ভোম্বল প্রায় সারা বছরই মাছি মারে, এই সময়টাতেই ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্ন-ঠিটার্ন করে যা-হোক কিছু রোজগার করে। এবছর মাছিও তেমন মারতে পারেনি, উল্টে মাছিরাই ওর নাকের ওপর হাঁচি মেরে চলে গেছে! গোদের উপর বিষফোঁড়া’র মতো, ওর মাছি-মারা-হেলপারটাও দু’মাসের মায়না না পেয়ে পুরোনো একটা প্লাস্টিকের চেয়ার তুলে নিয়ে চলে গেছে, পড়ে আছে গোটা কয়েক মক্কেল। তাঁদের অবস্থাও “হারাধনের দশটি ছেলে”র -মতো- একটি গেছে কোভিডের পেটে রইল বাকি নয়!
সেই ন’টির মধ্যে একটি আজ সকালে এসে হাজির হয়েছেন। নাম বিনোদ সাহা, মুরগি-পলট্রির মালিক। ভোম্বলের সামান্য একটা ভুলের জন্য এই মুরগি-মালিককে ভালো রকমের ‘মুরগি’ হতে হয়েছে! কারণ নিউ রেজিমের পরিবর্তে ওল্ড রেজিম অপ্ট করার ফলে সে-বাবুকে অনেকগুলো ‘ডিম’ পাড়তে হয়েছে! সেই যন্ত্রণায় রাতভর ছটফট করে সকাল হতেই ভোম্বলের বাড়িতে এসে উদুম গালমন্দ করেছেন! সময় খারাপ হলে যাআ হয়! খারাপ সময়ের আবার গন্ডাখানেক জ্ঞাতিগুষ্টি থাকে, একজন যায় তো আরেকজন আসে!
সে যে-ই আসুক, কাজ তো করতেই হবে, নাহলে খাবে কী! কিন্তু কাজ করার কি উপায় আছে! শুরু থেকেই সিস্টেম ভীষণ রকম ঝোলাচ্ছে, ঘুরছে তো ঘুরছেই! ওর ঘোরা দেখে ভোম্বলের মাথা ঘোরা শুরু হয়ে গেল, তবু ওর ঘোরা বন্ধ হলো না!
এই যদি কাজের হাল হয়, তাহলে মক্কেলদের কাছ থেকে পয়সা আদায় করবে কীকরে!
সংসারের ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’র কথা ভেবে ভোম্বল ধৈর্য ধরে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মনিটরের দিকে! অনেকটা ঐ বড়শি’র ফাতনা মতো, গিললেই হ্যাঁচকা টান! কিন্তু শালা গিলছে কই!
হঠাৎ ভোম্বল চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে ফোন গেল মক্কেলের কাছে- “নিতাই’কাকা, তোমার মোবাইলে একটা ওটিপি গেছে, একটু বলে দাও না প্লিজ, কাজটা তাহলে হয়ে যায়”।
এমন করে বলছে, যেন নিতাই’কাকার রিটার্নটা করতে পারলেই ও কাশিতে গিয়ে ডুব দিয়ে আসবে!
কিন্তু পুণ্যি করা অত সহজ কথা নয়! যতই ভোম্বল পায়ে পড়ে ওটিপি চাক, নিতাই’কাকা দিলে তো! দেখুন না, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়-
যথারীতি ভোম্বলের ফোন পেয়ে ‘কাকা বিরক্ত হয়ে বললেন-
“কী যে কও ভোম্বল, এইভাবে যহন তহন টেপাটেপি চাইলে আমি কীকইরা দিই কও দেহি! সব কিছুরই এট্টা সময়-গোময় আসে তো না কি? এমনিতেই আমি তোমাগো এইসব ওটিফোটি বুজি না! তোমার কাকিমা তবুও এট্টু-আড্ডু বোজে। তাথ্থিকা বড় কথা হইল, আমি এহন সাইকেলে কইরা মাল ডেলিবারি দেতে আইসি”
“কাকা প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো, হাতে আছে মাত্র কয়েকটা দিন, কোনও কারণে যদি তোমার রিটার্নটা দিতে দেরি হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু লেট ফাইন দিতে হবে”!
“এতই ঝহন তাড়া, তহন তোমার উচিত ছিল আমার কামডা আগেই সাইরা ফেলানো”।
“আরে বাবা, তুমি তো আমায় কাগজপত্র দিলেই গতকাল, আগে সারবটা কীকরে! শুধু শুধু তুমি আমার উপর তুমি রাগ করছো! ওসব কথা রাখো, এখন ওটিপি’টা দিয়ে দাও”!
কাকার একটু দয়া হলো!
“এইডা কি কোনও নম্বর হইবে?
না গো, এটা একটা ব্যাংক-ইভিসি, আলফানিউমারিক কোড। মানে এ-বি-সি-ডি আর ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর মিলিয়ে মিশিয়ে থাকবে। কোথাও একটু বসে চশমাটা পরে নিয়ে ভালো করে দেখে বলো দেখি!
“এবার রাগ সামলাতে না পেরে ভোম্বল মোবাইলটাকে মুখ থেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে নিয়ে নিতাই’কাকার উদ্দেশে কিছু একটা বলে নিয়ে নিজের রাগটাকে ঝেড়ে ফেলল! তারপর অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল-“তোমার যদি খুব কষ্ট না হয়, আমার ঘরে একটু পায়ের ধুলো দেবে গো কাকা”?
এমন করে বললে কোন কাকা না পায়ের ধুলো দেয়!
অবশেষে কাকার মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাজটা সেরে ফেলল!
যেটা বলার বিষয়-
ভোম্বলের কাছে এই নিতাই’কাকার মতো মক্কেলরাই আসেন এবং এই মক্কেলদের কপালেই ঐ আলফানিউমারিকাল ওটিপি জোটে, যেখানে লেখাপড়া জানা মক্কেলদের কপালে জোটে সহজ-সরল একটা সিক্স ডিজিটেড আধার ওটিপি!
“কও কী তুমি; এইসব জরুরি কাগজপত্তর লইয়া কেউ কি রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে! রিটান ঝহন হইয়া গ্যাসে তহন আর চিন্তা কীসের, যত্ন কইরা রাইখ্যা দেও তোমার কাসে। আমি তোমার কাকিমারে লইয়া আমুখানে একদিন, ও-ই লাব-লোসকানের হিসাব বুইজ্জা নেবে খানে। আমার আর কী, আইজ আসি কাইল নাই”!
কাকার কথা শুনে ভোম্বলের গলা শুকিয়ে গেল, তবুও থু থু গিলে বলার চেষ্টা করল-
“তাতো ভালো কথা, কিন্তু আমার…..”
“আমার আর তোমার কথা শোননের সমায় নাই গো ভোম্বল……..”
কাকা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে ক্রিং ক্রিং শব্দে বেরিয়ে গেলেন!
মক্কেল বেরিয়ে যেতেই ঘরের ভিতর থেকে আওয়াজ এল-
“আজ কি বাজার-ঠাজার কিছু হবে? না কি শুধু জল ফুটিয়ে রেখে দেব! কী কুক্ষণে যে আমার বাবা…….”
**
কী বুঝলেন? এই ভোম্বলদের অবস্থা অনেকটা ‘পথের পাঁচালি’র ‘হরিহর-পুরহিতের’ মতো, শত চেষ্টা করেও কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারে না! ঘরের লোক থেকে যজমান,সবাই-ই কথা শোনায়!
**
কালের নিয়মে ভোম্বলদের দিন কোনোমতে কেটে যাবে। কিন্তু আমি ভাবছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা- এই ‘সার্ভার-ডাউন, আধার-লিংক আর ওটিপি’র চক্করে পড়ে একদিন এমন সময় আসবে না তো যেদিন নার্সিংহোমে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে-
“ম্যাডাম, অনেক্ষণ হলো আমার ওয়াইফকে ওটি’তে নেওয়া হয়েছে, দয়া করে কিছু আপডেট দেবেন”?
“এক মিনিট, পেশেন্টের নামটা বলুন তো”।
“উইন্ডোজ”
“পুরো নামটা বলুন, উইন্ডোজ কত”?
“উইন্ডোজ ইলেভেন”।
“সে-কী, এ তো ওল্ড ভার্সন! আপগ্রেড করাননি”?
“করব করব করেও আর করা হয়নি। এখন কী করতে হবে বলুন, এক্ষুণি করে দিচ্ছি”।
“এখন আর ওয়াইফকে পাচ্ছেন কোথায়! যা করার ডক্টর কৃষ্ণকুমার’ই করে দেবেন”!
“ভালো কথা, এ্যান্টি ভাইরাস নেওয়া আছে তো”?
“হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রোগ্রাম ডেভেলপড হওয়ার পর থেকেই পেশেন্ট ডক্টর কৃষ্ণকুমারের অবজারভেশনেই ছিল,কাজেই……”!
“এ্যাডাল্ট পেশেন্টদের ক্ষেত্রে পেশেন্টের কনসেন্টই যথেষ্ট!
দেখুন তো, আপনার মোবাইলে কোনও ওটিপি ঢুকল কি না”?
“ওটিপি…, কই, না তো”!
“শিট…….”!
“কী হলো”?
“সার্ভার-ডাউন”!
“কার? ওয়াইফের”?
“আরে না না, আমাদের সিস্টেমের। আজ সারাদিন এভাবেই ভোগাচ্ছে! দেখছেন না, সবাই কেমন মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছেন! আপনি বরং ওঁদের পাশে গিয়ে বসুন, মোবাইলে নজর রাখবেন কিন্তু, যেকোনও সময় ওটিপি চলে যাবে, তক্ষুণি আসবেন আমার কাছে”।
“ওটিপি না এলে”?
“না এলে ডাউনলোডিই হবে না”
ম্যাডামের কথা শেষ হতেই ইনকুয়েরি-রুমে হাসির রোল উঠল- কারণ সেখানে সবার মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন চার্লি’সাহেব, হাত-পা বেঁধে রেখে একটি রোবটের সাহায্যে তাঁকে খাওয়াবার এক্সপেরিমেন্ট চলছে, কিন্তু থেকে থেকে রোবটটি বিকল হওয়ায় বেচারা কী দুর্দশাতেই না পড়লেন……!