***অরিত্র সেনগুপ্তের মৃত্যু***
নবু
কলকাতার প্রখ্যাত শিল্প সংগ্রাহক শ্রী অরিত্র সেনগুপ্তের মৃত্যু নিয়ে শহরে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর বিরল ও মূল্যবান চিত্রকর্মের বিশাল সংগ্রহের জন্য তিনি সুপরিচিত ছিলেন, এবং এই সংগ্রহের মধ্যে বহু অনন্য শিল্পকর্ম ছিল যা পৃথিবীর খুব কম মানুষই দেখার সুযোগ পেয়েছে। সারা জীবন ধরে তিনি এই চিত্রকর্মগুলোকে সযত্নে রক্ষা করেছেন, যেন তারাই তার জীবনের আসল সঙ্গী।
একদিন সকালে, শ্রী সেনগুপ্তকে তার নিজের ষ্টুডিয়ো ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা শিল্পকর্মের মধ্যে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত ছিলেন। প্রথমে পুলিশ ঘটনাটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে ধরে নেয়, কারণ তার বয়স এবং শারীরিক অবস্থার বিবেচনায় তারা এটিকে একটি হার্ট অ্যাটাক হিসাবে চিহ্নিত করে। কিন্তু শ্রী সেনগুপ্তের একমাত্র কন্যা অনন্যা এই সহজ ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
অনন্যার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। তার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন মানুষ। এমনকি সাম্প্রতিক সময়েও তিনি বেশ সক্রিয় ছিলেন এবং তার বাবার আচরণে কোনরকম পরিবর্তন লক্ষ করেননি তিনি। তাছাড়া, তার বাবার মৃত্যুর পরের কিছু ঘটনা আরও সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছিল।
অনন্যা ঠিক করেন যে, তার বাবার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে হবে। আর এর জন্য তিনি নিয়োগ করেন শহরের প্রখ্যাত ব্যক্তিগত গোয়েন্দা অমিত সেনকে। অমিত একসময় কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত ছিলেন, তার অসাধারণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জন্য সুপরিচিত। এখন একজন ব্যক্তিগত গোয়েন্দা হিসেবে, ইতিমধ্যে তিনি বহু জটিল মামলার সমাধান করেছেন।
অমিত সেন যখন শ্রী অরিত্রো সেনগুপ্তের ষ্টুডিও ঘরে পৌঁছালেন, তখন প্রথমেই তাঁর নজর কাড়ে ঘরের সুশৃঙ্খল অবস্থা। সমস্ত কিছুই বেশ গোছানো এবং স্থির বলে মনে হয়। কিন্তু একজন পাকা গোয়েন্দার মতোই, অমিত অতি সূক্ষ্ম অস্বাভাবিকতা গুলির প্রতি মনোযোগ দিতে থাকেন, যা সাধারণ মানুষের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।
দেওয়ালে ঝোলানো চিত্রকর্মগুলি একটু ট্যারা হয়ে রয়েছে, যা দেখে অমিতের মনে সন্দেহ জাগে। একজন সুপরিচিত শিল্প সংগ্রাহক, যার জীবনের অন্যতম সেরা সংগ্রহগুলি এই ঘরে প্রদর্শিত হয়, তিনি নিশ্চয়ই এমন অব্যবস্থা মেনে নিতে পারেন না। তার চিত্রকর্মগুলি এমনভাবে ট্যারা হয়ে থাকবে, এটা ভাবাই যায় না।
এরপর তাঁর নজরে পড়ে ঘরের এক কোণে একটি ড্রয়ারের দরজা সামান্য খোলা রয়েছে। সাধারণত এই ড্রয়ারটি তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকার কথা। তিনি ড্রয়ারটি পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন, সেটিতে কোনো জোরপূর্বক খোলার চিহ্ন নেই, কিন্তু ড্রয়ারের ভেতরে থাকা কাগজপত্রগুলি যেন তাড়াহুড়োর মধ্যে সরানো হয়েছে। এতে তাঁর সন্দেহ আরও গভীর হয়।
ঘরের জানলার কাঁচ সামান্য ভাঙা। অমিত জানলার কাঁচের দিকে ভালোভাবে নজর দিয়ে দেখেন যে, সেটি বাইরে থেকে ভাঙা হয়েছে। এটা যে সাধারণ কোনো দুর্ঘটনা নয়, তা বোঝা যায়। তিনি জানলার আশপাশের মেঝেতে কিছু ছোটো কাচের টুকরোও খুঁজে পান, যা নিশ্চিত করে যে কেউ বাইরে থেকে প্রবেশের চেষ্টা করেছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল দেয়ালের ঘড়ি, যা ৫টাবেজে ৩ মিনিটে বন্ধ হয়ে রয়েছে। তবে অমিতের ধারনা যে, এই ঘড়িটি গতকাল রাতেও ঠিকমতো চলছিল। ঘড়ির এই অস্বাভাবিক বন্ধ হয়ে যাওয়া সময়কে তিনি খেয়াল করেন এবং সেটিকে সম্ভাব্য হত্যার সময় হিসেবে ধরে নেন।
এই ছোটো ছোটো অস্বাভাবিকতা অমিতকে ভাবতে বাধ্য করে যে, ঘটনাটি যতটা সরল মনে হচ্ছে, আসলে ততটা নয়। ঘরের এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলি একটি বড় রহস্যের ইঙ্গিত দেয়, যার চাবিকাঠি সম্ভবত এই ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। অমিত তার তদন্তের কাজ শুরু করেন, একে একে এই সমস্ত সূত্রগুলোকে একত্রিত করে একটি পরিষ্কার ছবি তৈরি করার চেষ্টা করেন।
অমিত অরিত্রো সেনগুপ্তের একমাত্র মেয়ে অনন্যার সঙ্গে কথা বলেন এবং তার বাবার সাম্প্রতিক জীবন সম্পর্কে খুটি নাটি জানতে চান। অনন্যা জানায়, তার বাবা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কিছুটা অস্থির ছিলেন। কিন্তু তিনি কখনও তার মনের দুশ্চিন্তার কথা আমার কাছে প্রকাশ করেননি। অনন্যা আরও জানান যে তার বাবা সম্প্রতি একটি বিরল চিত্রকর্ম সংগ্রহ করেছিলেন, যেটি নিয়ে তিনি খুবই উত্তেজিত ছিলেন।
অমিত সেনগুপ্ত পরিবারের পুরানো পরিচারক এবং অন্যান্য কর্মচারীদের সাক্ষাৎকার নেন। তাদের মধ্যে কেউই কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা লক্ষ করেনি, তবে একজন কর্মচারী উল্লেখ করেন যে, শ্রী সেনগুপ্তের মৃত্যুর দিন দু’দিন আগে এক অচেনা লোক তাকে দেখতে এসেছিল। লোকটি কিছুক্ষণ ষ্টুডিওতে ছিলেন এবং তারপর দ্রুত চলে যায়। শ্রী সেনগুপ্ত সেই লোকটি সম্পর্কে কাউকে কিছু জানাননি, এবং এর পর থেকেই তিনি আরও বেশি অস্থির হয়ে ওঠেন।
অমিত সেন দ্রুতই বুঝতে পারেন যে শ্রী অরিত্রো সেনগুপ্তের মৃত্যুর ঘটনা শুধুমাত্র একটি স্বাভাবিক হার্ট অ্যাটাকের চেয়ে অনেক বেশি জটিল হতে পারে। দৃশ্যত মনে হচ্ছে সবকিছু স্বাভাবিক, কিন্তু এই ঘরের অস্বাভাবিকতা এবং ছোটো ছোটো সূত্রগুলো অমিতকে ইঙ্গিত দেয় যে এখানে অন্য কিছু ঘটেছে।
তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে এই ঘটনার গভীরে লুকিয়ে থাকা সত্যগুলোকে উদ্ঘাটন করতে হলে তাকে আরও গভীর তদন্ত করতে হবে। ঘড়ির অস্বাভাবিক বন্ধ হয়ে যাওয়া সময়, চিত্রকর্মগুলির ট্যারা অবস্থান, ড্রয়ারের সামান্য খোলা দরজা, ভাঙা জানলার কাঁচ—এই সবকিছুই একটি নিখুঁত রহস্যের অংশ। তবে যেই এই কাজ করে থাকুক না কেন সে অনেক সাবধানী মানুষ।
অমিত তার গোয়েন্দাগিরির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রতিটি সূত্রকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। সে জানে যে এই ছোট ছোট অস্বাভাবিকতা একত্রিত করলে একটি বৃহৎ পরিকল্পনার চিত্র উঠে আসবে। এই উপলব্ধি তার মধ্যে আরও দৃঢ় সংকল্প সৃষ্টি করে। শ্রী সেনগুপ্তের মৃত্যুর আসল কারণ খুঁজে বের করাই এখন অমিতের একমাত্র লক্ষ্য।
অমিত তার তদন্তের ধারাকে আরও প্রশস্ত করেন। তিনি শ্রী সেনগুপ্তের পারিবারিক ইতিহাস, তার আর্থিক লেনদেন, এবং তার সংগ্রহের মধ্যে থাকা শিল্পকর্মগুলির প্রামাণিকতা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন। এই সমস্ত প্রমাণগুলোকে একসাথে জুড়ে, তিনি একটি জটিল পরিকল্পনার মধ্যে ঢুকে পড়েন, যা শুধুমাত্র শ্রী সেনগুপ্তের সংগ্রহ নয়, বরং তার জীবনকেও সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত করেছে।
এই তদন্তের প্রতিটি ধাপই অমিতকে সত্যের কাছাকাছি নিয়ে আসে, এবং তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন যে, এই রহস্যের আসল কারণ উদ্ঘাটন করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন।
অমিত সেন যখন শ্রী অরিত্রো সেনগুপ্তের মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন করতে আরও গভীরে প্রবেশ করেন, তখন তিনি দ্রুত উপলব্ধি করেন যে এটি একটি সাধারণ হত্যাকাণ্ডের চেয়েও অনেক বেশি জটিল। শ্রী সেনগুপ্তের মৃত্যু ঘিরে থাকা ঘটনাগুলি একটি বৃহত্তর চক্রান্তের ইঙ্গিত দেয়, যা জাল শিল্পকর্ম, লুকানো ঋণ, এবং শিল্প জগতের গোপন দ্বন্দ্বের সাথে এই হত্যা রহস্য নিবিড়ভাবে জড়িত।
তদন্তের শুরুতেই অমিত খেয়াল করেন যে ঘটনাটি সঠিকভাবে বোঝার জন্য তাকে শুধু সরল উত্তর খুঁজে পাওয়ার বাইরে গিয়ে অনেক গভীরে অনুপ্রবেশ করতে হবে। প্রথমে মনে হয়েছিল শ্রী সেনগুপ্তের মৃত্যু শুধুমাত্র একটি দুর্ঘটনা, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে প্রতিটি ব্যক্তিরই এখানে একটি লুকানো উদ্দেশ্য আছে। তবে সেই উদ্দেশ্যগুলি অতি সূক্ষ্মভাবে গোপন রাখা হয়েছে, যা অমিতের জন্য এই রহস্য সমাধানকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।
শ্রী সেনগুপ্তের বিশাল শিল্প সংগ্রহ, তার আর্থিক অবস্থা এবং তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা অমিতকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ দেয়। তিনি বুঝতে পারেন যে, এই সংগ্রহের প্রতিটি চিত্রকর্মই একটি নির্দিষ্ট মূল্য বহন করে, এবং সেই মূল্য শুধুমাত্র আর্থিক নয়, বরং কিছু ব্যক্তিগত ও গোপনীয় বিষয়ের সাথেও জড়িত।
অমিতের কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যারা এই জাল শিল্পকর্মের জগতে জড়িত, তারা যে শুধু নিজের আর্থিক লাভের জন্য কাজ করছে তা নয়, বরং এই সংগ্রহের পিছনে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করাও তাদের উদ্দেশ্য। প্রতিটি চিত্রকর্মের পিছনে থাকা গল্প, ঋণের চাপ, এবং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে অমিতকে এমন একটি জটিল গোলকধাঁধার সামনে দাঁড় করায়, যেখানে প্রতিটি মোড়ে মিথ্যার জাল বিস্তৃত।
অমিত একটু ভাল করে লক্ষ করে যে দেওয়ালে যে ছবিগুলো ঝুলছে তার মধ্যে একটা ছবি বেশ পুরান বা প্রাচীন শিল্প, তার ঐতিহাসিক মূল্য অবশই আছে।
অমিত যখন শ্রী অরিত্রো সেনগুপ্তের সংগ্রহের রহস্যময় চিত্রকর্মটি নিয়ে আরও বিস্তারিত তথ্যের সন্ধান করতে শুরু করেন, তখন তিনি দ্রুত বুঝতে পারেন যে, এই বিশেষ শিল্পকর্মটির পেছনের ইতিহাস এবং শিল্পীর চিন্তা ধারা সম্পর্কে জানতে না পারলে তার গবেষণা অসম্পূর্ণ থাকবে। তাই, তিনি গৌর মৌলির দিকে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ান। গৌর বাবু, যিনি কেবল একজন উচ্চতর ইতিহাসবিদই নন, বরং একজন সুপরিচিত চিত্রশিল্পী হিসেবেও পরিচিত, তার শিল্পকর্মগুলি বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে এবং বহু বছর ধরে তিনি পুরনো শিল্পকর্ম ও ইতিহাসের গভীরে ডুব দিয়েছেন।
গৌর বাবুর সাথে আলাপচারিতার সময় অমিত বুঝতে পারে যে, ইতিহাসের প্রতি গৌর বাবুর এই গভীর আকর্ষণ শুধুমাত্র তার পেশাগত জীবনেরই অংশ নয়, বরং এটি তার অন্তরের গভীরে বাসা বেঁধেছে। তিনি অমিতকে বলেন, “একটি চিত্রকর্ম কেবল রং এবং ক্যানভাসের সমন্বয় নয়; এটি একটি সময়, স্থান এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন।” তিনি আরো বলেন “প্রতীতি শিল্প এক-একটি ইতিহাস। ছবি সবসময় কথা বলে। শুধু শোনার কণ থাকলেই টা যে কেউ শুনতে পারবে।
এই কথা শুনে অমিতের মনে সন্দেহের সংস্কারের স্থান তৈরি করে দিয়েছিল। গৌর বাবু তার জ্ঞান দ্বারা অমিতকে সাহায্য করতে রাজি হয়ে আরো বলেন, “আপনি যদি সত্যিকারের এই শিল্পকর্মের সৌন্দর্য এবং তাৎপর্য বুঝতে চান, তাহলে আপনাকে এর সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে গবেষণা করতে হবে।” গৌর বাবুর এই পরামর্শে অমিত যেন নতুন করণে প্রেরণা পায় এবং তাদের আলাপচারে গৌর বাবুর প্রস্তত করা বিভিন্ন বই ও নিবন্ধের আলোকে গবেষণার একটি নতুন দিশা খুঁজে পায়।
তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন যে, এই রহস্যময় চিত্রকর্ম এবং এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গভীরভাবে ভেবেচিন্তে লেখালেখি করবেন, যা কেবল প্রদর্শনীর জন্য নয়, বরং শিল্পের কোণে থাকা সেই গভীরতম অনুভূতির প্রকাশও করবে আগামী দিনে।
অমিতের কাছ থেকে চিত্রকর্মটি দেখার পর গৌর বাবু স্মৃতির পাতা উল্টে বলেন, “এই ছবিটি আমি একবার দেখেছিলাম, কলকাতার একটি পুরনো চার্চে। তবে তা আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে।” যখন তিনি একজন চিত্র শিক্ষা-নবিস ছিলেন, তিনি ছবিটির প্রতিটি সূক্ষ্মতা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তার অভিজ্ঞতার আলোকে নিশ্চিত করেন যে এটি একটি আসল চিত্রকর্ম।
গৌর বাবু আরও বলেন, “এই ছবিটির ফ্রেম দেখেই বোঝা যায় যে এটি অনেক বছর আগের তৈরি। এত নিখুঁত কারিগরি আজকাল দেখা যায় না। আর সেই কারণেই আমি নিশ্চিত যে এই ছবিটি আসল। তবে, এমন একটি দুর্লভ শিল্পকর্ম এখানে কীভাবে এল, তা নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন রয়েছে।”
অমিত গৌর বাবুর বিশ্লেষণ শুনে বুঝতে পারেন যে শ্রী সেনগুপ্তের সংগ্রহে থাকা এই চিত্রকর্মের গুরুত্ব অনেক বেশি, এবং সম্ভবত এটি তার মৃত্যুর কারণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই চিত্রকর্মটির অতীত, তার প্রাচীনতা, এবং এর সাথে জড়িত রহস্য উদঘাটন করলেই হয়তো গোটা ঘটনার আসল সত্য প্রকাশ পাবে।
গৌর বাবুর কাছ থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার পর অমিত আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। তিনি এখন বুঝতে পারেন যে শুধুমাত্র এই ছবিটির উৎস নয়, বরং তার চারপাশে জড়িত সমস্ত ইতিহাসই তার তদন্তের কেন্দ্রে রয়েছে।
অমিতের জন্য এই কেসটি শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নয়, বরং একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের পর্দা উন্মোচন। তাকে প্রতিটি পদক্ষেপ খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে, কারণ এই পথে প্রতিটি ভুল পদক্ষেপ তার জন্য বিপদজনক হতে পারে। তবু, অমিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে তিনি এই জটিল রহস্যের সত্য উদ্ঘাটন করবেন এবং শ্রী সেনগুপ্তের মৃত্যুর আসল কারণ প্রকাশ করবেন।
তদন্তের প্রথম ধাপে, অমিত জানতে পারে যে শ্রী সেনগুপ্ত কিছুদিন ধরে আর্থিক সমস্যায় ভুগছিলেন। যদিও তার জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি, তবে তিনি প্রচুর ঋণে জর্জরিত ছিলেন, যা তার মৃত্যুর পরও গোপন রাখা হয়েছিল। ঋণের কারণে শ্রী সেনগুপ্তের ওপর যে চাপ ছিল, তা সম্ভবত তার অস্থিরতার একটি বড় কারণ।
এদিকে, অমিত বিভিন্ন শিল্প সংগ্রাহক এবং সমালোচকদের সাক্ষাৎকার নেয়, যারা শ্রী সেনগুপ্তের সংগ্রহ নিয়ে আগে থেকেই ঈর্ষান্বিত ছিল। এইসব সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে অমিত বুঝতে পারে যে শ্রী সেনগুপ্তের বিরল চিত্রকর্মের সংগ্রহ শুধুমাত্র প্রতিযোগীদেরই নয়, কিছু পুরনো শত্রুকেও আকর্ষণ করেছিল।
কিন্তু মামলাটি সবচেয়ে বড় মোড় নেয় যখন শ্রী সেনগুপ্তের সংগ্রহের একটি দ্বিতীয়, অভিন্ন চিত্রকর্ম আবিষ্কৃত হয়। এটি প্রথমে একটি অনুরূপ শিল্পকর্ম বলে মনে হলেও, অমিতের সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ধরা পড়ে যে দুটি চিত্রকর্মে কিছু ছোটখাটো পার্থক্য রয়েছে। এটির অর্থ এই যে, শ্রী সেনগুপ্তের আসল সংগ্রহের একটি শিল্পকর্ম হয়ত জাল ছিল, বা হয়তো তার সংগ্রহের কোনো নির্দিষ্ট শিল্পকর্মের একটি প্রতিরূপ তৈরির প্রচেষ্টা হয়েছিল।
এই নতুন আবিষ্কার সত্যতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়গুলি সামনে আনে। অমিত তখন ভাবতে শুরু করে যে, যদি শ্রী সেনগুপ্ত বুঝতে পেরে থাকেন যে তার মূল্যবান সংগ্রহের কোন একটি জালিয়াতি করা হয়েছে, তবে সেই সত্যই তাকে মারাত্মক আঘাত দিয়েছে এবং হয়তো তা-ই তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
অমিত বুঝতে পারে যে, এই চিত্রকর্মটি হয়তো শ্রী সেনগুপ্তের জীবনের কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বের সাথে জড়িত ছিল। হয়তো এটি ছিল একটি হুমকি, একটি প্রতারণা বা একটি ব্যক্তিগত প্রতিশোধ। অমিতের সামনে এখন বহু পথ খোলা, এবং তাকে এই জটিল জালটিকে ভেদ করে সত্য উন্মোচন করতে হবে।
তারপর, অমিত শুরু করে এই জাল শিল্পকর্মের উৎস এবং এর সাথে জড়িত সম্ভাব্য অপরাধীদের খোঁজ। বিভিন্ন সম্ভাবনার মধ্যে অমিত এক এক করে তাদের মুখোমুখি হয়, যাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে, কিন্তু কোনটাই পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে তাকে সত্যের দিকে নিয়ে যায় না। মামলাটি আরও জটিল হয়ে ওঠে, কারণ প্রতিটি সূত্রই তাকে একের পর এক ভুল পথে পরিচালিত করতে থাকে।
অবশেষে, সত্য উদঘাটনের জন্য অমিতকে তার বুদ্ধিমত্তা, অভিজ্ঞতা এবং সংবেদনশীলতা ব্যবহার করে আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করতে হবে, যিনি শ্রী সেনগুপ্তের সংগ্রহের মূল্যবান চিত্রকর্মকে জাল করে এবং তার মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন।
অমিতের জন্য, শ্রী অরিত্রো সেনগুপ্তের রহস্যময় মৃত্যু একটি সাধারণ তদন্ত নয়; এটি ছিল একটি জটিল এবং বিপজ্জনক যাত্রা, যা মিথ্যার গোলকধাঁধায় তাকে আটকে দিয়েছিল। প্রতিটি নতুন তথ্য কেবল রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে তোলে, এবং সত্যকে আড়াল করার জন্য যেন একের পর এক মিথ্যা, ধোঁকা এবং ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হয়েছে।
তদন্তের সময়, অমিত বেশ কয়েকটি রহস্যময় বার্তার মুখোমুখি হয়, যা তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। সেই বার্তাগুলিতে কিছু গুপ্ত সংকেত ছিল, যা বোঝা কঠিন হলেও, অমিতের অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে। প্রতিটি বার্তা যেন তাকে জানিয়ে দেয় যে, তার কাজ যতটা সহজ মনে হচ্ছে, আসলে ততটা নয়। এই বার্তাগুলির মাধ্যমে অমিতের সামনে উদ্ভাসিত হয় যে, শ্রী সেনগুপ্তের মৃত্যুর পেছনে আছে আরও গভীর কিছু, যা কেবল অর্থ, জাল শিল্প বা ব্যক্তিগত শত্রুতার চেয়েও বড়।
অমিতের বুদ্ধিমত্তা এবং সংকল্প তাকে বুঝিয়ে দেয় যে, রহস্যের চাবিকাঠি একটি ভুলে যাওয়া শিল্পের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। সেই শিল্পটি হয়তো সবার নজরের বাইরে চলে গিয়েছিল, কিন্তু সেটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক গভীর ইতিহাস এবং সত্য। সেই শিল্পের অর্থ বুঝতে পারলে, অমিত পুরো ধাঁধাটি সমাধান করতে পারবে। কিন্তু সেই সত্য উদঘাটন করতে হলে, তাকে বিপজ্জনক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হবে, যারা এই সত্যকে গোপন রাখতে মরিয়া।
ঘড়ির কাঁটা চলতে থাকে, এবং অমিতের সামনে দুটি পথ খোলা থাকে—একদিকে সত্য উদঘাটন, যা হয়তো তার নিজের জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে, আর অন্যদিকে মিথ্যার গোলকধাঁধা, যেখানে ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু অমিত বুঝতে পারে যে, এই রহস্যের সমাধান করতে গেলে তাকে চরম মূল্য দিতে হবে—হয় সেটি তার পেশাগত জীবন শেষ হয়ে যাবে, অথবা তার নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
অমিত যখন গঙ্গার পাড় দিয়ে কুমার্টুলির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ একটি স্টুডিয়োর শোকেসের দিকে তার নজর পড়ে। তার চোখ চমকে ওঠে—যেখানে শিল্পকর্মটির প্রতিচ্ছবি একটি সোনালী ফ্রেমে ঝুলছে। এটি সে এতদিন ধরে অনুসন্ধান করছিল। ফ্রেমটির সাথে তার পরিচিতি দ্রুত তার মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কারণ এটি ঠিক সেই চিত্রকর্ম, যা এক সময় শ্রী অরিত্রো সেনগুপ্তের সংগ্রহে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অমিত অবিলম্বে দোকানে ঢোকে। সেখানে উপস্থিত একজন তরুণ শিল্পী তাকে স্বাগত জানায়। তরুণটি জানায় যে ছবিটি একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে কিনে আনা হয়েছে এবং বিক্রির জন্য প্রদর্শিত হচ্ছে। অমিত তরুণটির কাছে ছবিটির উৎস সম্পর্কে জানতে চায়। তরুণটি জানায় যে ছবিটি কিছুদিন আগে স্থানীয় একটি নিলাম থেকে কেনা হয়েছিল এবং তার সাথেই তার কিছু নথি রয়েছে।
অমিত দ্রুত নথিগুলি পরীক্ষা করে দেখে যে ছবির উৎস সম্পর্কে কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য নেই। কিন্তু তার চোখে পড়ে, ছবির সাথে সংযুক্ত একটি নাম—মিস্টার শানকর চক্রবর্তী, একজন শিল্প সংগ্রাহক যিনি কিছু সময় আগে একটি স্থানীয় শিল্প নিলামে উপস্থিত ছিলেন।
এটি অমিতকে নতুন সূত্র প্রদান করে। মিস্টার শানকর চক্রবর্তীর সাথে যোগাযোগ করার পর, অমিত জানতে পারে যে তিনি ছবিটি একটি বিশেষ সংগ্রহ থেকে কিনেছিলেন, যা একটি পুরানো শিল্পী পরিবারের মালিকানাধীন ছিল।
অমিত পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে শানকর চক্রবর্তীর সাথে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নেয়, আশা করে যে এই সাক্ষাৎ আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করতে পারে যা শ্রী সেনগুপ্তের মৃত্যুর পেছনের রহস্য উন্মোচনে সাহায্য করবে।
অমিত সেন গঙ্গার পাড় ধরে কুমার্টুলির সেই স্টুডিওর সামনে দাঁড়িয়ে, ছবির দিকে একপলক তাকাচ্ছিলেন। শিল্পকর্মটির সেই সোনালী ফ্রেম আর ক্যানভাসে আঁকা ছবির বর্ণনা তার মনের মধ্যে গেথে গিয়েছিল। মিস্টার শানকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর, অমিত জানতেন যে রহস্যের শেষ বাঁকটির সামনে সে এসে দাঁড়িয়েছে।
মিস্টার শানকরের অফিসে পৌঁছানোর পর, অমিত তাকে সাবধানীভাবে জিজ্ঞাসা করলেন। শানকরের চোখে কিছুটা উদ্বেগ, কিছুটা উদ্বিগ্নতা ধরা পড়েছিল। “এই ছবির পিছনে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে,” শানকর বললেন। “আমি এই ছবিটি কিনেছিলাম একটি বিশেষ সংগ্রহ থেকে, যা একটি পুরনো শিল্পী পরিবারের কাছ থেকে এসেছে। কিন্তু কিছুদিন পর, আমি জানতে পারি যে এই পরিবারটির মধ্যে একটি গোপন কেলেঙ্কারি ছিল। তারা একটি মূল্যবান ছবি বিক্রি করে দেয় যাতে তাদের কিছু পুরানো ঋণ পরিশোধ করা যায়।”
অমিত কিছুক্ষণ চিন্তা করল। “তাহলে এই ছবিটি কেন আবার এখানে, এবং কেন এর সাথে জড়িত সমস্ত ব্যক্তিদের এতকিছু?”
“ছবিটি অনেক দিন আগে ওই পরিবারের কাছ থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল। এরপর, আমি এটি একটি নিলাম থেকে কিনেছিলাম,” শানকর ব্যাখ্যা করলেন। “এর পরে, জানতে পারি যে কিছু লোক ছবির সঙ্গে জড়িত ছিল, এবং এটি তাদের জন্য একটি ক্ষমার অযোগ্য পথ ছিল। আমি আসলে ছবিটি কেনা থেকে কিছু সময় আগে, একজন নামী শিল্প সংগ্রাহক এই ছবির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।”
অমিত শানকরের কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। “এটি নিশ্চিত করে যে ছবিটি এখনও একটি গোপন রহস্য ধারণ করছে। মিস্টার সেনগুপ্তের মৃত্যুর সাথে এর যোগসূত্র খুবই গভীর,” অমিত বললেন।
অমিত, শানকরের কাছ থেকে ছবির মালিকানার সমস্ত নথি সংগ্রহ করে এবং সেগুলি পরীক্ষা করে দেখেন। কিছুদিন পরে, তিনি প্রমাণ করলেন যে ছবির মালিকানা সংক্রান্ত সব তথ্য মিথ্যা ছিল। আসলে, শ্রী সেনগুপ্তের মৃত্যু ছিল একটি পরিশ্রমী প্রতারণার ফল, যা সেই পুরনো শিল্পী পরিবার এবং তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য এটি জাল করেছিল।
অমিতের তদন্ত শেষে, এই চিত্রকর্মের আসল প্রকৃতি প্রকাশ্যে আসে। শ্রী সেনগুপ্তের মৃত্যুর পেছনে আসল উদ্দেশ্য ছিল চিত্রকর্মের মালিকানা এবং তার মূল্যবান সংগ্রহের অংশ হিসেবে অবৈধভাবে লাভ অর্জন। রহস্যের অবসান ঘটে এবং সমস্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের দায়িত্বের মুখোমুখি হয়।
অমিত সেনের মেধা এবং নিষ্ঠা আবারও প্রমাণিত হয়, এবং শহর কলকাতার শিল্প জগতে এক নতুন সূচনা ঘটে। তার তদন্তের মাধ্যমে, তিনি শুধু একটি রহস্যের সমাধানই করেননি, বরং মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং প্রতারণার গহীন গভীরতাও অন্বেষণ করেছেন। শহরটির মানুষের কাছে, অমিত এক প্রতিভাবান গোয়েন্দারূপে পরিচিত হয়ে ওঠেন, যিনি সঠিক এবং সত্যিকার বিচার নিশ্চিত করতে সবসময় প্রস্তুত।
তথ্য সুত্র – নবু।
—oooXXooo—