ছিঃ ছিঃ এসব কথা কেউ বলে? ওর ধারণা ছিল শহরের লোকেরা ভদ্র সভ্য হয়।ওরা গ্রামে থাকে । ভাষার ঠিক থাকে না ওদেরই। এখন তো দেখছে উল্টো। কিন্তু কী করবে ? এদের সংগে লাগতে যাওয়াই বিপদ। ইদানিং লক্ষ্য করছে এক দুজন ছাড়া বাকিরা ওকে বেশ হিংসের চোখে দেখে। কী যে মুশকিল ! কাজ করলেও বিপদ ।না করলেও বিপদ। তার চেয়ে চুপচাপ থাকাই ভালো। তাই ইদানিং থাকত ও। সেদিনও ওরা বেরিয়ে যাবার পরে একাই বেরিয়েছিল সুখেন। মোড়ের মাথায় শীতলা মন্দিরের সামনে রোজই একটু দাঁড়ায় ও। সেদিনও দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ ওই মালতী নামের মেয়েটা কোত্থেকে সামনে এসে হাজির । সুখেন তো অবাক। ওর কাছে আবার কী চায়? ও তো কারুর সাতে পাঁচে থাকে না। হ্যাঁ। শিখাকে ভালো লাগে ঠিকই কিন্তু কখনও কোন কিছু প্রকাশ তো কারুর কাছে করে নি ও। তবে ? হাতের ইশারায় মালতী ওকে মন্দিরের পিছন দিকে যেতে ইঙ্গিত করল। প্রথমে সুখেন যাবে না ই ভেবেছিল কিন্তু মালতীর বারবার ডাকে আর না করতে পারল না। মন্দিরের পিছনে একটা নিম গাছের ছায়ায় ওকে ডেকে আনল মালতী। দুরুদুরু বুকে দাঁড়িয়ে তখন ঘামছে সুখেন। একটু দূরেই নিম গাছের বাঁধানো বেদীতে শিখা আর অন্য একটি মেয়ে বসে। শিখা দাঁতে করে একটা ডাল কাটছে। নিজেকে কী রকম ফাঁসির আসামীর মত লাগছিল সুখেনের। ধনাই না হয় ওসব করেছে। ও তো কিছু করে নি। আর ধনাইয়ের সঙ্গেও ও আজকাল থাকে না। তাহলে ওকে ডেকে এনে এরকম ভাবে দাঁড় করাবার মানেটা কী রে বাবা ? এরা তো আর জানে না। ওর সব দিকেই বিপদ। এই যে শিখার দলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে এটা দেখেও তো ওরা মনে করতে পারে যে ওর সঙ্গে এদের ষড় আছে। উফফ ! “ ধনাইয়ের ব্যাপারটা শুনেছ ?” এই প্রথম শিখা কথা বলল ওর সঙ্গে। গলার আওয়াজটা একটু ধরা ধরা। কাঁদছে নাকি ? বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল সুখেনের। “ ও ধমকি দিয়েছে শিখার মুখে এসিড ছুঁড়ে মারবে। কত বড় আস্পদ্দা ভাবো দিকিনি ?” ফুঁসে ওঠে মালতী। চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নেয় সুখেন। তারপর বলে, “ ওসব রাগের কথা। অতই সোজা নাকি ? থানা পুলিশ নেই দেশে?” “ থাকবে না কেন ? কিন্তু এসিড মারার পর থানা পুলিশ করে কী হবে? তাই শিখা ঠিক করেছে –” “ কী ?” মালতী কথা শেষ করার আগেই বোকার মত দুম করে প্রশ্ন করে বসে সুখেন। ঝট করে চোখ তুলে ওর দিকে তাকায় শিখা। কী ছিল সেই চাউনিতে কে জানে ? সুখেন বিহ্বল চোখে চেয়ে থাকে। “ ও এখানকার চাকরি ছেড়ে দেবে। কসবার দিকে এক বাড়িতে রান্নার কাজ পেয়েছে। বুড়ো বুড়ির সংসার। ওখানেই থাকবে। মাইনেও ভালো আর এসব ঝুট ঝামেলাও নেই।” “ কসবা ? আরে ! কী আশ্চর্য ! আমিও তো। ওইখানেই একটা কাজের সন্ধান পেয়েছি। ভাবছি চলে যাব। একটা ঘর পেলেই –” বলতে বলতে থেমে যায় সুখেন। শিখা ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। যেন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। মালতী খিলখিল করে হেসে ওঠে। “ ওরে ও শিখা। এ যে রাজ জোটক রে। অবাক কান্ড ! তুই যেথায় যাচ্ছিস এও তো দেখি সেখানেই কাজ জুটিয়েছে ! ওমা ! কোথায় যাব গো ?” “ না না। বিশ্বাস কর।” ব্যাকুল হয়ে বাধা দেয় সুখেন।“ আমি আর কারুরটা জানতাম না।” “ এখন তো জানলে ? এবার কী করবে ?” আবার হেসে ওঠে মালতী। শিখা মুখ ফেরায়। “ ঠিক আছে। আমি এখানেই না হয় কাজ করব ।” “ মরণ !” তীব্র গলায় মুখ ঝাড়া দেয় মালতী। “ হ্যাঁ গা তোমার কি বোধ বুদ্ধি কিছু নেই ? কিছুই বোঝ না ? বোঝো নি এত দিনেও ?” বোকার মত চেয়ে থাকে সুখেন। আবার হাসিতে ভেঙে পড়ে মালতী, “ ও লো ও শিখা। এই মানুষকে মন দিয়েছিস ? এ যে একেবারেই হাঁদা গঙ্গারাম রে !” কথাটা যেন মর্মে মর্মে বিঁধে যায় সুখেনকে। মন দিয়েছে ? কে ? শিখা ? ওকে ? এতক্ষণে, ওকে ডেকে আনা, শিখার ওরকম চেয়ে থাকা, মালতীর অকারণ হাসি, সব কিছুর মানে খুঁজে পায় ও। আর বিদ্যুৎপৃষ্টের। মত শিউরে ওঠে। শিখা ওকে ভালোবাসে ? ওকে ? কই কিছু বুঝতে পারে নি তো ও। চুপচাপ সবার পিছনে থাকত। হ্যাঁ সোজা সুজি সাহস ছিল না বলে আড়ে আড়ে দেখত। সেসব শিখা লক্ষ্য করেছে।