ঘরের বাইরে থেকে হাঁক পাড়লেন সুনন্দা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অপটু হাতে লাল সাদা ঢাকাই শাড়িটা গুছিয়ে পরার চেষ্টা করছিল তৃণা। শাড়ি পরার অভ্যেস কোনকালেই নেই। বিয়ের আগের দিন অব্দি ম্যাক্সি, সালোয়ার কামিজ, জিন্স পরে এসেছে।এ বাড়িতে এসেও সেটা যে বহাল নেই তা নয়। শাশুড়ি পোশাক নিয়ে অন্য সময় কিছু বলেন না। শুধু পুজোআর্চার দিনে কঠোর সুনন্দা। শাড়ি পরতে হবে। এই ছ’মাসে এটাই দেখেছে তৃণা। আজ ষষ্ঠী। বিয়ের পর ওর প্রথম পুজো। শাশুড়ির সাথে মন্দিরে পুজো দিতে যেতে হবে।সকাল থেকে তারই প্রস্তুতি চলছে। জোগাড়যন্তর অবশ্য সুনন্দা একাই করেছেন।ওসবে কাউকে হাত লাগাতে দেন না। শুধু এক গা গয়না পরে সেজেগুজে লক্ষী বৌটি হয়ে সঙ্গে যাওয়া।নতুন শাড়ি! ফসফস করে খুলে যাচ্ছে। ওদিকে বাইরে থেকে ক্রমাগত তাগাদা! কী ঝকমারি রে বাবা! এইসব মন্দির টন্দিরে যেতে একেবারেই ভালো লাগে না ওর। বাপের বাড়ি থাকতে এসব বালাই ছিল না। এখানে এসে প্রথম দিন দেখা থেকেই বিতৃষ্ণা। জল,ফুল কাদায় মাখামাখি গোটা মন্দির চত্বর, বিশ্রী ভীড়, গাদাগাদি! সুনন্দাকে অবশ্য লাইন দিতে হয় না। ওই মন্দিরের প্রধান সেবায়েত এ বংশের গুরুদেব। তারই সুবাদে ভি. আই. পি কোটায় পুজো দেন সুনন্দা। একা পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে বিগ্রহ স্পর্শ করে। তবুও ভালো লাগেনি তৃণার। মন্দিরে ঢোকার মুখে সারি সারি ভিখিরি। মুখে অনাহার, অর্ধাহারের ছাপ স্পষ্ট। তারই মধ্যে দিয়ে সুনন্দা যখন হাতে ওই ফল,মূল, মিষ্টির বিশাল ডালা নিয়ে রাজেন্দ্রানীর মত সেজে মন্দিরে ঢোকেন — কেমন যেন লজ্জা লাগে ওর। দু এক বার সুপ্রিয়কে বলেছে ওর এই অনিচ্ছার কথা। করুন চোখে চেয়েছে সুপ্রিয়,
” এটুকু মানিয়ে নাও প্লিজ। তোমার কোন ইচ্ছায় তো মা বাধা দেন না। তুমি এটুকু কর। “
কথাটা সত্যি। মানতে বাধ্য তৃণা। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন অভিযোগই নেই ওর। একমাত্র ছেলে বলে কোন আতুপুতু করা নেই সুনন্দার। বরং বেশ স্পষ্টবাদী, — স্বচ্ছ মনের মানুষ বলেই মনে হয়েছে । শুধু এই একটা ব্যাপারেই মাত্রা ছাড়া।পুজো আর্চা করেন ঠিক আছে। কিন্তু সব যেন অতিরিক্ত। প্রত্যেক সপ্তাহে মন্দিরে পুজো দেওয়া, প্রতি পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ, মাসে একবার গুরুসেবা — মানে লেগেই আছে।
” বৌমা —“
” এই যে মা —- ” , সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তৃণা।
লাল সাদা ঢাকাই শাড়ি, গা ভরা সোনার অলংকার, কপালে লাল টিপ আর সিঁথিতে জ্বলজ্বলে সিঁদুর। পুত্রবধুর সাজ যে পছন্দ হয়েছে তা শাশুড়ির চোখ দেখেই আন্দাজ করে নেয় তৃণা।
রাশিকৃ্ত ফল মিষ্টির সঙ্গে স্তূপাকার জামা কাপড়ের প্যাকেট। এ সব ওই গুরুভাইদের জন্য। এসব দিকে অকৃপণ হাত সুনন্দার । এই সেদিন মন্দিরের লাগোয়া আটচালাটা পাকা করে দিলেন। তার দু মাস আগেই ঠাকুরের মাথার রুপোর মুকুট। জন্মাষ্টমী তে গোপালের রুপোর বাঁশি।
চোখ ফিরিয়ে পাশের দিকে চায় তৃণা। দামি লাল পেড়ে গরদের শাড়ি, লাল ভেলভেট ব্লাউজ, গলায় মোটা বিছে হার, হাতে বেশ কয়েকখানা সোনার চুড়ির সঙ্গে মকরমুখী মোটা বালা, কপালে জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ। দু চোখ বোজা । হাত জোড় করা। ঠোঁট নড়ছে মৃদু । সম্ভবত গুরুনাম জপ করছেন সুনন্দা। সারা মুখে ভক্তি, আবেগ যেন মাখামাখি। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বাইরের দিকে চায় তৃণা। ইনি সুপ্রিয়র মা। চোখের সামনে মুহুর্তেই নিজের মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে ওর। এখন ক’টা? সাড়ে নটা? মা এতক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে।বাবা অফিসে বেরোবার পর বাকি কাজগুলো ঝড়ের গতিতে সেরে নেয় মা। তারপর শুধু ছোটা আর ছোটা।এই বস্তি থেকে সেই বস্তি — এক এন.জি.ও থেকে অন্য এন.জি.ও। কতকিছুর সাথে যে নিজেকে জড়িয়েছে দেখে অবাক লাগে তৃণার! এক এক সময় বলেও,
” কমালে চলবে কি করে রে ? ওদের জন্য করার লোক এমনিতেই বড় কম যে —“
“ মোটেই না। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এসব করার অনেক লোক বেড়েছে। তুমি জানো না। ”
মা হাসে। “ তার মধ্যে ক’জন প্রকৃত কাজ করে রে ? আর ক’টা মানুষই বা উপকার পায় ? আসলে সবই – ” বাকিটা আর উচ্চারণ করে না মা। শব্দহীনতায় ডুবে যায় কণ্ঠস্বর।
ভাবলেই একটা অদ্ভুত মমতা আর ভালো লাগায় ভ’রে ওঠে ভেতরটা। বিয়ের আগে রাতে খাবার টেবিলে বসে গল্প হোত চারজনের। হ্যাঁ। ঠাকুমাও সঙ্গ দিত। সারাদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলত মা।
এক একটা জীবন যেন এক একটা কাহিনী। গল্পের মত। এই জীবনকে, এই কাহিনীকে, এই মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছে মা। মন্দিরে গিয়ে একগাদা পয়সা খরচ করে পুজো দেওয়া কোনদিন ছিলনা মা’র। বরং আশেপাশের গরীব বাচ্চাদের জামা কাপড় , বই খাতা কিনে দেওয়াটাই বেশি পছন্দের ছিল চিরকাল। ঠাকুমার ব্যবহার ছিল আরো অদ্ভুত! যে মানুষ ঠাকুর ঘরকেই মোক্ষ বলে মনে করেছেন সেই মানুষই কিন্তু কখনো মাকে গণ্ডীর মধ্যে বেঁধে রাখতে চাননি। মা’র এসব সমাজ সেবা টেবার পাগলামিতে ঠাকুমার গোপন মদত ছিল যথেষ্ট। মাকে বাধা দেওয়া দূরের কথা উল্টে নিজের সঞ্চিত তহবিল ভেঙে টাকা তুলে দিতেও দেখেছে তৃণা।
বাবা তো এক এক সময় বেশ রাগই দেখাতো “শাশুড়ি বউ মিলে যা দানছত্র খুলেছো __ এবার আমাকে না দেউলিয়া খাতায় নাম লেখাতে হয়। “
এ বাড়ির পরিবেশ পুরো উল্টো। সুনন্দা যে মানুষ খারাপ এ কথা বলতে পারেনা ও। কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না কিন্তু নিজের ইচ্ছেটাও স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেন। আর সেটাতে এতটাই প্রাবল্য থাকে যে কোন মতেই এড়ানো যায় না। এই যেমন পুজোর বাজারের ব্যাপারটাই । মনের সুখে কেনা কাটা করেছেন সুনন্দা। আশ মিটিয়ে বাজার করেছেন ছেলের বউয়ের জন্য। শাড়ি, সালোয়ার, কুর্তি — কিছু বাদ নেই। অথচ সব সময়ের কাজের লোক লক্ষীদির জন্য শুধু একটা তাঁতের শাড়ি। তৃণার ইচ্ছে ছিল ওর নিজের পাওনা থেকেই একখানা ভালো শাড়ি দেয়। গাদাগুচ্ছের তো আছে। স্পষ্ট না করে দিলেন সুনন্দা। তৃণার হাজার অনুরোধেও মত দিলেন না। না তো না। এরকমই সুনন্দা। রাশি রাশি টাকার জামা কাপড় কেনেন। বন্ধু বান্ধবী আত্মীয়স্বজনকে উপহার দেন অথচ বাসন মাজে অনিতাদি তার ছোট্ট মেয়েটার জন্য একটা জামা কেনেন না। বলতে গেলেই বলেন
এই যে মন্দিরে যান আসেন নিজের ইচ্ছায় কখনো একটা পয়সা তুলে দেন না গেটের কাছে জড়ো হয়ে বসে থাকা ওই বুভুক্ষু মানুষগুলোর হাতে। হাত পেতে সামনে দাঁড়ালে ফেরান না অবশ্য।
সিটের মধ্যে জড়ো হয়ে থাকা একরাশ নতুন কাপড় চোপড়ের প্যাকেট গুলোর দিকে অলস চোখে তাকায় তৃণা। এসবে কত উদার , অকৃপণ সুনন্দা। অথচ এর থেকে মাত্র কটা টাকা খরচ করলেই —
যাক আর ওসব ভেবে কী লাভ ? এই জন্যেই আসতে ইচ্ছে করে না ওর। ওই একপাল ক্ষুধার্ত মানুষের মধ্যে দিয়ে এইভাবে ঐশ্বর্যের বাহার দেখিয়ে যেতে নিজেকে ছোট লাগে ভীষণ !
একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে সামনে তাকায় ও। নামতে হবে এবার। গাড়ি থেমেছে মন্দিরের গেটের সামনে। ফল মিষ্টির ডালা গুলো নিজের হাতে
নিয়েছেন সুনন্দা। জামা কাপড়ের প্যাকেট তৃণা। কাল রাতে তুমুল বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তাটার দিকে চেয়ে বিরূপতায় ভেতরটা ছেয়ে যায় ওর।কাদা জলে মাখামাখি। কয়েকটা ইঁট কেউ পেতে রেখেছে দয়া করে। তার ওপর দিয়েই চলছে পারাপার। শাড়ির কুঁচিটা একহাতে ধরে , প্যাকেট গুলো বগলদাবা করে কোনরকমে সাবধানে রাস্তাটুকু পার হ’ল তৃণা। এবার সুনন্দা। উৎকন্ঠিত চোখে তাকায় তৃণা। ভারী শরীর। হাতে ওই স্তূপাকার ফল মিষ্টির ডালা! সামলে আসতে পারলে হয়। কিছুতেই ড্রাইভার অনন্তদাকে ধরতে দেবেন না ডালাটা। কী যুক্তি ? না ও ব্রাহ্মণ না। বোঝ ! একে কী বলা যায় ! বাবা তো শুনলেই হাসতে শুরু করবে। মা এখনও প্রতি বছর আকবর মামাকে ফোঁটা দেয়। জানলে তো সুনন্দা মুচ্ছো যাবেন ! কী অদ্ভুত ! দুটো মানুষ ! সম্পূর্ণ পৃথক দুটো ভাবনা ! একজন যখন ঠাকুর ঘরে পাথরের মুর্তিকে নাওয়াচ্ছেন, ধোওয়াচ্ছেন, পঞ্চ ব্যঞ্জন রেঁধে সামনে ধরছেন — আরেক জন তখন ছুটে বেড়াচ্ছেন বস্তিতে বস্তিতে কতগুলো অর্ধ উলঙ্গ, অনাহারী বাচ্চাদের ভরণ পোষণের জন্য —- হাত পাতছেন সম্ভাব্য অসম্ভাব্য জায়গায়। ছোট থেকেই —
” বৌদি __”
অনন্তদার আর্ত চীৎকারে চমকে তাকায় তৃণা। আর সঙ্গে সঙ্গেই শিউরে ওঠে ও। যা ভয় করছিল ঠিক তাই । টাল সামলাতে না পেরে আছাড় খেয়ে পড়েছেন সুনন্দা। ডালা ভরা স্তূপাকার ফল মিষ্টির প্যাকেট চারদিকে ছড়িয়ে ছত্রখান। দামী গরদের শাড়ি, ব্লাউজ কাদায় মাখা মাখি।
কয়েক মুহুর্ত । আড়চোখে সামনের দিকে চায় তৃণা । না ওর দিকে নজর নেই কারুর। সবাই সুনন্দাকে নিয়েই ব্যস্ত। আর দেরী করে না ও। উদভ্রান্তের মত হাতের জামা কাপড়ের প্যাকেট গুলো মন্দিরের পাশে বসে থাকা মানুষ গুলোর পাশে রেখে দিয়ে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শাশুড়ির হাত।
” ইস্ ! কী হল বলতো ! এত সব নিয়ে তুমি কি পারো ? বললাম অনন্তদার হাতে দাও —- ওঠো ওঠো।”
অনন্ত আর পুত্রবধূর হাত ধরে আবার গাড়িতেই ফিরে যাচ্ছেন সুনন্দা। খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন গুরু ভাইরা। এমনকি গুরুদেব স্বয়ং ! কোন চিন্তা করতে নিষেধ করেছেন ।এখনও তিথি অতিক্রান্ত হয় নি। বাড়ি গিয়ে আবার তৈরি হয়ে আসুন সুনন্দা। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পুজো করিয়ে দেবেন। মায়ের বোধনের এখনও ঢের দেরী।
না। হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাপড় চোপড়ের প্যাকেট গুলো আর তৃণাকে কুড়োতে নিষেধ করেছেন সুনন্দা। থাক ওসব। বাধা পড়েছে যখন। বরং বাড়ি ফিরে একটা কাজ করতে হবে তৃণাকে। সুনন্দা যখন স্নানে ঢুকবেন অনন্তকে নিয়ে নতুন করে সব আবার কিনে আনতে হবে ওকে। পারবে না তৃণা ?
মুখের দিকে তাকিয়ে খুঁজছিল তৃণা। কিছু বুঝেছেন কি সুনন্দা ? ধরে ফেলেছেন কি ওর ইচ্ছে ক’রে জামাকাপড়ের প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনাটা? বোধহয় না। ও মুখে এখন শুধু আশা ভঙ্গের বেদনা।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিচ্ছে অনন্তদা। জানালা দিয়ে গেটের দিকে তাকায় তৃণা। কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে ওখানে। মিষ্টির প্যাকেট ছিঁড়ছে ফটাফট, আপেল ,লেবু, কলা, শসা মুখে উঠছে পটাপট —- ও মা ! এরই মধ্যে প্লাস্টিক খুলে নতুন জামা গায়ে দিয়ে দিয়েছে একজন ! মরি মরি ! কালো মুখে হাসি বুঝি আর ধরেনা ! ও হাসি না আলো ! নাকি দুইয়ে মাখা মাখি ! ঠাহর করতে পারেনা তৃণা।
শুধু এটুকু বোঝে পাঁজি যাই বলুক — সময় নির্ঘণ্ট যে বিধানই দিক —- তিথি থাকুক বা না থাকুক
আগেও পড়েছি, আবার ও পড়লাম … মুগ্ধতা !!!