আনন্দ রূপং অমৃতম্ যদ্বিভাতি
………………………………………
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
১৮৮২, ৫ই অগস্ট একটি মনোরম সন্ধ্যাকাল। ইতিহাস বদলাচ্ছে একটু একটু করে। গঙ্গার পাশে ইংরেজের কেল্লার পাশাপাশি বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতেও একটি কেল্লা তৈরী হচ্ছে। আর সেখানকার সৈন্যসামন্তরাও সব প্রস্তুত হচ্ছেন আগামীদিনের ভারতবর্ষের জন্য। এদের মধ্যে লালচক্ষু রোহিত মৎস্যের মত একটি যুবক সবার মাথা ছাড়িয়ে উঠছেন। কেল্লার রাজা শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে আদর করে ” লরেন” বলে ডাকেন। ছেলেটি সিমলে পাড়ার ছেলে। বিদ্যাসাগর মশাইএর মেট্রোপলিটন ইস্কুলে সদ্য একটি মাস্টারীর কাজ পেয়েছে সে।
আজ সন্ধ্যায় সেই ঐশী প্রেমের রাজাটি তাঁর রথে চেপে যাচ্ছেন বাদুড়বাগানে এক জ্ঞানের রাজার সাথে দেখা করতে। ভক্তিযোগ আজ কেমন করে জ্ঞানযোগে মেশে সেটা দেখতেই সবাই ভীষণ উদগ্রীব।
কেরাঞ্চিগাড়িটি বিকেল বিকেল দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ি থেকে বের হল। ঘন্টাখানেক পরে শ্যামবাজার পার করে ক্রমে আমহার্স্ট স্ট্রীটে এসে পড়ল। আজ বিদ্যাসাগর দর্শনে শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে একই গাড়িতে আছেন ভবনাথ, হাজরা মশাই আর মাস্টার মহেন্দ্রনাথ। ভক্তেরা বলছেন এইবার বাদুড়বাগানের কাছে এসে গেছি। ঠাকুর বালকের আনন্দে হাসিমুখে সারাটা রাস্তা গল্প করতে করতে এসেছেন। আমহার্স্ট স্ট্রীটে এসে হঠাৎ তাঁর ভাবান্তর হল, যেন একটু আত্মমগ্ন হবার উপক্রম। গাড়ি তখন রামমোহন রায়ের বাগানবাড়ির কাছ দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় মাস্টার ঠাকুরকে দেখালেন – ” ওই যে দেখুন ! এইটি রামমোহন রায়ের বাটী।”
ঠাকুর বিরক্ত হলেন; বললেন, “এখন ও-সব কথা ভাল লাগছে না।”
আসলে ঠাকুর ততোক্ষণে আপনমনে ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েছেন।
…………………
বিদ্যাসাগরের বাড়িটির সামনে অবশেষে গাড়ি এসে দাঁড়াল। বাড়িটি দোতলা ও ইংরেজী ছাঁদে তৈরী। জমির মাঝখানে মূল গৃহটি ওষতায চতুর্দিকে প্রাচীর। আর বাড়ির পশ্চিমধারে সদর দরজা ও ফটক। ফটকটি আবার দক্ষিণদিকে। পশ্চিমের প্রাচীর ও দোতলা বাড়ির মাঝে বেশ কিছুটা কেয়ারি করা বাগান।এই পশ্চিমদিকের নিচের ঘর থেকেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়। উপরে বিদ্যাসাগর থাকেন। সিঁড়ি দিয়া উঠেই উত্তরে একটি ঘর, তার পূর্বদিকে হলঘর। এই হলের দক্ষিণ-পূর্ব ঘরে বিদ্যাসাগরের শয়নকক্ষ।আবার এর ঠিক দক্ষিণে আর একটি ঘর বহুমূল্য পুস্তকে পরিপূর্ণ একটি লাইব্রেরী বিশেষ। দেওয়ালের কাছে সারি সারি অনেকগুলি তাক জুড়ে অতি সুচারুভাবে বাঁধানো বইগুলি সাজানো। হলঘরের পূর্বসীমান্তে টেবিল ও চেয়ার আছে। বিদ্যাসাগর যখন বসে কাজ করেন, তখন সেইখানে তিনি পশ্চিমাস্য হয়ে বসেন। যাঁরা দর্শনপ্রার্থী , তাঁরাও টেবিলের চতুর্দিকের চেয়ারেই বসেন। টেবিলের উপর লেখাপড়ার সামগ্রী — কাগজ, কলম। দোয়াত, ব্লটিং, অনেকগুলি চিঠিপত্র, বাঁধানো হিসাব-পত্রের খাতা, বর্ণপরিচয়, কথামালা, সীতার বনবাস এমনসব দু-চারটি বিদ্যাসাগরের রচিত পাঠ্যপুস্তক সাজানো। ওই চেয়ারটেবিলের ঠিক দক্ষিণের ঘরে সাদামাটা একটি খাট-বিছানা আছে সাধারণতঃ সেইখানেই উনি রাত্রিবাস করেন।
***
শ্রীরামকৃষ্ণ গাড়ি থেকে নামলেন। মাস্টার পথ দেখিয়ে তাঁদেরকে বাড়ির ভিতর নিয়ে যাচ্ছেন। উঠোনে ফুলগাছ, তাহার ভিতর দিয়ে আসতে আসতে ঠাকুর দিব্যভাবের বালকের মতন বোতামে হাত দিয়ে মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ হ্যাঁ গা, জামার বোতাম খোলা রয়েছে, — এতে কিছু দোষ হবে না?” গায়ে একটি লংক্লথের জামা, পরনে লালপেরে কাপড়, তার আঁচলটি কাঁধে ফেলা। পায়ে বার্নিশ করা চটি জুতো। মাস্টার বললেন, “আপনি ওর জন্য ভাববেন না, আপনার কিছুতে দোষ হবে না; আপনার বোতাম দেবার দরকার নাই।” বালককে বোঝালে যেমন নিশ্চিন্ত হয়ে পথ চলে, ঠাকুরও তেমন নিশ্চিন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন।- ” কই গো বিদ্যেসাগর কই? আমি আজ এয়েচি গো”!
কি অকপট আহ্বান তাঁর কন্ঠে।
বিদ্যাসাগর তালতলার চটি ফটফটিয়ে নমস্কার করতে করতে বেরিয়ে এলেন। তাঁর মুখটি আপাত গম্ভীর হলেও এক অপার্থিব মায়া লেগে আছে। তিনি বললেন – ” আসুন! অাসুন আসতে আজ্ঞা হোক!”
শ্রীরামকৃষ্ণ — “আজ সাগরে এসে মিললাম। এতদিন খাল বিল হদ্দ নদী দেখেছি, এইবার সাগর দেখছি।” (সকলে উচ্চরোলে হেসে উঠলেন)
বিদ্যাসাগর (সহাস্যে) — ” তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান! “
শ্রীরামকৃষ্ণ — ” না গো! নোনা জল কেন? তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও, তুমি যে বিদ্যার সাগর! তুমি বাপু ক্ষীরসমুদ্দুর!
বিদ্যাসাগর —” তা আপনি চাইলে বলতে পারেন বটে।”
একটু লঘুহাস্যরসের পর বিদ্যাসাগর চুপ করে রইলেন। ঠাকুর ওঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন —
“তোমার কর্ম সাত্ত্বিক কর্ম। সত্ত্বের রজঃ। সত্ত্বগুণ থেকে দয়া হয়। দয়ার জন্য যে কর্ম করা যায়, সে রাজসিক কর্ম বটে — কিন্তু এ রজোগুণ — সত্ত্বের রজোগুণ, এতে দোষ নাই। শুকদেবাদি লোকশিক্ষার জন্য দয়া রেখেছিলেন — ঈশ্বর-বিষয় শিক্ষা দিবার জন্য। তুমি বিদ্যাদান অন্নদান করছ, এও ভাল। নিষ্কাম করতে পারলেই এতে ভগবান-লাভ হয়। কেউ করে নামের জন্য, পুণ্যের জন্য, তাদের কর্ম নিষ্কাম নয়। আর সিদ্ধ তো তুমি আছই।”
বিদ্যাসাগর — ” কিন্তু মহাশয়, সে কেমন করে?”
শ্রীরামকৃষ্ণ — “আলু পটল সিদ্ধ হলে তো নরম হয়, তা তুমি তো খুব নরম। তোমার অত দয়া! –
বিদ্যাসাগরকেও আজ কথায় পেয়েছে। তিনি বললেন — ” কিন্তু কলাই বাটা যে সিদ্ধ হলেতো শক্তই হয়! “
শ্রীরামকৃষ্ণ — “তুমি তা নও গো; শুধু পণ্ডিতগুলো দরকচা পড়া! না এদিক, না ওদিক। শকুনি খুব উঁচুতে উঠে, তার নজর ভাগাড়ে। যারা শুধু পণ্ডিত শুনতেই পণ্ডিত, কিন্তু তাদের কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি — শকুনির মতো পচা মড়া খুঁজছে। আসক্তি অবিদ্যার সংসারে। দয়া, ভক্তি, বৈরাগ্য বিদ্যার ঐশ্বর্য।”
বিদ্যাসাগর চুপ করে শুনছেন। সকলেই তাঁর সাথে একদৃষ্টে এই আনন্দময় পুরুষকে দর্শন ও তাঁহার কথামৃত পান করছেন।
বিদ্যাসাগর নিজেও মহাপণ্ডিত। যখন সংস্কৃত কলেজে পড়তেন, তখন নিজের শ্রেণীর সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্র ছিলেন। প্রতি পরীক্ষায় প্রথম হতেন ও স্বর্ণপদক (Medal) বা ছাত্রবৃত্তি পেয়ে এসেছেন। ক্রমে সংস্কৃত কলেজের প্রধান অধ্যাপক হন। তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সংস্কৃত কাব্যে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। নিছের অধ্যবসায় গুণে নিজেই চেষ্টা করে ইংরেজী শিখে শেক্সপীয়র বা মিল্টন পড়তেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ -” দেখ! এই জগতে বিদ্যামায়া অবিদ্যামায়া দুই-ই আছে; জ্ঞান-ভক্তি আছে আবার কামিনী-কাঞ্চনও আছে, সৎও আছে, অসৎও আছে। ভালও আছে আবার মন্দও আছে। কিন্তু ব্রহ্ম নির্লিপ্ত। ভাল-মন্দ জীবের পক্ষে, সৎ-অসৎ জীবের পক্ষে, তাঁর ওতে কিছু হয় না।যেমন প্রদীপের সম্মুখে কেউ বা ভাগবত পড়ছে, আর কেউ বা জাল করছে। প্রদীপ নির্লিপ্ত। আবার সূর্য শিষ্টের উপর আলো দিচ্ছে, আবার দুষ্টের উপরও দিচ্ছে। যদি বল দুঃখ, পাপ, অশান্তি — এ-সকল তবে কি? তার উত্তর এই যে, ও-সব জীবের পক্ষে। ব্রহ্ম নির্লিপ্ত। সাপের ভিতর বিষ আছে, অন্যকে কামড়ালে মরে যায়। সাপের কিন্তু কিছু হয় না।
বিদ্যাসাগর – “ আচ্ছা বলুন তবে ব্রহ্মের স্বরূপটি কেমন?”
শ্রীরামকৃষ্ণ – “ব্রহ্ম যে কি, মুখে বলা জায় না। সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে। বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, ষড় দর্শন — সব এঁটো হয়ে গেছে! মুখে পড়া হয়েছে, মুখে উচ্চারণ হয়েছে — তাই এঁটো হয়েছে। কিন্তু একটি জিনিস কেবল উচ্ছিষ্ট হয় নাই, সে জিনিসটি ব্রহ্ম। ব্রহ্ম যে কি, আজ পর্যন্ত কেও মুখে বলতে পারে নি।”
বিদ্যাসাগর — “বাহ্ ! এটি তো বেশ কথা! আজ একটি নূতন কথা শিখলাম।”
শ্রীরামকৃষ্ণ- ” দেখ না, এই জগৎ কি চমৎকার। কতরকম জিনিস — চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র। কতরকম জীব। বড়, ছোট, ভাল, মন্দ, কারু বেশি শক্তি, কারু কম শক্তি।”
বিদ্যাসাগর — ” বুঝলাম ! তিনি কি কারুকে বেশি শক্তি, কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন?”
শ্রীরামকৃষ্ণ — ” তিনি বিভুরূপে সর্বভূতে আছেন। পিঁপড়েতে পর্যন্ত। কিন্তু শক্তিবিশেষ তা না হলে একজন লোকে দশজনকে হারিয়ে দেয়, আবার কেউ একজনের কাছ থেকে পালায়, আর তা না হলে তোমাকেই বা সবাই মানে কেন? তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো? (হাস্যমুখে) তোমার দয়া, তোমার বিদ্যা আছে — অন্যের চেয়ে, তাই তোমাকে লোকে মানে, দেখতে আসে। তুমি এ-কথা মানো কি না?শুধু পাণ্ডিত্যে কিছু হয় না । তাঁকে পাবার উপায়, তাঁকে জানবার জন্যই বই পড়া। একটি সাধুর পুঁথিতে কি আছে, একজন জিজ্ঞাসা করলে, সাধু খুলে দেখালে। পাতায় পাতায় “ওঁ রামঃ” লেখা রয়েছে, আর কিছুই লেখা নাই!”
বিদ্যাসাগর মৃদু মৃদু হাসছেন শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়। আজ তাঁর বৈঠকখানাটি বৈকুন্ঠতূল্য হয়ে গেছে। ব্যক্তিগতভাবে নিজে সংশয়বাদী হলেও আজ শ্রীরামকৃষ্ণের কথাগুলি তাঁর কানে মধুবর্ষণ করছে।
হঠাৎ একটু থেমে শ্রীরামকৃষ্ণ বলে উঠলেন –
” আচ্ছা তোমার মনের ভাবটি কি গো?”
বিদ্যাসাগর (একটু ইতঃস্ততঃ হয়ে) – ” সে না হয় একদিন আমি নিজে গিয়ে আপনাকে শুনিয়ে আসব!”
শ্রীরামকৃষ্ণ – “তা বেশ! তবে কি না দক্ষিণেশ্বরেই একবারটি এসো না হয়! “
বর্ধমান থেকে কিছু মিষ্টান্ন আনিয়েছিলেন গৃহকর্তা ঈশ্বরচন্দ্র। একটি রেকাবি করে তাই সাজিয়ে দিলেন অতিথিকে। শ্রীরামকৃষ্ণ তার থেকে একটি সন্দেশ তুলে নিলেন। এরপর সকলে একটি মিষ্টান্ন নিয়ে জলপান করলেন। বিদ্যাসাগরের চোখে অশ্রু! এরকমও সহজ সরল অথচ চিরপ্রজ্ঞাবান কেউ হয়? আজকের পর থেকে সব ধারণাটাই যেন বদলে যাচ্ছে। নিজেকে সংযত করলেন। ইচ্ছা করছিল ওঁর চরণদুটি বুকে চেপে একটু যদি একটু কাঁদা যেত! শ্রীরামকৃষ্ণ যেন তা বুঝতে পেরেছেন নিজের ঐশীগুণে। ফিরে যাওয়ার কালে আবার একবার বললেন – ” তাহলে একবারটি রাণীমার বাগানে এসো কিন্তু! আর ওখানেই মা ভবতারিণী আছেন ! আসলে তোমায় একবার মা কে দেখিয়ে আনতুম ! ”
এই শ্রাবণসন্ধ্যাটি আজ অতীত। মহাকালের অনন্ত পথে এক আনন্দময় পুরুষের সাথে এক জ্ঞানময় পুরুষের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারটি অক্ষয় হয়ে থাকবে।
নাহ্, বিদ্যাসাগরের আর দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে নিজের মনের ভাবটি তাঁকে জানিয়ে আসা হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়বার আর তাঁদের দুজনের দেখাও হয়নি কখনো। তবুও ভাবতে ভাল লাগে এই দুই যুগপুরুষ আমাদের ধূলিমাখা মাটির পৃথিবীতে, কল্লোলিনীর বুকে একটি মায়াবী সন্ধ্যাকাল উত্তরকালকে উপহার দিয়ে গেছেন।************
তথ্যঋণ-
শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত- শ্রীম কথিত
পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ- অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত করুণাসাগর বিদ্যাসাগর- ইন্দ্রমিত্র
—oooXXooo—