথে দেখা করবেই করবে l ফর্সা ছিপছিপে একটু রোগাটে গরণের মিনি (মণিদীপা) মনিমার ঘরে এসে কাতর স্বরে মনিমা বলে ডাক দিত l ঐ ডাকটার জন্য মনিমাও অপেক্ষা করে থাকত l ভীষণ ভাল লাগত ঐ ডাকটা শুনতে l যতক্ষণ মনিমা বাড়ী থাকবে মিনি ততক্ষন মনিমার চার পাশে ঘুরঘুর করবে l সব সময় ফুরফুরে চনমনে ভাব থাকতো মিনির মধ্যে l দুজনের মধ্যে কোনো রক্তের সম্পর্ক বা আইনগত আত্মীয়তা কিছু ছিলো না l জাস্ট প্রতিবেশি l কিন্তু অন্তরের টানটা এতো গভীর ছিলো যে তাকে কোন আত্মীয়তা দিয়েই বেঁধে ব্যাখ্যা করা যাবে না l এই জন্যই বলে যে স্নেহ ভালোবাসার মধ্যে কোনো শর্ত থাকে না l প্রত্যেক পুজোয় মনিমা মিনি কে নুতন জামা কাপড় দিতো l আর ঐ টা পরে ঘুরে বেড়াতে মিনির ভীষণ ভালো লাগত l মনিমার নিজের কোন সন্তান নেই l একটা ভাইঝি আছে l মানে দেয়োরের মেয়ে l পাশের বাড়ী থাকতো l সেও মিনির বয়সী l আজ সে প্রায় মধ্য বয়সী l স্বামী আর কন্যা নিয়ে মনিমার সংসারে থাকে l একটু একটু করে সোহাগ দেখিয়ে সব সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে মনিমার l বাড়ীটা নিজের নামে করে নিয়েছে l বেশ কিছু ফিক্সড ডিপোজিট ছিলো সেগুলো সব মনিমার সাথে জয়েন্ট নামে করে নিয়েছে l পেনশন একাউন্টে নমিনেশন করে নিয়েছে l দুটো পেনশন একাউন্ট l একটা মনিমার নিজের আর একটা মনিমার ফ্যামিলি পেনশন l নিজের বলে আর কেউ নেই তাই তিনি এই ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছেন l সেই ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার পাঁচ ছয় বছর বয়সের মিনি আর আজকের মণিদীপার মধ্যে আসমান জমিন ফারাক l কৈশোর যৌবন পেরিয়ে আজ সে প্রায় মধ্য বয়স্কা l তবে এখনো যৌবনের জৌলুস একেবারে নিষ্প্রভ হয়ে যায় নি l চোখে মুখে শরীরের অঙ্গে প্রত্যঙ্গে অস্ত রাগের সূর্যের লাল উজ্জ্বল আভার মতো স্বগৌরবে প্রকাশ পাচ্ছে বলিষ্ঠ যৌবন রেখা l হাঁটা চলায় কথা বার্তায় আচার ব্যবহারে ঝড়ে পড়ছে আভিজাত্যের পরশ l তাই সেই দিনের মিনির মধ্যে আজকের মণিদীপাকে খুজে পাওয়া খুব কঠিন l অবশেষে মণিদীপা আর তার স্বামী খুজে পেলো মনিমাকে l মণিদীপার ইচ্ছা করছিলো ছুটে গিয়ে মনিমার কোলে আছড়ে পরে কিন্তু মনিমাকে যেই অবস্থায় সে দেখতে পাচ্ছে তাতে আঁতকে ওঠার মতো অবস্থা l কিছু বুঝে উঠার আগেই অভাগী মায়ের স্নেহের পরশ ঝোড়ে পড়ছে, বাঁধ ভাঙা চোখের জলই তার প্রকাশ l সন্তান সেই জলের ধারা মুছিয়ে দিতেই জননীর অন্তর ডুকরে কেঁদে ওঠে l সন্তানও মায়ের আঁচল পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পরে l মায়ের আঁচল যে সন্তানের জন্য কতটা স্বস্থির সেটা বলে বোঝানো যায় না l ঐ আঁচলটা এমন একটা ঢাল যেটা পৃথিবীর সব আঘাত থেকে সন্তানকে রক্ষা করতে পারে l জীবন যতটা গভীরে প্রবেশ করলে অনুভূতির ছোঁয়া পাওয়া যায় সেটাই ঘটেছে এক্ষেত্রে l এ যে কি দৃশ্য!!সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না l শুধু অনুভব করা যায় l সব অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না l কিছু কিছু বুঝে নিতে হয় l নতুন করে পরিচয় পর্ব সেরে যখন নিশ্চত হওয়া গেলো যে হ্যাঁ এই সেই মিনি আর এই সেই মনিমা, তখন মনিমা কম্পিত স্বরে বিস্তারিত ভাবে তার শোচনীয় অবস্থার কথা বললেন তার স্নেহের মিনিকে l মনিমা এখন উঠে দাঁড়াতে পারে না l তার ডান পায়ে বাতের ব্যাথা দীর্ঘদিন ধরে তাকে পঙ্গু করে রেখেছে l ডাক্তার দেখানো হয়েছে l ডাক্তার বাবু নাকি বলেছেন ওনার এই ব্যাথা কোন দিনই সারবে না l যত দিন উনি বাঁচবেন ওনাকে শুয়ে শুয়েই জীবন কাটাতে হবে l এই দুশ্চিন্তা আর হতাশা তার জীবনী শক্তিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে নিয়েছে l জানা গেলো যে ভাই ঝি ওনাকে একদম ভালো করে খেতে পড়তে দেয় না l এমন সব খাবার দেয় যা মনিমার মুখে বিস্বাদ লাগে এবং অপুষ্টিকর l ঐ খাবার না খেলে ভীষণ গালি গালাজ করে l তাই ভয়ে ভয়ে খেয়ে নিতে হয় l ভালো করে ট্রিটমেন্ট করায় নি l ওষুধ পত্তর ঠিকঠাক মত খাওয়ায় না l অনাদর অবহেলার জীবন l আর এতো সবের ফলে মনিমা আজ মৃত্যু পথের যাত্রী হয়ে পড়েছে l জীবনটা ধূসর বিবর্ণ হয়ে গেছে l চরা পরে শুখিয়ে যাওয়া নদীর মত অবস্থা l জীবনের প্রতি তার বিদ্বেষ এসে গেছে l বাঁচার ইচ্ছা হারিয়ে গেছে মন থেকে একেবারে l মিনি আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না l সে আর এক মুহুর্তও মনিমাকে পুরুলিয়াতে রাখতে চায় না l সে কোলকাতায় তার পাড়ার কাউন্সিলরকে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করে ফেললো l মনিমা প্রথমে আসতে চাইছিলেন না পরে মেয়ে-জামাইয়ের পিরাপীড়িতে কোলকাতায় চলে এলেন l ভাইঝি অনেক করে বাঁধা দিয়ে ছিলো যাতে ওনাকে কোলকাতায় নিয়ে না যেতে পারে l তাহলে সব কীর্তি ফাঁস হয়ে যাবার ভয় আছে l কিন্তু তার শেষ রক্ষা হলো না l কলকাতার বাগুইআটিতে মেয়ে-জামাই থাকে l মনিমাকে সেখানেই এনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে l ফুল বাগানে একটা বেসরকারি নার্সিংহোমে এক জন ভালো অর্থোপেডিক ডাক্তার আছেন l ওনাকে দেখানো হলো l ডাক্তার বাবু ভাল করে দেখে শুনে কয়েকটা ওষুধ দিলেন, কয়েকটা টেস্ট দিলেন l আর বললেন যে একটা অপারেশন করাতে হবে l তাতে স্টিলের পাত বসাতে হবে ওনার পায়ে l মোটামুটি মাস দুয়েকের মধ্যে উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন আশা করি l প্রায় সারে তিন লাখ টাকার মতো খরচা আছে l মিনি এবং তার বর রাজি হয়ে গেলো ট্রিটমেন্ট করাতে l একটা হুইল চেয়ার কেনা হলো মনিমার জন্য l প্রতি দিন নিয়ম করে টাটকা ফল ও গরম গরম খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে l এই সবের ফলে মনিমার জীবনের স্বাদ পাল্টাতে শুরু করেছে l জীবনের ধারণা আত্মীয়তার ধারণা পাল্টানো শুরু হয়েছে মনিমার মধ্যে l নতুন করে বাঁচার ইচ্ছা জাগছে একটু একটু করে l প্রাণের সারা পাচ্ছেন l এই পরিবর্তন আসলে আত্মার সাথে আত্মার মেলবন্ধনের ফসল l এর থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে আত্মীয়তা আনে আত্মার বন্ধন l যথা দিনে যথা সময়ে মনিমার অপারেশন হলো l তিন দিন নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন l তারপর মণিদীপাদের বাগুইআটির বাড়ীতে থেকেই মণিদীপার সেবা সুশ্রষা পেয়ে ধীরে ধীরে সেরে উঠলেন মনিমা l মনিমা আর পুরুলিয়ার বীভৎস নরক পুরীতে যেতে চাইলেন না l এর পরের লড়াই শুরু হয়েছিল সম্পত্তির দখল নিয়ে l পুরুলিয়ার ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিসে যে সব ফিক্সড ডিপোজিট আছে সেগুলো আনা নিয়ে লড়াই চালাতে চাইলেন মনিমা l মণিদীপা এবং তার বরের ইচ্ছা ঐ সব সম্পত্তির পিছনে আর দৌড়ানোর কোনো দরকার নেই l যা গেছে তার মায়া বাড়িয়ে আর কাজ নেই l পেনশন হিসাবে যে টাকাটা মাসে মাসে পাওয়া যায় তাতেই যথেষ্ট চলে যাবে l কিন্তু মনিমার হকের টাকা তাই সেটা ছেড়ে দিতে মন মানছে না তার l আর যে ভাইঝি তাকে যন্ত্রনা দিয়ে মেরে ফেলে সব আত্মসৎ করতে চেয়েছিলো তাকে ছেড়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই l কিছু জমি সে আগেই একটা নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দানপত্র করে দান করে দিয়ে দিয়েছিলেন l সেটা একটা ভালো কাজে লেগেছে l কিন্তু বাকি জমি বাড়ী ঐ ভাইঝিকে ছাড়তে মন চাইছে না l কিন্তু সেটা আদায় করার জন্য মামলা মকোদ্যমা করা অনেক ঝঞ্ঝাট l মেয়ে জামাই তাকে বোঝালো যে ঐ সব ঝক্কি ঝামেলা না বাড়িয়ে পেনশন নিয়ে সুস্থ ভাবে জীবন কাটানোই ভালো l কিন্তু মনিমা ভাবছেন মিনি ও তার বরের পকেট থেকে প্রায় চার লাখ টাকার বেশি খরচা হয়ে গেছে সেই টাকাটা রিটার্ন দেবার কথা l মণিদীপা….. মনিমা তুমি নির্দ্বিধায় এখানে থাকবে l কোনো টাকা পয়সা ফেরত দেবার দুশ্চিন্তা তোমাকে করতে হবে না l আমাদের যা রোজগার তাতে আমাদের সাথে তোমারও দু মুঠো অন্ন জুটবে l আমি এক মাকে জন্ম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে আর এক মাকে পেয়েছি সেটাই আমার পরম পাওয়া l টাকা পয়সা আমাদের দরকার নেই l মনিমা…… হ্যাঁ রে মা এতো দিনে জানলাম আপন জন কাকে বলে l এই জানা জীবন দিয়ে জানা l এই জানা আর ভুল হবার নয় l গর্ভে ধারণ না করেও যে সন্তান আমি পেয়েছি বহু লক্ষ জননী গর্ভে ধারণ করেও তা পায় না l কারো স্পর্শে মানুষ জীবনী শক্তি ফিরে পেয়ে নতুন করে বাঁচতে চায় আবার কারো স্পর্শে মানুষ মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে চায় l পৃথিবীতে মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী তাই জীবন অমূল্য l জীবন পেয়েও যদি জীবনকে জীবন্ত করে তোলার চেষ্টা থেকে বিরত থাকা হয় তবে সেটা জীবনকে অবহেলা করার সমান হয় l প্রত্যেকটা জীবনেরই তার নিজস্ব ধারায় বয়ে যাবার অধিকার আছে l সেটা থেকে যদি তাকে বিরত করা হয় তবে সেটা জীবনের গতিকে রুদ্ধ করা হয় l জীবন বৈচিত্রময় l প্রাপ্তি আর আপ্রাপ্তির খেলা নিরন্তর মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায় l মানুষ ইঁদুর দৌড়ের মত দৌড়ে বেড়ায় প্রাপ্তির নেশায় l তবে কিছু মানুষ আছেন তারা প্রাপ্তি-আপ্রাপ্তির মধ্যে না ঢুকে জীবনকে খুঁজে বেড়ান জীবনের মধ্যে l