আপন জন (ষষ্ঠ পর্ব)
কাকলী ঘোষ
কী হয়েছে জিজ্ঞেস করে ধমক খেয়ে ফিরে এসেছে কপিল। সুখেন এগোয় নি। কী দরকার ওসবে থেকে।তার চেয়ে বরং কাজে মন দিলে লাভ আছে। নিজের আগ্রহ আর ইচ্ছা দেখালে যে আখেরে ফল ভালো হয় সেটা ও বুঝে গেছে ততদিনে। ম্যানেজার গোবিন্দ হালদার ওকে বেশ ভালো চোখে দেখছে আজকাল। অন্যদের দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কথা বললেও ওকে কিন্তু বেশ মিষ্টি করেই বলে। অবশ্য ওই ফাটা কাঁসরের মত গলায় যতটা মিষ্টি করা সম্ভব আর কী।
একমনে বসে কাজ করছিল সুখেন। সামনে স্তূপীকৃত পেন ছড়ানো। কার বডির সঙ্গে কার মাথা, কোন ডিজাইনে কী যাবে সেসব মিলিয়ে দেখতে হচ্ছিল ওকে। সেই সময়ই ভুবন চুপি চুপি বলল কথাটা।
“ ধনাই আজ হেব্বি ঝাড় খেয়েছে জানিস?”
নিবিষ্ট মনে সামনে পড়ে থাকা ডিজাইনের দিকে চেয়েছিল সুখেন। আচমকা ভুবনের কথায় চোখ তুলে তাকালো।
“ কার কাছে ? গোবিন্দ দা?”
গোবিন্দদার সঙ্গে ধনাইয়ের একটু মন কষাকষি চলছে ক’দিন ধরেই। স্বাভাবিক ভাবেই ওই নামটাই প্রথমে মনে এসেছে সুখেনের। আর খুব নিরপেক্ষ ভাবে বলতে গেলে বলতে হয় দোষটা ধনাইয়ের। কাজে এসেও কাজে মন দেয় না। সব কিছুতে দাদাগিরি দেখাবার চেষ্টা। মাস্তানি করার ইচ্ছা। ও যেহেতু প্রথম এই কারখানায় ঢুকেছিল তাই ওর দাবী সব চেয়ে বেশি এটাই বুঝি বোঝাতে চায়। যেন ওর বাপের জমিদারি। কিন্তু মালিক বা ম্যানেজার সেটা মানবে কেন ? প্রথম দিকে গোবিন্দদা ভালো কথায় বলেছে। তারপর থেকে কিছু গোলমাল দেখলেই মালিককে জানায়। এসব মিলিয়ে একটা গরমা গরম অবস্থা। ও ভেবেছে বুঝি সেটাই কিছু বাড়াবাড়ি হয়েছে।
চোখ মটকে হাসে ভুবন। “ আরে না। গোবিন্দ নয় অন্য কেস।”
হাতের ছোট্ট চিমটি টা দিয়ে পেনের গলার সোনালী বর্ডারটা তুলছিল সুখেন। চোখ সেই অবস্থাতেই রেখে প্রশ্ন করে,
“ আবার কী কেস?”
“ শিখা।”
বর্ডারটা ঠিক জায়গায় লাগাতেই পারল না সুখেন। হাত টাত কেঁপে একেবারে একসা কান্ড ! শিখার আবার কী হল? ওর সঙ্গে ধনাই এর মেজাজ খারাপের সম্পর্ক কী ?
ওর ভেবলে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে খুব এক চোট হাসলো ভুবন। তারপর রগুড়ে গলায় বলল “ বুকে হাফ সোল খেয়েছে রে।”
এইসব কথাগুলোর মানে তখনও পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারে নি সুখেন। তাকিয়েই আছে দেখে এবার খোলসা করল ভুবন।
শিখাকে অনেক দিন হল মনে ধরেছে ধনাইয়ের। ওর ধারণা ছিল শিখাও ওকে পছন্দ করে। তাই কাল কারখানা ছুটি হবার পর শিখার পিছন পিছন ওদের ঘর পর্যন্ত চলে গেছিল। এটা সুখেনের কাছে নতুন খবর। সাধারণত কারখানার ছুটি হলে ও দাঁড়ায় না। সোজা নিজের ডেরায় চলে যায়। তারপর নিমাইদার সঙ্গে এক একদিন এক এক জায়গায় ঘুরতে যায়। এই কিছু মাসে নিমাইদা ওকে কলকাতার অনেক কিছু দেখিয়েছে। কাল গেছিল নলবনে। কলকাতার কাছেই এত সুন্দর একটা জায়গা যে আছে দেখে তো মুগ্ধ সুখেন। কাল ওকে নিমাই দার বলাই ছিল। তাই আর দাঁড়ায় নি। কিন্তু ধনাই শিখার পিছু পিছু ওদের বাড়ি অব্দি চলে গেল কেন ?
“ তারপর ?”
“ তারপর ওদের বস্তিতে ঢোকার আগে শিখার হাত চেপে ধরেছে। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।”
“ তুই জানলি কী করে ?”
পেটের হাসি বগবগিয়ে বেরিয়ে এলো ভুবনের। “ আরে আমি জানবো না? আমি তো ছিলাম ওর সঙ্গে।”
আবার অবাক হল সুখেন। এই সব কাজে কেউ আবার সাক্ষী নিয়ে যায় নাকি ? ধনাই কি পাগল ? না কি ও নিশ্চিত ছিল শিখা ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে। কী জানি বাবা। সুখেন মনে মনে স্থির করে ফেলল আর শুনবে না। কোথা থেকে ধনাই শুনতে পাবে আর মিছিমিছি ওর সঙ্গে শত্রুতা হয়ে যাবে। কিন্তু শিখা কী উত্তর দিল সেটাও তো না জেনেই থাকা যাচ্ছে না।
ততক্ষণে ভুবন বলতে শুরু করে দিয়েছে অবশ্য।
“ হাত ধরতেই শিখা চিৎকার করে উঠেছে। বস্তির যত লোকজন সব জড়ো হয়ে গেছে। একেবারে কেলেংকারী কান্ড !”
“ তারপর ?”
এবার সত্যি সত্যি কৌতূহলী হল সুখেন।
“ তারপর সবাই ছুটে এসে এই মারে তো সেই মারে। শিখা অবিশ্যি মারতে দিলো না। শুধু পষ্টই বলে দিল ও ধনাইকে বিয়ে করবে না। আর যেন কোনদিন ধনাই ওকে বিরক্ত না করে ।”
(ক্রমশ 🙂