মুক্তিপদ ছাপোষা মানুষ। পলাশডাঙার শেষ প্রান্তে যেখানে গাঁয়ের শ্মশান সেই জায়গাটাকে সবাই হাটবামনা বলে। অনেক সময়ই রেগে গিয়ে কেউ কেউ অভিশাপ দিয়ে থাকে তোকে হাটবামনায় দিয়ে আসি। আর মুক্তিপদ এখানেই মুক্তি খুঁজে পায়। ভীষণ নির্জনতা স্থান জুড়ে।
শ্মশান থেকে একটু দূরেই মা শীতলার মন্দির। চট্টখুন্ডি বামুনরা এর সেবাইত। সামনে বিরাট চাতাল।
শীতলা অষ্টমীর দিন আশপাশের পাঁচটা গাঁয়ের লোক আসে ভিজিয়ে খেতে। দেবীর সবকিছুই ঠান্ডা পছন্দ। সেদিন দুপয়সা আয় হয় মুক্তির। তারসাথে ওর মেয়েটার মুখে হাসি ফোটে। কলা,দৈ,মিষ্টি দেয় মেয়েটার হাতে। সংসারে বড়ো অভাব। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তবুও দেবীর কপালে বেঁচেবর্তে আছে মুক্তিপদর সংসার। পাঁচটা ছেলের পর এই মেয়েটার জন্ম। মুক্তিপদর মতো মানুষ রা জানে মানুষ হল সম্পদ। তাদের ঘরের ছেলেরা ডাক্তার ব্যারিস্টার হবে না। তবে কষ্ট সৃষ্ট করে মানুষ করলে গায়ে গতরে খাটবে। তখন মুক্তিপদর সংসারে সুখের পায়রা উড়বে। বড়ো চকমিলানো ঘর করবে মুক্তিপদ। আর তো কটা দিন।
মুক্তিপদ আশুত গাছের ছায়াতে বসে বসে নিজের মনে গান গাইছিল। আজকাল সব গান ঠাকুর এর। একটা সময় ছিল মুক্তির গলায় সিনেমার গান থাকত। বয়সের সাথে সাথে শীতলামাতার গান লেখে মুক্তি। নিজেই সুর দেয়। তালপাতার পাখা বানানো ওর জীবিকা। পাঁচটা গাঁয়ের তালপাতা জোগান দেওয়ার কাজে ছেলেরা সাহায্য করে। একটা পাতায় দুটো পাখা। পাঁচ টাকায় বিক্রি করে মুক্তি। কী ঠান্ডা বাতাস। একটা সময় ছিল যখন ইলেটিরি ঢোকেনি গাঁয়ে। মুক্তিপদ তখন খুব ছোটো। ওর বাবার আমল। তখন কত বিক্রি হত এই তালপাতার পাখা। এখন বাজার মন্দা। তবে শীতলা মন্দিরের থানে পাখা দেওয়ার রেওয়াজ আছে। ভক্ত রা পাখা উৎসর্গ করে।
মুক্তির ছিটেবেড়ার ঘর। তবে চারদিক ঝকঝকে তকতকে। মেয়েটার হাতে যেন যাদু আছে। লালপাড় সাদা শাড়ি পরেছে আজ। কপালে সিঁদুরের ছোট্ট টিপ। চুল গুলো আলুলায়িত। একটা কলসি কাঁখে নিয়ে জল আনতে চলল। দূর থেকেই হাঁক দিলে “বাবু।জলকে যাই। এসে রান্ধিবাড়ির কাঠ আনতি হবে।”
বুকটা ছ্যাঁক করে ওঠে মুক্তির। শাড়ি পরে কতবড় লাগছে। চৈত্রমাস। শীতলা অষ্টমীর দিন মেয়েটার জন্ম হয়েছিল। মুক্তির মনে হয়েছিল সাক্ষাত দেবী তার ঘরে এসেছে। নইলে তার এত গৃহশান্তি হবে কী করে! ওই তো দেবীর মতোই তার মেয়েটার কাছে অমৃতকলস।
আলতা পায়ে মেয়েটার চলন দেখছিল মুক্তি। ঠিক সেই সময়ই শ্মশান এ একটা আওয়াজ শোনা গেল। “বল হরি হরিবোল “।
এই শীতের শেষ দিকে মানুষ বেশি মরে। যত রোগ জীবাণু এইসময় বাতাসে ঘোরে। তাই রোগমুক্তির জন্য দেবীর কাছেও ভিড় বাড়ে।
আজ গন্যমান্য মানুষ মরেছে। তাই ভিড়টা বেশি। এই সময় চা আর বিস্কুট বিক্রি করে মুক্তি। গাঁয়ের শ্মশান। দোকান পাট নেই। আর এতগুলো লোক চা খেলে একশ টাকা লাভ হবে।
মুক্তি দেখতে থাকে মরবার পর কত আয়োজন। নিশ্চয়ই খুব ভাগ্যবান। একবার কাছ থেকে দেখবার ইচ্ছা হল। এরা নিশ্চয়ই স্বর্গে যাবে। পৃথিবীতে রাজকীয় সুখ ভোগ করেছে। উঠে পড়ল মুক্তি। মৃত মানুষটা তার এত চেনা লাগছে। মনে করবার চেষ্টা করল। আগত শ্মশান যাত্রীদের দুটো দল। হ্যাঁ। মনে পড়েছে এবার। বেলতোড়া গাঁয়ের আশুতোষ ঘোষ। খুব চেনে মুক্তি। কী বিচিত্র জীবন ছিল লোকটার। মুক্তি বলতো আশুকাকা।
এইবার খুব বোঝা গেছে। তারমানে আশুকাকার দুই পক্ষের দুই দল। বোঁদেরবিলের টালি ব্যবসা করত আশুতোষ ঘোষ। পৈতৃক জমির ভাগের সাথে বাড়ি বাড়ি ধান মাপতো । ভালোই পয়সা করেছিল। পৈতৃক বসতবাড়ি দোতলা হল। জমি দেখতে পাশের গাঁয়ে যেত আশুতোষ। তখন ভরা যৌবন। কবিতা লিখত। আর সেই কবিতার মানসী ছিল কেষ্ট ঘোষের মেয়ে কুসুম। মাঠের আলে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা চলত প্রেমালাপ। তখন সমাজে প্রেম ছিল লুকিয়ে চুরিয়ে।
স্বভাবে মুখচোরা আশুতোষ। বাড়িতে জানাল সে কুসুমকে বিয়ে করবে। বাদ সাধলে আশুতোষ এর মা। বললে “ওই হাড়কেপ্পন কেষ্টর ঢেউ নাচানি মেয়ে যদি বউ করিস তবে গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরব”।
আশুতোষ ভয় পেয়ে গেল। বাধ্য ছেলের মতো মায়ের কথা শুনে মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করলে। বেশ কাটছিল। চারটে নাতিনাতনির মুখ দেখে পরকালে গেল আশুতোষ এর মা।
তবে পিরীত হল গিয়ে কাঁঠালের আঠা। অনেক দিন পর যখন আবার কুসুমের সাথে দেখা হল তখন আশুতোষ আর ঠিক থাকতে পারলে না।
কুসুমের চোখের জলে কেমন যেন হয়ে গেল আশুতোষ। আবার বিয়ে করলে কুসুমকে। দুই সতীনের সংসার। তার মাঝে শাঁখের করাত আশুতোষ কে যেতেও কাটে,আসতেও কাটে।
আশুতোষ কাকা মরে শান্তি পেল। এদিকে দুই পক্ষের মধ্যে বিবাদ আর মেটে না। বাপের সম্পত্তি নিয়ে চলল তুলকালাম কান্ড।
মুক্তির যত ভাবনা। এবার কী হবে। এদিকে তার মেয়েটা কখন এসে পড়েছে। থালার উনানে দুটো ঘুঁটে দিয়ে কাঠকুটো দিয়েছে। মুক্তি ডাক দিল “অ মা শেতলা। আজ কী রাঁদবি গো। ”
শেতলা ওর স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বলল “রান্ধিবাড়ির বেওস্থা পরে হবে। আগে সবাই কে চা দিই”।
শ্মশান যাত্রীদের চা দিল শেতলা। আরাম করে আশুতগাছের নীচে বসল দুই ভাগ হয়ে। সামনেই সানবাঁধানো পুকুর। দাহকাজ শেষ হলে স্নান করবে সবাই। একটা জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। মুক্তির মনে আবার চিন্তা। সত্যিই কী অধ্যায় শেষ হবে। হবে না। অনন্তজীবনপ্রবাহে আশুতোষ এর মুক্তি হল কোথায়? এই যে মুক্তির জীবন। শেতলার জন্ম দিয়ে ওর মা চলে গেল। মুক্তির মনেই হয়নি দারগ্রহণের কথা।সংযম,কেচ্ছাসাধন না থাকলে অশান্তির বীজপ্রবাহ থামে না।