কুসুমের শরীরে যখন যৌবন এল তখন প্রস্ফুটিত পদ্মের মতোই তার সৌন্দর্য। চুলে কেশুত পাতা ঘষে দিত ঠাগমা। কালো ভ্রমরের মতো চুল ,আয়ত চোখ। ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রির ব্রত করে জল ঢালতে গিয়েছিল পলাশডাঙার টাটেশ্বর বাবার থানে। কী বিরাট মেলা বসেছিল। ওখানেই প্রথম দেখা হয়েছিল আশুতোষ এর সাথে। ঠাগমা বলেছিল “ভালো করে শিবরাত্রির বত্ত কর। ভালো বর হবে”।
সেবছর বাবা তারকনাথ সিনেমা হিট করেছে। ওই সিনেমার গান বাজছে “তিনি একটি বেলপাতাতে তুষ্ট”। ভক্তিপ্রেমি কুসুমকে দেখে ভালো লেগেছিল আশুতোষ এর। নতুন সাইকেল চেপে ,হাতে ঘড়ি বেঁধে বারবার কুসুমের জন্য আসছিল মন্দির চত্বরে।
পুজোর জন্য কাল থেকেই জোগাড় চলছিল। আগের দিনে রাতে নিরামিষ খেতে হয়। মহাদেব কে সন্তুষ্ট করা কী এমনি যায়? আগের দিন আলুসিদ্ধ দিয়ে যখন কুসুম ভাত মাখছিল ঠাগমা ঘি দিয়েছিল পাতে। বলেছিল “মুখ শুদ্ধু কর মা”। তারপর পরের দিন নিঢাল উপোস। কুসুমের তাতে কিছুই মনে হয়নি। সকালে পাঁচকড়ি নাপিতের বাড়ি গিয়ে অনেক আকন্দ ফুল এনেছে কুসুম। বুড়োশিবের জন্য বড়ো করে মালা গেঁথেছে। তারপর বেলপাতার মালা। দশটা টাকা দিয়েছিল ঠাগমা। তাতেই ঠাকুরের জন্য কলা আর সন্দেশ কিনেছে। পুজোর জন্য আলতাপেড়ে কাপড় পরেছিল কুসুম। কপালে লাল টিপ।চোখে কাজল। পাঁচকড়ি নাপিতের বউ আকন্দ ফুল দিয়ে বলেছিল “এসো ঠাকুরঝি। তোমার পায়ে আলতা পরাই।” একটা ঘটে ডাবের জল এর সাথে গরুর দুধ মিশিয়েছিল।তারসাথে সিদ্ধি। কিন্তু পুজো দিতে এসে কুসুম অস্থির হয়ে উঠল। ভুল করে মালা দুটো আনা হয়নি। কুসুমের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। এখন যদি আবার বাড়ি যেতে হয় তবে পুজোর দেরী হবে। কী করবে এখন! আশুতোষ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কুসুমের দিকে তাকিয়েছিল। একটা মায়া যেন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে। বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। কুসুমের কাছে এসে বলল “কী হল। মুখটা ভার কেন”? কুসুম কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল “মালা দুটো তুলসীর বেদীতে ফেলে এসেছি। তোমার তো সাইকেল আছে। একবার এনে দেবে তুমি”। আশুতোষ যেন এমন কিছুর অপেক্ষাতেই ছিল। বললে “অত ব্যাকুল হবার কী আছে? আমি এখনই এনে দিচ্ছি”। বিদ্যুত গতিতে আশুতোষ কার্যসম্পন্ন করল। আর কুসুমের মনটা জিতে নিল। আশুতোষ তো মহাদেবের নাম।আশুতোষ শশাঙ্কশেখর। কুসুমের জীবনে আশুতোষ এল। দুটি প্রাণ এক হতে চাইল। পুজো শেষে মেলাপ্রাঙ্গনে যখন কুসুম গেল তখন দেখলে কত তালপাতার পাখা বিক্রি হচ্ছে। নেড়ে চেড়ে দেখছিল পাখাগুলো। কত স্নিগ্ধ এই পাখার হাওয়া। গরমে শান্তি দেয়। আশুতোষ অমনি কুসুমের কাছে এসে একটা পাখা কিনে দিল। কুসুমের পয়সা নেই। আশুতোষ কুসুমের দিকে গভীর ভাবে চাইল।কিন্তু চাইলেই কি সব নিমেষে পাওয়া যায়। বিধাতা পুরুষ অলক্ষে হাসেন।
আশুতোষ রা কুসুমদের পাল্টি ঘর। আশুতোষ এর কবিতার খাতা ভরে উঠল কুসুমের জয়গানে। ফল্গুধারার মতো বয়ে চলল ওদের ভালোবাসা। আকাশ বাতাস সাক্ষী থাকল ওদের কাছে আসার। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না।দুই গাঁয়ের দুটি জীবনে চলে এল মধ্যবর্তিনী। একবার জমিতে জল দেওয়া নিয়ে কেষ্টর সাথে ঝগড়া হয়েছিল আশুতোষ এর পরিবারের। হাড়কেপ্পন কেষ্ট একরোখা। আশুতোষ যখন বললে কুসুম কে সে ভালোবাসে তখন শুরু হল হুলুস্থূল কান্ড। মা অন্ন মুখে তুললে না। আত্মহত্যার ভয় দেখালে। বললে “অমন ঘরের মেয়েকে ঘরে তুলতে পারব না। আমার গঙ্গাজলকে কথা দিয়েছি। তার মেয়েকে বউ করে আনব”। মায়ের পাল্লা ভারী হল। মাতৃভক্ত আশুতোষ বিয়ের পিঁড়িতে বসল। আর কুসুমের হৃদয়টা টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কতদিন পথ চেয়ে বসে থাকত কুসুম। সেই পথটা দিয়ে কত মানুষ চলেছে। তবুও আশুতোষ আর এল না। নারীত্বের এত বড় পরাজয় ঘটল কুসুমের। কিন্তু তার হৃদয়ের তন্ত্রীতে কে যেন বলে ভালোবাসার ভাসান হয় না। আশুতোষ তার নিজের। সে আসবেই।
আশুতোষ এখন ভরপুর সংসারী। ছেলেপুলের বাপ। পাঁচবছর পর কুসুমদের গাঁয়ে জমি দেখতে এসেছিল। এখানকার পরিবেশ সব যেন ওর মুখস্থ। বড় দু বিঘা জমির আলের মাথায় যে পাকুড় গাছ ওখানেই কুসুমের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিল ওরা। ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল আশুতোষ এর। কেমন আছে তার কুসুম। সেই শান্ত দীঘির মতো মেয়েটা। আজ আশুতোষ এর মনে হল সে ভীষণ অবিচার করেছে। এমন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছিল যে মেয়ে তাকে সে ঠকিয়েছে। নিশ্চয়ই খুব কেঁদেছে কুসুম। তারসাথে দেখা করার জন্য ব্যাকুল হল আশুতোষ। পাকুড় গাছের তলায় এসে দেখলে একটা তালপাতার পাখা। ভীষণ চেনা। সেই মেলায় কিনে দিয়েছিল সে কুসুম কে। আশান্বিত হল আশুতোষ। তাহলে কুসুম এখানেই আছে।
তারপরের ঘটনা তো সবার জানা। সেদিন হাটবামনার শীতলা মন্দিরে কুসুমের সিঁথি রাঙিয়ে দিয়েছিল আশুতোষ। বলেছিল “কুসুম। তুমি আমার ভালোবাসা। সমাজ কী বলল আমি জানি না। আমার হৃদয়েশ্বরী তুমি।” আবার কুসুম সেই শীতলা মন্দিরের চাতালে এসেছে। সঙ্গে তার একমাত্র ছেলে। আর সেই তালপাতার পাখাটা। শ্মশানে উঁচুনীচু নেই। এটাই বেশ হয়েছে।
শেতলার ঘরে গেল কুসুম। কত রঙ বেরঙের তালপাতার পাখা। কত স্নিগ্ধ তার হাওয়া। আর তার ছেলে কবিতা লিখছে। হেসে কুটিকুটি শেতলা। আবার হয়ত একটা গল্প শুরু হবে। তবে কুসুমের মতো এই গল্পের পরিসমাপ্তি হতে দেবে না কুসুম। আগের তালপাতার পাখাটার হাওয়া বিস্বাদময়। কুসুমের চোখে নোনাজল ঝরায়। নতুন তালপাতার পাখা ভীষণ স্নিগ্ধ আর আনন্দময়।