অসম বন্ধুত্ব
সুপর্ণা দত্ত
” হিং লিবে বাবু হিং, ভাল হিং আছে
পেস্তা আছে, আখরোট আছে, কিসমিস আছে”–
কাবুলিওয়ালার এই ডাক আজ আর শোনা যায় না,
দরজার পিছন থেকে কেউ আর উঁকিও মারে না।
মিষ্টি ভয়ার্ত কণ্ঠে কেউ ডাকে না,–
“কাবুলিওয়ালা ও কাবুলিওয়ালা”,
কেউ বলে না,”কাবুলিওয়ালা,তোমার ঝুলিতে কী আছে?”–
সেই সুদূর আফগানিস্তানের কাবুল থেকে আসত
বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাবসার কাজে।
আনত শুকনো ফল-পেস্তা, কাজু, খেঁজুর, কিসমিস,
আর থাকত ভাল হিং, ভাল আতর আনত কলকাতায়।
রহমত শেখ এমনই একজন কাবুলিওয়ালা,
ছোট্ট মেয়েকে ছেড়ে ব্যবসার জন্য কলকাতায় আসে।
এখানে গল্পের কথকের মেয়ে,মিনির সাথে তার আলাপ হয়,
মিনির মধ্যে দেশে থাকা নিজের মেয়ে, পার্বতীকে অনুভব করে।
প্রথম প্রথম মিনির ভয় লাগলেও কিছুদিনের মধ্যে
মিনির বাবার সৌজন্যে দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে দারুণ বন্ধুত্ব।
রহমত কিসমিস,আখরোট নিয়ে আসত মিনির জন্য,
মিনির গান শুনে,নাচ দেখে রহমত আনন্দ পেত,
কত গল্প হত দুজনের, হাতির গল্প, শ্বশুর বাড়ির গল্প,
একদিন দেশে মেয়ের অসুখের কথা জানতে পারল রহমত,
সুদে খাটানো টাকা সংগ্রহ করে দেশে যাবে ঠিক করল,
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস সেই সরল মানুষটা বুঝতে পারেনি,
এক ঠগ্ টাকা দিতে না চাওয়ায় লেগে গেল হাতাহাতি।
দুর্ভাগ্যক্রমে রহমতের হাতে প্রাণ হারালো লোকটি
তার কোমড়ে দড়ি পড়ল,দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল।
ভাল ব্যবহারের জন্য শাস্তির সময় সীমা কমে যায় তার,
আট বছর পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সে গেল মিনির কাছে,
চৌদ্দ বছরের মিনিকে কনের সাজে দেখে সে হতবাক,
দেশে পার্বতীও আজ ঠিক এতটাই বড় হয়েছে,
সেও বুঝি মিনির মত শ্বশুর ঘরে চলে গেছে!
মেয়ের জন্য তাকে উতলা হতে দেখল যেই মিনির বাবা
টাকা হাতে দিয়ে দেশে ফিরে যেতে বললেন রহমতকে।
কথক দীনদয়াল ভেবেছিলেন সেদিন মনে মনে
“সেও যে আমিও সে,সেও পিতা আমিও পিতা”।–
কাবুলিওয়ালা আর মিনির মধ্যে গড়ে উঠেছিল
অসম বয়সী এবং ভিন্ন জাতের এক মিষ্টি বন্ধুত্ব।
তাদের সেই বন্ধুত্বকে সবাই ভাল মনে মেনে নেয়নি।
তারা ভাবত কাবুলীয়া ভাব জমিয়ে মিনিকে দেশে নিয়ে যাবে,
অনেকেই ভাবত খোঁজ খবর নিয়ে হয়তো ডাকাতি করবে।
মিনির মাও তাই ভয়ে ভয়ে থাকত কখন কোন বিপদ ঘটে,
কিন্তু যখন জেল ফেরত কাবুলীয়া তাদের দেখিয়েছিল
বুক পকেটে রাখা পার্বতীর কালি মাখানো দুটি হাতের ছাপ
বুঝেছিল সবাই সেদিন তারও অন্তরে লুকিয়ে আছে এক পিতা।
বন্ধুত্বের কোনো বয়স সীমা হয় না, হয় না কোনো জাতিভেদ,
দুটি সরল মনের কিছু মিল বিষয় গড়ে তোলে বন্ধুত্বের মেল বন্ধন,
তাতে কোনো স্বার্থ থাকে না, থাকে না কোনো বিদ্বেষ,
থাকে শুধুই দুটি মনের নিরলস সরলতার আবেশ।।
—oooXXooo—