আপ লোকালটা ঢুকবে ভোর সাড়ে পাঁচটাতে। তখন এই স্টেশন লোকে লোকারণ্য। একে তো ছোট্ট সরু প্লাটফর্ম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসবে মানুষের ঢল। আর বিন্দে তখন গুরাকু মাজা কালো দাঁতে হাসবে। গরম গরম লুচি আর আলুর দম খাবার খদ্দের বলে দেখে যা। তারপর শয়তান ভ্যান চড়ে চলে যাবে যে যার কাজে। কেউ তো আর এক ই রকম কাজ করে না। বিন্দের সাফ কথা “এই বাজারে টেকা যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। ভগমান হাত দুটো দেছেন।
দোকানে বেঞ্চ পাতা। সবাই তৃপ্তি করে খাচ্ছে। বিন্দের হোটেল এটা। রমরমিয়ে চলে দোকানটা। উফফফ। কী ভাগ্যিস লিজ নিয়েছিল। নৈলে বিন্দের ডানহাত মুখে উঠত না। ভোর থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত এক নাগাড়ে বিক্রিবাটা চলে।বিন্দে লুচি ভাজছে আর হেঁকে চলছে। গরম লুচি। খাস্তা লুচি। স্বপন কাগজের প্লেটে লুচি তুলছে আর দিচ্ছে। কারখানাতে কাজ করে যারা তারা বলছে “তাড়াতাড়ি করো গো । ঠিক সময়ে কাজে হাজিরা না দিলে মাইনে কাটবে”। বিন্দে স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে “জলদি কর স্বপনদা”।
মানুষ গুলো তৃপ্তি করে খাচ্ছে। আলুর দম এর প্রশংসাতে পঞ্চমুখ। উনান থেকে লুচির কড়া নামিয়ে টাকার বাক্সের কাছে বসে বিন্দে। এই আষাঢ় মাসের ভোরে কুলকুল করে ঘামে বিন্দে। চুলগুলো তার টিকিতে বাঁধা। গায়ের রঙ তামাটে। ফাঁক ফাঁক দাঁতগুলো। নিমেষের মধ্যেই কাঠের ক্যাশবাক্স উপচে পড়ে। একটা করে ট্রেন ঢুকবে আর লুচির জন্য আঁকপাক করবে। বিন্দের কোনও বিরক্তি নেই। টাকা সাজাতে সাজাতে বলে “স্বপন দা। খদ্দের হল গিয়ে নক্কী। ওরা আছে বলেই না দোকান চলছে। নৈলে সদলবলে কবে ফুটে যেতাম”। স্বপন ঘাড় নাড়ে। জুলজুল করে তাকায় টাকাগুলোর দিকে। এখন দোকান ফাঁকা। দু একজন চায়ের জন্য বাইরের বেঞ্চ এ বসে আছে। এই চা করাটা এখন বিড়ম্বনা। দশটার মধ্যেই লুচির পার্ট শেষ করে বিন্দে ভাত বসাবে।বারোটার পর থেকেই শুরু হবে ভাতের তাগাদা। সেই তিনটে থেকেই এই পর্ব চলছে। স্বপন টার বয়স হয়েছে। তাড়াতাড়ি কাজ করতেই পারে না। ওর হার্টের ব্যামো। সেদিন দোকান এর মধ্যেই অজ্ঞান হয়েছিল। বিন্দে ডাক্তার ডেকেছিল। বলেছে মেশিন বসাতে হবে ওর বুকে। সৃষ্টির কাজ। একা সামলানো দায়। কী ভাগ্যিস ভোরবেলা সিনান করে নেয়। স্বপন চা বানায় ধিকধিক করে। দুটো লুচি নিয়ে চা খায় বিন্দে। চেঁচিয়ে বলে “স্বপন দা। লুচির কড়া সরিয়ে দাও। আমি ভাত বসাবো। উনানে কয়লা ঢালো”। স্বপন ধীরে ধীরে সব করে দেয়। স্বপন বিন্দের নিজের দাদা নয়। ও হল পাড়াতুতো দাদা। স্বপনের বয়স সত্তর। জাতে বাউন। আগে কলকাতার পাইকারি দোকান থেকে এখানকার দোকানে ওষুধ এনে দিত। ভালোই উপার্জন করতো। কিন্তু নিজের কপাল পোড়ালে বিয়ে করে। শওর বাজারে ওই পয়সাতে আবার কেউ বিয়ে করে? ওর বাপটা ছিল ইস্কুল মাস্টার। বাংলাদেশের বরিশাল থেকে এসেছিল সেই স্বাধীনতার সময়। এখানে ঘর বাঁধলে ।দু কামরা কোঠা আর দুকামরা টালি। স্বপন ওদের পেরথম সন্তান। ওরা চার ভাই আর দুটো বোন ছিল। ছোটোবোনের জন্মের পর মা জননী দেহ রাখলে। স্বপনের তখন উনিশ কুড়ি বছর বয়স হবে। বি কম পড়ছিল। একদিন বাড়ি ফিরে দেখেন তার বাপ আবার বিয়ে করেছে। চোখ কপালে উঠল স্বপনের। বাপের মুখের উপর এতদিন কথা বলে নি সে। সেদিন বললে ” কী ব্যাপার! এই বয়সে বিয়ে করলে কেন। আমার বিয়ে দিলেই তো মিটে যেত”। বাপ বললে “অসভ্য ছেলে। সংসারের হাল ধরার জন্য তোমাদের নতুন মা এনিচি। তুমি লেখাপড়ায় মনদাও”।
বিন্দের এই এক জ্বালা। কাউকেই সে ফেলতে পারে না। অশিক্ষিত রূপহীন বিন্দে যেন নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। অথচ কত পরিশ্রম তাকে করতে হয়। একভাবে রান্নার কাজ করতে করতে হাঁফ ধরে। শুধুই কী তাই? রান্নার পর হাঁড়ি কড়া মাজা। এঁটো থালা মাজতে হয় না। ওটা আগে করতে হোতো। এখন পাতা কেনা হয়। পরে সেগুলো পুড়িয়ে দেয় স্বপনদা। কতদিন বিন্দে ভেবেছে এই স্বপনদাকে দিয়ে কাজ হবে না আর। কিন্তু পরক্ষণেই ভেবেছে “আহা। লোকটা খাবে কি”? বাপের বিয়ে দেখলে তরতাজা যুবক। বুড়ো বয়সে ঘর দোরে বাপের মনে রঙীন প্রজাপতি। অন্য ভাই বোনেরা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আর স্বপন হয়ে গেল বাউন্ডুলে। কতদিন হাওড়া স্টেশনে পড়ে থাকত। লেখাপড়াও শিখলে না। বামফ্রন্ট এর আমল তখন। বাপের নতুন বউ এর আবার দুটো বাচ্চা হল। প্রথম ছেলে তারপর মেয়ে। সৎ মা বলেছিল “একটা ছেলে আবার ছেলে নাকি? একটা টেকা আবার টেকা নাকি?”
যুবক স্বপন মনে মরা। কে তার দুঃখ বুঝবে? বাপের ভুল বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেল। এদিকে সৎ মা এখন রণরঙ্গিনী। বাপটা কিছুই বলতে পারে না ভয়ে। আর তখন কটা টাকার মাইনে। এতগুলো লোকের গ্রাসাচ্ছাদন। দিনরাত পরিশ্রম আর পরিশ্রম।
স্বপনের বাপের যক্ষা হল। সাতান্ন বছর বয়সে মরে গেল। সবাই বললে “স্বপন বড়ো ছেলে। ও চাকরি পাবে”। অত কিছু হলে তো আর গল্প অন্য দিকে বইতো। ততদিনে সৎমা রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। পরোপকারী নেতারা কুমীরের অশ্রু ঝরালে। স্বপনের মেজোভাই লেখাপড়া করে একটা চাকরি বাগালে। তারপর বিয়ে করে চলে গেল অন্যত্র। তবে দুই বোনের পাত্রস্থ করলে। সেও যাকে বলে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে। বদল বিয়ে। আর বাপের ভিটে দুভাগ হল। সেই হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়ো আগলে আগলে বুড়ো বয়সে বিয়ে করলে স্বপন। এখন তার ছেলের বয়স উনিশ। সেদিন বিন্দেকে বলেছে “বিন্দে পিসি। আমার বন্ধুরা আমাকে বলে আমি নাকি দাদুর ছেলে”। বিন্দে কী যে বলবে ভেবে পায় না। এসবের কী যে উত্তর হয় কে জানে। উনানে ভাত ফুটছে টগবগ করে। কটা আলু ভাতে দিয়েছে বিন্দে। সেদ্ধ আলু জিরে আর শুকনো লঙ্কা ভাজা দিয়ে মাখবে। দুটো মাছ ভেজে স্বপনদা আর ও ভাত খাবে। পেটে যেন বাইশ কুড়ি বাজনা বাজে।
বিন্দে সেই কাকভোরে এসেছে। ঘরে অসুস্থ মা। ভাই এর সংসার। ওখানেও ছটা পেট। ভাইপো ভাইঝিটা খুব নেটিপেটি। দেখতে শুনতে মন্দ নয়। ইস্কুলে পড়ে। শুধুই বিন্দের সংসার হয় নি। কেন হয়নি সেটা বিন্দের জানা নেই। আসলে পৃথিবীর কিছু মানুষ জন্মায় শুধুই কর্তব্য পালন করতে। তাদের জীবনে চাওয়া পাওয়ার বালাই থাকে না। বিন্দেকে তার আত্মীয় স্বজন কখনও সুন্দর বলেনি। কখনও কোনও গুণ কীর্তণ করেনি। তবে ব্যবহার করেছে। অপমান করেছে। আর এগুলো কেমন করে যেন বিন্দেকে খাঁটি করে দিয়েছে। শুধুই ঠাগমার কথা মনে পড়ে বিন্দের। সেই অশীতিপর সাদা থান পরা মানুষ টা। কত কী শিখিয়ে গিয়েছিল এই বিন্দেকে ।বিশেষ করে রান্নাটা। ভাতটা একফুট হলে নামিয়ে রেখেছিল বিন্দে। এতে জ্বালানির খরচা কমে। এরপর মাছ ভাজে গনগনে আঁচে। আজ খদ্দের দের জন্য ভোলা মাছ রাঁধছে । ভোলামাছের দামটা কম। আর খদ্দের দের ভালোই লাগবে। ওদিকে স্বপন ফালা ফালা আলু কাটছে। এই আলু খুব মিষ্টি। তরকারি বারোটা বাজায়।একটু সেদ্ধ করে জল ফেলে দেবে বিন্দে।
ভোলামাছ অল্পতেই ভেঙে যায়। তাই তেল উবুজ্বলন্ত গরম করে তবে মাছ দেওয়া। একপিঠ ভাজা হলে তবে টুক করে উল্টে দিতে হবে। এক একটা পিস পঞ্চাশ টেকা। স্বপন বলে “বিন্দে ।বড়ো গামলিতে কী ভিজিয়েছিস”? বিন্দে রেগে যায়। বলে সব কথা খদ্দের দের সামনে জিজ্ঞেস করবে না। ওতে ব্যবসার গুডিল নষ্ট হয়”। স্বপন ইংরেজি জানে। বিন্দের কথায় হাসে।
স্বপন ভাত খেতে গেলে বিন্দে বলে “আজ তিলের বড়া করব।এক একটা বড়া দশ টাকায় বিকোবে” স্বপন হাঁ করে থাকে। ডালে ভাতের ফ্যান মিশিয়ে হলুদ দিয়ে ঘাঁটে বিন্দে। ফিসফিস করে বলে “কন্ট্রোলের চাল। গামলিতে ভেজানো। বাটবো।তারপর আলু বাটবো। পেঁয়াজ, রসুন, আদা সব বাটবো। তিলবাটার সাথে মিশিয়ে বেসন দিয়ে শক্ত করব লেইটা।তারপর খাবার সোডা, নুন আর করনফ্লার।ঝালঝাল বড়া। এক ঝুড়ি ভাজব।দাম দশটাকা এক পিস।” স্বপন বললে “তারমানে তো তিনশ টেকা লাভ হবে বড়া ভেজে।বলিস কী রে! ও বিন্দে। গরীব দাদাটাকে পঞ্চাশ দিস।তোর ভালো হবে দেখিস”।
সত্যিই আজ তিলের বড়ার জয়জয়াকার। কারখানার শ্রমিক ওরা। কত কাজ করে। খিদের সময় এমন খাওয়া তোফা তোফা লায়া লায়া”। বিন্দের মুখে হাসি ধরে না। জনার্দন সুপারভাইজারি করে। বললে “বিন্দে। ভোলামাছের ঝোলে কী মিশিয়েছিস।কী অপূর্ব হয়েছে। “ “খদ্দের দের খুশি করতে না পারলে কী আর হোটেল চলে?” বিন্দের এই কথায় জনার্দন আমোদ পায়। বলে “কাল তাহলে কী রাঁধবি”? বিন্দে বলে “কালকের কথা কালকে। এখন খাও দেখি। আর হ্যাঁ। বড়া দু পিস কুড়ি টেকা।মনে থাকে যেন।”
বিন্দের জানতে বাকী নেই এই তল্লাটে কে কেমন। এই যে জনার্দন দাঁত বার করে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। ব্যাটা কম ধরিবাজ নাকি? অথচ বিন্দে ওরজন্য কী না করেছে। কথায় আছে মুখে মধু হৃদয়ে বিষ। সাহেববাগানের ঘোষাল দের ছেলে। অষ্টম গর্ভের সন্তান। সবাই বলে ভগবান কৃষ্ণ নাকি অষ্টম গর্ভের। তা জনার্দন টা কম যায় কীসে। কুলগুরুর পালিতা কন্যার সাথে ফস্টিনস্টি করতো। গুরুদেবের চোখ এড়ায়নি। একদিন জনার্দন এর বাপকে বললেন “তোমার পুত্র এখানে ধর্ম কর্ম করতে আসে না। ওর সাথে আমার পালিতা কন্যার বিবাহ হবে। “ জনার্দন এর বাপ ভাবে গদগদ। বললে “গুরুদেব। এ বিবাহ সুখের হবে কি?” গুরুদেব বললেন “মোটেও সুখের হবে না। তবে ওদের এমন অবস্থায় বিবাহ দিতেই হবে”। জনার্দন এর বাপ মনোতোষ গুরু আদেশ অমান্য করবেন কী করে? বিবাহ হল।
জনার্দন এর রূপের কদর ছিল মহিলা মহলে। আর মিথ্যাচার করার পুরস্কার চালু থাকলে ও থাকতো এক নম্বরে। বাপ হাতুড়ে চিকিৎসক। জনার্দন কে শিখিয়েছিল। এক কাঁড়ি টেকা খরচ করে রাস্তার উপরে ওষুধের দোকান করেছিল। কিন্তু স্বভাব খারাপ হলে গণেশ উল্টে যায়।
স্বপন বলে “ও বিন্দে। কী বিড়বিড় করছিস ? বিকালে রুটির সাথে কী রান্না করবি সেটা ভাব”। ঝাঁঝিয়ে ওঠে বিন্দে। বলে “তোমাদের মতো আগল পাগল নিয়ে মরছি। তোমরাই আমাকে শেষ করবে”। দু চোখের বিষ এই স্বপনটা। পই পই করে বিন্দে বলেছিল তোমার চাল নেই চুলো নেই। বে করার শখটা কীসের শুনি। ইসসস। খবরের কাগজে আবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। যদি কোনও পাত্রী রাজী থাকেন তবে যোগাযোগ করুন। আর ফোন নম্বর দিয়েছিল বিন্দের। কী ঝকমারি। পাত্রীর বাড়ি থেকে এল কাঁচা কাঁচা গালিগালাজ। ছ্যা করো। এমন বোকার পাল্লায় বিন্দে পড়ল।
স্বপন হাসে। যেন এগুলো কোনও ব্যাপার ই নয়। এগুলো তার জীবনের উজ্জ্বল কাহিনী। বললে “জনার্দন টেকাটা দিয়েছিল?” বিন্দে বললে “দেবে না মানে! মাগনা নাকি? সকাল থেকে আমার গতর ধুমসে যাচ্ছে।আর উনি বসন্তের কোকিল হয়ে আমার বাসায় ডিম পেড়ে যাবেন। “
বিন্দের চিন্তা হচ্ছিল রাতে রুটির জন্য কী তরকারি হবে। ব্যবসা রমরমা করতে হলে খদ্দের দের মুখ বদল জরুরী। ঠিক সেই সময়ই বিন্দের ভাই এর বউ এল। বললে “আমার বাবার ঝিঙেমাচা পড়ে গেছে। এক ঝুড়ি ঝিঙে দিয়ে গেছে। সাথে নারকেল। তোমার হোটেলে দিয়ে গেলাম”। বিন্দের হাসি আর ধরে না। নজরে এল শিশিতে ভর্তি মুগডাল। আজ মুগ আর ঝিঙের রসবড়া বানাবে বিন্দে। খদ্দের রা অবাক হয়ে যাবে। বিন্দের হাতের গুণে মন ভরে উঠবে খদ্দের দের।
বিন্দের এত নাম ।শুধু বদনাম করলে ওই জনার্দন। বউকে ছেড়ে দিলে। সবাইকে বললে বউ নাকি পাগলী। তখন সবাই তাই মানলে। তবে জনার্দন এর বাপ ছেলের বউকে তাড়ালে না। ভদ্রাসনে বউমা থেকে গেল। আর জনার্দন পালিয়ে এল এই বেলানগরে। ওখান থেকে পাঁচ কিমি দূরের একটা গাঁয়ে ডাক্তারের চেম্বার করলে। নিজেকে বললে হার্ট স্পেশালিস্ট। এসব মনে এলে গা পিত্তি জ্বলে যায় বিন্দের। মরনদশা!
মুগডাল ভিজিয়ে দিয়েছিল স্বপন। বিন্দে সেটা বেশ শক্ত করে বাটলে। ঝিঙের খোসা ছাড়িয়ে ধুয়ে নেয় বিন্দে। কাটার পর ধুলে জলের বোঝা। মুগডালের বড়া করে বিন্দে ।কালো জিরে আর কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ভাজতে থাকে ঝিঙে। ভাজা হলে তাতে আদা,রসুন দিয়ে কষাতে থাকে। অল্প জল দিয়ে নুন মিষ্টি দেয়। উষ্ণ গরম হলে তাতে ঢেলে দেয় ডালের বড়া। নারকেল কুড়ো দেয়। ছোট্ট বাটির এক বাটি তরকারি বিকোয় কুড়ি টেকা দামে। রুটি বারো টাকায় তিনটে।
বিন্দের জীবনে বিশ্রাম নেই। যারা বলে মেয়েরা আবার কী জানে ,ওরা তো অবলা তারা বিন্দেকে দেখলে চুপসে যাবে। আজ দশটার মধ্যেই সব রুটি শেষ। এখন ও অনেক খদ্দের লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দের স্বভাব নয় যে খদ্দের ফিরিয়ে দেবে।আবার আটা মেখে রুটি করে দিল। স্বপন দা বেঞ্চ এ বসে ঢুলছে। যতহোক বয়স তো হয়েছে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। এখনও পাঁচটা রুটি আর কিছুটা তরকারি বেঁচে। হঠাৎই নজরে পড়ল ও পাড়ার নীলুর বাপ প্লাটফর্ম থেকে দেখছে বিন্দেকে। রেলের আলোয় তার চোখের ভাষা বুঝতে পারছে বিন্দে। অন্তরটা কেঁপে উঠল বিন্দের। ওই লোকটার খিদে পেয়েছে। ওর ছেলে এখনও খাবার নিয়ে আসেনি। আহা। বিন্দের চোখের কোণে জল চিকচিক করে। রুটি তরকারি দিয়ে আসে লোকটার কাছে রাখা প্লেটে। এই লোকটা সরকারের চাকুরে ছিল। বউ আর দুই ছেলে নিয়ে সাহেববাগানে ভাড়া থাকত। বিন্দে ওদের বাড়িতে যেত। লোকটার ছোটো ছেলে নীলু। বউটার কাছে গল্প শুনেছিল ওদের অতীত জীবনের। তারপর কোথা থেকে বাড়ির এই কর্তার কুষ্ঠ হোলো। ডাক্তার জানালে সব কুষ্ঠ ছোঁয়াচে নয়। তবে এই কুষ্ঠ ছোঁয়াচে। ওর সংস্পর্শে যে থাকবে তার ই কুষ্ঠ হবে। ভাড়াবাড়ির মালিক ওদের অন্যত্র যেতে বললে। অসহায় পরিবার তাই এই প্লাটফর্মে রেখে গেছে। রাত গভীর হলে লোকটার ছেলে আসে খাবার দিতে। চোখের জলে ভাসে ওর বউ। বিন্দের মনে হয় মানুষের জীবন মানেই দুঃখ। এক একটা মানুষের এক একটা দুঃখ। মনে পড়ে বাবার কথা। তার বাবার কত অভাব ছিল। অথচ কত সুন্দর গান গাইতো। বাবা কতদিন বলেছে “বিন্দে আমার চোখের তারা”। স্বপন গজগজ করতে থাকে। বলে “আমার খোরাকি দে। বাড়ি যাই। আর ওই পচা রুগীর কাছে যাস কেন? আদিখ্যেতা দেখলে প্রাণে বাঁচিনা।” স্বপন কে আড়াইশ টেকা দেয় বিন্দে। আজ পঞ্চাশ বেশি। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে দুটো মানুষ হেঁটে চলে।
পরের দিন বিন্দে খুব ভোরে দোকানে গেল। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। দোকান খুলে জল দেওয়া, লক্ষ্মী গণেশ কে ধূপ দেখানো বিন্দের অভ্যাস। স্বপন টা আজ একটু দেরী করে আসবে। ওর বউটা খুব ভোগে। দৈনিকের কাজ গুলো করে হঠাৎই দৃষ্টি গেল প্লাটফর্ম এর দিকে। নীলুর বাপ ইশারা করে ডাকছে। কী তাগড়াই শরীর ছিল লোকটার। কদিনে কালো ভূত হয়ে গেছে। ওকে দেখলে বিন্দের অন্তরটা ডুকরে ওঠে। বিন্দে সসপ্যান বসিয়েছে। জল ফুটছে শোঁওওওও। তারমানে চা খেতে চাইছে। বিন্দে এগিয়ে যায়। লোকটার পোশাক পুরো ভিজে গেছে। ঘা গুলো আরও দগদগ করছে যেন। বিন্দে হাত নেড়ে বললে “অপেক্ষা করো। আসছি”। বিন্দের চা যে খেয়েছে সে কখনও ভুলতে পারবে না। ঘন দুধের চা ।যেন বটের আঠা। বিন্দের ইচ্ছা হল নীলুর বাপকে আগে চা দেবে। কিন্তু এরমধ্যেই বিরাট শোরগোল শুরু হল। অনেক লোক জড়ো হয়েছে।
বিন্দের এখন দোকান থেকে ওঠার ফুরসৎ নেই। তবে কানে এল জনার্দন এর গলা। নিজের জাহির করার ব্যাপারে ও পয়লা নম্বর। বললে “এই বুঢঢাকে এখান থেকে সরাও। “ নীলুর মা আর নীলুর উপস্থিতি টের পায়নি বিন্দে। ওরা কাঁদো কাঁদো মুখে যখন বললে “কোথাও একে কেউ ঠাঁই দেবে না। কী করব আমরা”।
চার নম্বর প্লাটফর্ম এ একটা মালগাড়ি দাঁড়িয়েছিল। নীলুর মা আর নীলু ধরাধরি করে সেখানেই তুলে দিয়ে এলো। বিন্দে যখন চা নিয়ে এলো তখন বুড়োটা মালগাড়ির ভিতরে। নীলুর চোখে জল। বললে “আমার জন্মদাতার জন্য আমি কিছুই করতে পারলাম না। হে ঈশ্বর!আমাকে শাস্তি দাও”।
বিন্দের আর সাহস হল না চা দিতে। শুধুই মনে মনে বললে “পৃথিবীর কত মানুষের কাছে কত ঋণ থেকে গেল। এরাও তো আমার জাতভাই। “ বিন্দের মনে পড়লো বাবার মৃত্যুর দিনটা। সেদিন বিকালের দিকে ব্যথা হল পেটে। বিন্দে ডাক্তার দেখালে। ডাক্তার বললে আমাশা। তারপর ভোরের বেলা ভলকে ভলকে বমি। বাঁচাতে পারলে না বিন্দে। নীলুর কান্নার সাথে মিশে গেল বিন্দের কান্না। আর জনার্দন বুক ফুরিয়ে বললে “চা দে বিন্দে”।
বিন্দের গোটা শরীর রি রি করে উঠল। বললে “বেরিয়ে যা এখান থেকে। আগের টেকা দিস নি। শালা ফেরেববাজ”। জনার্দন এর ইতিহাস বিন্দের মতো কেউ জানে না। সেই হার্ট স্পেশালিস্ট জনার্দন। বাপরে বাপ। একটা মেয়ে ওর কাছে এল রোগ দেখাতে। নামটা ছিল কুসুম। কেমন ডাগর ডাগর চোখ। চুলের রাশি কপালকে ঢেকে রাখতো। জনার্দন তাকে পাবার নেশায় পড়লে। অথচ ঘরে তার দ্বিতীয় পক্ষ পদ্ম। বিন্দের চেষ্টাতে দ্বিতীয় বিয়েটা হয়েছিল। কিন্তু জনার্দন আবার কুসুমে মজলে। চিকিৎসক এর বেশে কুসুম কে বললে “আমার বাপ নেই। মা নেই। তিনকূলে আমাকে দেখবার কেউ নেই “। কুসুম এর বাড়িতে হানা দিলে জনার্দন। কুসুম এর মা ভাবলে রুগ্ন মেয়ের চিকিৎসক জামাই পাওয়া গেছে। জনার্দন ঠাকুর দালানে বিয়ে করে সোজা কুসুম কে নিয়ে চলে গেল ভাগলপুর।
বিন্দের মনে এখন জনার্দন এর জন্য ঘৃণা জমা হল। ঠিক সেই সময়ই স্বপন এর বউ হাজির। বললে “পঞ্চাশ টা টাকা হবে বিন্দে দিদি। চাল বাড়ন্ত। ভুখাদানা নেই। ছেলেটা অভুক্ত আছে রাত থেকে”। বিন্দে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বলে “স্বপন দা কাল আড়াইশ টেকা নিয়ে গেল “। স্বপন এর বউ বললে “ও সংসারে কিছুই দেয় না”।
রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমাতে পারল না বিন্দে। তার বারবার মনে পড়ছে নীলুর বাপকে। জনার্দন গলাবাজি করলে। বিন্দে দেখেছিল নীলুর মায়ের চোখের ভাষা। কী নিদারুণ আকুতি ছিল তার। তাকে সাথীহারা করে কী শান্তি পেল জনার্দন? শুধুই চোখের একটু দেখা তাও গেল। কোথায় চলে যাবে নীলুর বাপ। জনার্দন তো সমাজের কুষ্ঠ।
সেদিন কী শীত না পড়েছিল। বিন্দের মা ঠকঠক করে কাঁপছিল। কাঁপা স্বরে বলছিল “অ মা বিন্দে। বড়ো জার লাগে”।
বিন্দে হ্যারিকেনে নুনের পোঁটলা দিয়ে সেঁক দিচ্ছিল মাকে। আর ওই ঠান্ডার মধ্যে পদ্ম এসে হাজির। বললে “বিন্দে দিদি। কাল থেকে তোমার ভাই বাড়ি ফেরেনি। ও জনাই এর একটা মেয়েকে বিয়ে করে পালিয়েছে”।
আকাশ ভেঙে পড়েছিল বিন্দের মাথায়। ওই হাড় হিম করা শীতের রাতে রওনা দিয়েছিল ভাগলপুর। সাথে ছিল পদ্মর দাদা সাধন। সেদিন থেকেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল বিন্দে “এই বিয়ের ঘটকালি আর সে করবে না”। পদ্মর ছেলেটাকে সঙ্গেই নিয়েছিল বিন্দে। কিন্তু অতবড় শহরে কোথায় তার ডেরা জানবে কী করে?
জনার্দন এর বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে বিন্দে। হিড়হিড় করে টেনে আনবে পদ্মর কাছে। আচ্ছা খলিফা ছেলে বটে। তবুও ভাগলপুর এর কথাটা জানা গেছে। অপরাধী নিজের ভুলের স্বাক্ষর রেখে যায়। জনার্দন এর প্যান্ট কাচতে গিয়ে চিঠিটা পেয়েছিল পদ্ম। সেখানেই ওদের পরিকল্পনার কথা জানা গেছে। নৈলে আবার থানা পুলিশ করতে হোতো। তবে পদ্ম বলছিল “ইদানিং জনার্দন খুব সাজগোজ করছিল”। জনার্দন এর কথা ভাবতে বিন্দের গা রি রি করে। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎই স্বপন এসে হাজির। বললে “চাবি দে। তুই ধীরে সুস্থে আয়। আমি চা এর সসপ্যান বসাচ্ছি”। খুব খুশি হল বিন্দে। মনে মনে ভাবলে “আজ একটা নতুন রান্না করে তাক লাগিয়ে দেবে সে”।
স্বপন টার অভাব আছে। জেতে বাউন হওয়ায় ওর ছেলেটার কালীঘাটে পৈতে দিয়েছে। এখন ছেলেটা পাঁচবাড়ি পুজো করে। চালটা, কলাটা মূলোটার সাথে কিছু পয়সাও পায়। তাতেই ছেলেটা প্রাইভেট এর মাইনে দেয় ।
লুচির পার্ট শেষ করে বিন্দে ঠিক করল আজ ভাতের সাথে মাছের ঝোল রাঁধবে। কাতলা মাছের পাতলা ঝোল। নাম মাত্র লাভ রেখে খদ্দের দের মাছ খাওয়াবে। আসলে খদ্দের হল গিয়ে লক্ষ্মী। বড়ো কড়ায় লাল করে ভাজছে মাছ গুলো। কী সুন্দর ছ্যাঁ কলকল শব্দ। মনে পড়ে গেল কেষ্টর কথা। ওই রাস্তার বাঁকে বাসন বিক্রি করত কেষ্ট। অনেক লেখাপড়া শিখেও চাকরি পায়নি। শেষে স্টিল অ্যালুমিনিয়াম এর দোকান খুললে। কবিতা লিখত। ও বলেছিল “বিন্দেরাণী।সব জিনিসের ছন্দ আছে।শুধুই কবিতাতেই নেই “। বিন্দের আশ্চর্য লেগেছিল। কেষ্টর উপরে কেমন একটা মায়া জন্মেছিল। কেষ্ট একদিন বলেছিল “বিন্দে। চল আমরা বিয়ে করব।তোকে ভালোবাসি”। বিন্দের সেদিন মনে হয়েছিল কেষ্ট ছাড়া কেউ তাকে কখনও এমন করে ভালোবাসেনি”।
আজ বড়ো বড়ো করে ঝিঙে কাটল বিন্দে। সাথে বড়ো করে আলু। মাছ ভাজা হয়ে গেলে কড়ার তেলে কালোজিরে আর চিরে রাখা কাঁচালঙ্কা দিলে। তারপর তাতে আলু দিয়ে ভাজতে লাগল। আড়াই কেজি সাইজের চারটে কাতলার চারটে মাথা। কেজিতে দশটা পিস করেছে স্বপন। সকালেই বলেছিল “বিন্দে। মাছের কালিয়া কর। আর মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল কর। “ বিন্দের মনঃপূত হয়নি। বলেছিল “তাহলে আবার তরকারি করতে হবে একটা। বাজারে নধর ঘটঘট পুঁইশাক এসেছে। কুমরো আর পুঁইশাক এর সাথে মাছের মাথা পুরো জমে যাবে”।
আলু আধভাজা হয়ে গেলে কেটে রাখা ঝিঙে দিয়ে তাতে নুন দিলে বিন্দে। তারপর চাপা দিলে।ঝিঙের জল বেরিয়ে যাক। ততক্ষণ মশলাটা করতে হবে। শিলে বসল বিন্দে। আদা ,রসুন, পেঁয়াজ, জিরে,রাঁধুনি,ধনে সব একসাথেই এক তাল বাটলে। এই মশলা দিয়ে কষাতে থাকল বিন্দে। চারদিক একটা অপূর্ব গন্ধ। সত্যিই বিন্দের রান্নার জবাব নেই।
মাছের ঝোল টগবগ করে ফুটছে। স্বপন পুঁইশাক ধুতে ব্যস্ত। “শাকের মধ্যে একটা বালি যেন না থাকে” বিন্দে বলতে থাকে।
পুঁইশাক আর কুমরো প্রস্তুত। ভেজে রাখা মাছের মাথা দিয়ে ঘন্ট হবে। সরষে বাটতে বসেছে স্বপন। ঠিক সেই সময়ই ভটচাজ কাকা হাজির। বিন্দের সাফ কথা “বারোটার আগে রান্না হবে না। এই সবে এগারোটা”। ভটচাজ থতমত খায়। বললে “সে তো বটেই। আসলে কাল রাতে আসতে পারিনি। রুটিটা নিয়ে যেতেও পারলাম না। তাই বড়ো খিদে লেগেছে”। বিন্দের এই এক সমস্যা। এই ভটচাজ কাকা। সামান্য পেনশন পান। অতি কষ্টে ছেলেকে পড়িয়ে ছিলেন। ছেলে বড়ো চাকরি করে। এখন বাপকে দেখে না। বিন্দে কুমরো আলু ভাজতে ভাজতেই বলে “হ্যাঁ গো কাকা। তোমার ছেলের খবর কী”? ভটচাজ বলে “অ মা বিন্দে। আমার ফোনটা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে। একবার দ্যাখ না মা”।
বিন্দের এই এক জ্বালা। বললে “আমার ফোন থেকেই একটা ফোন করছি। নম্বর টা দাও।” নম্বর নিয়ে ভটচাজ কাকার ফোনে ফোন করল বিন্দে। ফোন বেজে উঠল। বললে “কাকা। ফোন ঠিক আছে গো”। ভটচাজ বিমর্ষ হয়ে বললে “ছেলেটার ফোন তো আসে না”। বিন্দের মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললে “কাকা। যেদিন আসতে পারবে না সেদিন আমি ফোন করে নেবো। সেরকম হলে খাবার দিয়ে আসবে স্বপনদা”। ছোটো ছোটো মানুষের ছোটো ছোটো আশা পূরণ হলে তারা আনন্দ পায়। ভটচাজ এর চোখ দুটো চকচক করে উঠল। পুঁইশাক এর তরকারিতে মাছের মাথা শেষে দিলে বিন্দে। একটু মিষ্টি দিলে। ঠিক তখনই একটা মেয়ে ঢুকল বিন্দের দোকানে। বললে “ভাত পাওয়া যাবে”? মেয়েটার মুখমন্ডল অত্যন্ত সুশ্রী। কিন্তু বিন্দের মনে হল এই মেয়েটাকে সে আগে দেখেছে।
বিন্দে টেবিল মোছে । স্বপন জল আর নুন ,লেবু দিয়ে যায়। যত্ন করে খেতে দেয় বিন্দে। একটা অদম্য কৌতুহল কাজ করে। কোথায় যেন দেখেছে। খুব চেনা। মেয়েটার খিদে পেয়েছে। খুব তৃপ্তির সাথেই খাচ্ছে ভাতগুলো। বিন্দে উপযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করলে “ভাত নেবে আর?” মেয়েটা ঘাড় নাড়ে। বিন্দে প্লেটে করে ভাত দেয়। মাছের ঝোল দেয়। বিন্দের আগ্রহ বাড়ে। বললে “আচ্ছা। তোমার বাড়ি কোথায়? তুমি কি কোনও কাজ করো এখানে?”
মেয়েটা বললে “আমি এখানে একটা প্লাস্টিকের কারখানাতে কাজ করি। অবশ্য কারখানা বললে ভুল হবে। তবে সেখানে প্লাস্টিকের খেলনা,মশলা রাখার কৌটো তৈরি হয়। ওরা সপ্তাহে রোজ দেয়। টিফিন আলাদা করে দেয় না। তবে একশ টাকা দেয়।”
বিন্দে বললে “তুমি রোজ এখানেই খেয়ে নিও। আমি না হয় কমসম করে নেবো”। মেয়েটার চোখ ছলছল করে উঠল। বললে “আমরা গরীব। রোজ হোটেলে ভাত খেতে গেলে সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে যাবে।” বিন্দে বললে “তোমার কোথায় বাড়ি বললে না যে?” মেয়েটা বললে “আপনাকে আমার খুব চেনা লাগছে। আচ্ছা জনাই এ আপনার কি কেউ আছেন? আমার বাড়ি জনাই”। চমকে উঠল বিন্দে। সেই সেদিন রাতে দেখা সেই মেয়েটা। কতদিন এর কথা ভেবেছে বিন্দে। মেয়েটার মাথার দিকটা ভালো করে দেখে বিন্দে। তার অন্তকরণ যেন ফেটে যাচ্ছে। মেয়েটার মাথায় সিঁদুর নেই। বিন্দের মাথাতেও নেই। তবে বিন্দেকে কেষ্ট ঠকায় নি।
মেয়েটার কাছে নতুন করে কোনও কথাই তুলল না বিন্দে। মনে মনে ভাবলে পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে কিছুই লাভ নেই। এই যে মানুষের জীবন। কত ঘটনার সাক্ষী। সব মনে রাখতে নেই। আর যা মনে থাকার তা কখনও কী ভোলা যায়। জনার্দন কেন যে অমন করেছে কে জানে। খুব অপরাধী লাগে নিজেকে। ওই মেয়েটার নাম কুসুম। ওকে নিয়ে ভাগলপুরে দুরাত কাটিয়েছিল জনার্দন। বিন্দে সেখানেই হাজির হয়েছিল। হিড়হিড় করে জনার্দন কে টেনে এনেছিল পদ্মর ঘরে। আর ওই মেয়েটার মাথার সিঁদুর মুছে দিয়েছিল। বলেছিল “কুসুম। তুমি ভুল মানুষের পাল্লায় পড়েছ। ও তোমার নয়। ওর বউ আছে। ছেলেপুলে আছে”।
সারারাত ঘুমাতে পারে না বিন্দে। চোখের জলে ভেসে যায় তার মুখ। আসলে মানুষের ভুল আছে বলেই তো কত গল্প সৃষ্টি হয়। স্বপনের গল্প, জনার্দন এর গল্প। আর তার মতো নারীর গল্প। আজ কেষ্ট থাকলে বলতো “বিন্দে। অত ভাবিস নে”। কেষ্টর মৃগী রোগ ছিল। ওই রোগেই পুকুরে ডুবে মরলে। কখন ভোর হয়ে গেছে। আর একটু পরেই দোকান খুলতে হবে। হঠাৎই একটা গগনবিদারী চিৎকার কানে এল। পদ্ম কাঁদছে। ছুটে বেরিয়ে এল বিন্দে। বললে “সাতসকালে কী হল”? পদ্ম কী যেন বললে। অসহায় বিন্দে ছুটছে। পিছনে পদ্ম। স্টেশনের কাছে এসে দেখে অনেক লোকের জটলা। ভোরের মেলট্রেনটাতে আত্মহত্যা করেছে জনার্দন। তার রক্তাক্ত দেহ কুন্ডুলী পাকিয়ে পড়ে আছে। তবে কি’,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,!!!! আবার দোকান খুলেছে বিন্দেদ্যূতি। মাঝে মাঝেই তার মনে হয় এই দোকান তার পৃথিবী আর খদ্দের গুলো এক একটা গল্প। হয়ত এই গল্প শেষ হয় না।