কথায় বলে- ‘অচল ঘড়িও একটা সময় সঠিক সময় দেয়’। কিন্তু বাকি সময়টার কী হবে! কাজেই সে-কথার কোনও গুরুত্ব নেই।
গুরুত্ব নেই দুলালেরও! একটা ভবঘুরে-বাউন্ডুলে ছেলেকে কেনইবা কেউ গুরুত্ব দিতে যাবে!
যে-কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সে-টা হলো- হরিহরপুরের মুখুজ্জে বাড়ির সবকটা ছেলেই কাজেকম্মে সাক্ষাৎ বিশ্বকর্মা, ছোটোটাই শুধু অকম্মা!
তা বললে তো আর চলবে না, মুখুজ্জে’গিন্নি ধরে-বেঁধে তাঁর আলালের দুলালটাকে একটা নয়, দুটো নয়, দশ-দশটা ক্লাস পড়িয়ে ছেড়েছেন!
অবশ্য এই ধরা-ছাড়া নিয়ে দুলালের না আছে কোনও দুঃখ, না আছে কোনও অহংকার। একবেলা নাওয়া আর দুবেলা দুমুঠো খাওয়া, জীবনে এইটুকুই তো চাওয়া! কাজেই এ-নিয়ে বেশি না ভাবাই ভালো!
পাশের বাড়ির পদ্ম হাজার চেষ্টা করেও এই পাগলটার চাহিদা-মাত্রা বিন্দুমাত্র বাড়াতে পারেনি! পদ্মটা তাই কুঁড়িতেই ফুরিয়ে যেতে বসেছে, ফুল হয়ে ফোটা আর হলো না বোধহয়!
পাগলের গলায় মালা গলাবার স্বাদ হলে যে গলদঘর্ম দশা হয়, পদ্ম’র সেই দশাই হতে চলেছে!
‘পাগল’ নয়তো কী! মাথা ভরতি কোঁকড়ানো চুল আর মুখ ভরতি অনাদরের দাড়ি, ভুলেও তেল-সাবানের স্বপ্ন দেখে না! তারওপর বিড়ির ছ্যাঁকায় সেগুলোর ছিরি যথেষ্ট পরিমাণে বিচ্ছিরি হয়ে গেছে!
এ-হেন গুণধরকে নিয়ে গদাধর মুখুজ্জে আর মাথা ঘামান না! যা ঘামাবার গিন্নি একাই ঘামান। “বে-থা নাই করুক, কিন্তু শেষ বয়সে থাকবেটা কোথায়, খাবেটাই বা কী! এসব ভাবতে ভাবতেই মায়ের রক্তচাপ চরচর করে চড়তে বসেছে!
তা চড়ে চড়ুক, মায়ের ‘মন’ বলে কথা! দুর্বল সন্তানের ওপরেই যত মায়া! তাই থেকে থেকে ওর ঠিকুজি-কোষ্ঠীটা নিয়ে বসেন, আর চোখের পাতা দুটো আকাশের মতো মেলে ধরে ঐ লাইনটি বারবার করে পড়েন- “জাতক একদিন বংশের মুখ উজ্জ্বল করিবে”!
“কিন্তু কবে করিবে”- সেই অপেক্ষায় থাকতে থাকতে পঁচিশটা বছর কেটে গেল! বংশের মুখ তো দূরের কথা, নিজের মুখ উজ্জ্বল করার মতো কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনা আজ পর্যন্ত ‘জাতক’ ঘটায়নি!
যে-টা ঘটেছে, সে-টা হলো- মুখুজ্জে’বাড়ির বুড়ো থেকে গুড়ো, প্রতিটি সদস্য ঐ কানাই পণ্ডিতের মুখ দেখাই বন্ধ করে দিয়েছেন! তবে মুখুজ্জে’গিন্নি এখনও সে-টা করেননি।
উল্টে দুলালকে রাজি করিয়েছেন, একদিন পণ্ডিত’মশাইয়ের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। “উনি বিধান দিলে কত্তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে একটা পলা অথবা গোমেদ যদি ধারণ করানো যায়”!
ঘর থেকে বেরোতেই মুনিয়া’পাখিগুলো দুলালকে এমন করে ঘিরে ধরল যে মা খানিকটা বিরক্ত হলেন!
এটা নতুন কিছু নয়, দুলালকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখলেই ওরা এমনটা করে! তবে আজ যেন একটু বেশিই করছে!
এই পাখিগুলো দুলালের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে উঠোনের একটা ঝোপঝাড় দখল করে বছরের পর বছর বসবাস করে আসছে! ওদের এই জবরদখলটা ভাইদের মোটেই পছন্দ নয়! শুধু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারছে না, নইলে কবে দিত উচ্ছেদ করে!
যাক সে-সব কথা, এখনও যে ওরা টিকে আছে সেটাই বড় কথা!
মুনিয়াদের বুঝিয়ে-সাজিয়ে অনেকরকম সান্ত্বনা-ঠান্ত্বনা দিয়ে তবে ওঁরা বাড়ি থেকে বেরোল।
ঘোষ’পাড়ার মধ্য দিয়ে কিছুটা পথ এগোতেই সান্টু ঘোষের সঙ্গে দেখা….
“কী রে সান্টু, এত সকালে এমন হন্যে হয়ে যাচ্ছিস কোথায়?”
“তোর কাছেই যাচ্ছিলুম রে দুলু”!
“কেন, কী হয়েছে?”
“তুই কিছু জানিস না!?”
“কী জানব!?”
“সুকমল মারা গেছে!!!”
“বলছিস কী রে!!! কীকরে!!!?”
“কানাঘুষো যা শুনলুম- “খাবারে কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়েছে!”
“বুঝছি, এটা ওর দাদারই কাজ! দুদিন আগেই সুকুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল! গোটা সম্পত্তি একলা গিলবে বলে পথের কাঁটা সরিয়ে দিল! অনেকদিন ধরেই ওর দাদা চেষ্টা করে যাচ্ছিল!”
দুলাল মাযের হাতদুটো চেপে ধরে বলল-
“মা, শুনলে তো সব! এক্ষুণি সুকুর বাড়িতে যেতে হবে, পরে কোনও একদিন নিশ্চয়ই তোমায় কানাই জ্যেঠুর বাড়িতে নিয়ে যাব! পদ্ম, ভাগ্যিস তুই সঙ্গে এসেছিলি!”
নিজের কানে সব শুনে মা আর বারণ করতে পারল না! আচমকা এরকম একটা খবর পেয়ে নিজেই খুব ভেঙে পড়লেন! পদ্ম তাড়াতাড়ি কাকি’কে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
****
সুকুদের বাড়িতে তখন মানুষ আর পুলিশে ছয়লাপ! কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না! ‘বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে’- সে-টা আন্দাজ করা গেলেও অপরাধীকে শনাক্ত করা গেল না!
কিন্তু দুলু’র তো আর তর সইছে না! ভিড় ঠেলে আই.ও’র সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে গেল। কিন্তু একটা পাগলের কথার কী গুরুত্ব আছে! অফিসারের ইশারায় একজন কনস্টেবল দুলুকে ধাক্কা দিয়ে গেটের বাইরে বার করে দিল!
তাতে অবশ্য দুলুকে দমিয়ে রাখা গেল না- “স্যার, আপনি দয়া করে ওর চায়ের কাপটা ভালো করে পরীক্ষা করুন, কাপের গায়েও বিষ লেগে থাকতে পারে! সুকু কখনও কাপে চুমুক দিয়ে চা-খেত না, একটু একটু করে প্লেটে ঢেলে তবে খেত…!”
দুলালের ছুঁড়ে দেওয়া কথাগুলো সবার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেলেও অফিসারের তালুতে ‘টকাস’-করে গিয়ে লাগল!
****
তদন্তে যা বেরোল তাতে করে দুলুর অনুমানই সত্যি হলো- কাপের গায়ের নিচেরদিকে ‘হাইড্রোজেন সায়ানাইড’ জাতীয় কিছু একটা লাগানো হয়েছিল, যা পেটে যেতেই মৃত্যু ঘটেছে!
****
এই ঘটনার দু’দিন পর দুলু বাড়ি ফিরে দেখে, পাখিগুলো সারা বাড়ি জুড়ে পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে! দুলুকে দেখেই ওর গায়ে বসে ডানা ঝাপটাতে শুরু করল!
দুলু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে খানিক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে রইল-
হঠাৎ উঠোনের কোণটাতে নজর পড়তেই বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল! গাছটা ওখানে নেই, একটা ঘর উঠছে সেখানে!
কিছু বুঝতে আর বাকি রইল না! হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করতে লাগল! কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল!
কিন্তু উঠোনে পা দিয়েই একেবারে হতবাক হয়ে গেল! সারা উঠোনে কালো আর সাদা মাথা গিজগিজ করছে, কারো মুখে কোনও কথা নেই! ইয়া বড়ো নাক-উঁচু-ক্যামেরা’গুলো সমানে ক্লিক আর ঝিলিক মেরে চলেছে, সঙ্গে চোখ ধাঁধানো এ-ক্লাস সব ফ্ল্যাশ!