ততদিনে তো উত্তেজনায় সুখেনের রাতের। ঘুম যেতে বসেছে। দিন রাত পিসির কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করেছে , “ আমি কলকাতায় যাব। কারখানায় কাজ করব। ওই নিমাইদার মত। বসন্ত জামাইয়ের মত।” শেষে আর ঠেকাতে পারল না পিসি। পাঠিয়ে দিল । সে ই কলকাতায় আসা। নিমাইদা অবশ্য কথা রেখেছিল। একটা ছোট খাটো কারখানার কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। পরে অবশ্য ওখান থেকে এই পেনের কারখানায় ঢুকলো সুখেন। আর এখানেই শিখার সঙ্গে আলাপ। একই রাস্তায় যাতায়াত ছিল ওদের। শিখা একটা সিঁদুর কারখানায় কাজ করত। দল বেঁধে ওরা এক দল মেয়ে ওদের কারখানার পাশ দিয়েই কাজে যেত। মাত্র তিন চার মিনিটের দূরত্বে ছিল এই সিঁদুর কারখানাটা। এক এক সময় পথেই দেখা হয়ে যেত দলটার সঙ্গে। তখনও সেরকম ভাবে শিখাকে দেখেনি সুখেন। আসলে সদ্যই গ্রাম থেকে এসেছে তো। অত সাহসও ছিল না। কিন্তু ওদের দলটায় বেশ কিছু জন ছিল যাদের চোখ থাকত মেয়েদের ওই আসা যাওয়ার পথের দিকে। ধনাই একদিন চেনালো শিখাকে। বেশ লম্বা। রঙটা ফর্সা না হলেও কালো নয়। একটু পরিষ্কারের দিকে। মুখ খানা ঢলঢলে। চোখ দুটো বড় বড়। সব মিলিয়ে বেশ একটা আলগা চটক। সাজগোজের মধ্যেও একটা নজর কাড়া ভাব আছে। দলের মধ্যমনিই যেন ও। সুখেন দেখলো। আর এমনই দেখলো যে আর কারুর দিকে কোনদিন নজর পড়লই না। ও অবশ্য জানতো না শিখাও ওকে দেখেছে। সদ্য গ্রাম থেকে আসা একটা বোকা বোকা চেহারার ছেলে বুঝতেই বা পারবে কী করে ? তবে এটুকু বুঝত শিখার ওপর ওদের দলের অনেকের নজর আছে। কী সব ধরনের কথা বার্তা বলত ওরা। শুনতে ভালো লাগতো না। আসলে শিখা বলেই হয়ত ভালো লাগতো না। টিফিনের সময় ইচ্ছে করে ওদের কারখানার দিকে যেত এরা। সুখেনকেও জোর করত। অথচ কোন দরকার থাকত না কিন্তু। কারখানার পাশেই রতনদার পাইস হোটেল। ভাত ডাল মাছ মাংস সব মেলে। আর বেশিরভাগ জন তো বাড়ি থেকে ভাতই নিয়ে আসত। রোজ রোজ হোটেলে খেলে আর কটা টাকা বাড়িতে পৌঁছবে ? কিন্তু তবু যেত ওরা। তখনও সুখেন নিজে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে উঠতে পারে নি। ওর তো হোটেলই ভরসা। সে ওদের কারখানার সামনের রতনের হোটেল হোক বা একটু দূরের পবনের হোটেল। শিখারাও কিন্তু বেরোত দল বেঁধেই। ওদের কারখানার সামনের অশ্বত্থ গাছটার বাঁধানো বেদির ওপরে বসত সব গোল হয়ে। তারপর যে যার ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটো বার করে। খেতে শুরু করতো। দু একজন ছাড়া বাকিরা খুব একটা ওদের দিকে তাকাতো বলে মনে হতো না। সেই দু একজনের মধ্যে একজন আবার কপিলের পছন্দের। কটা চোখ আর কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটা কপিলকে খেলাতো ও বেশ। সন্ধ্যা না কী নাম ছিল যেন মেয়েটার। সুখেন অত জানত না। ও খেতে ঢুকে যেত হোটেলে। বেরিয়ে এসে এক একদিন দেখত শিখাদের দলের সঙ্গে ওদের কয়েকজনও বেশ মিলে মিশে বসে আছে। পরে কপিল ওই সন্ধ্যকেই বিয়ে করেছিল। ধনাই তো শিখাকেই টার্গেট করে বসেছিল। সে একবারে নাছোড় বান্দা প্রেম। যখন তখন যেখানে সেখানে শিখাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। কিন্তু শিখা রাজি নয়। রাজি না হওয়াতে মনে মনে খুশি ছিল সুখেন। ধনাই কি শিখার যোগ্য? যা রোজগার করে অর্ধেক তো মদের নেশায় উড়িয়ে দেয়। তাছাড়া ওর বিরাট গুষ্টি। একগাদা ভাই বোন, বাবা মা। বস্তিতে থাকে। ওখানে শিখাকে কি মানায়? শিখার জন্য একটু ভালো পাত্র না হলে হয়? অবশ্য ও নিজে কখনো ভাবতেই পারে নি শিখা ওকে পছন্দ করে। ও তো ওদের মত অত কথাই বলতে পারতো না কোন দিন। চুপচাপ থাকতো। শুধু হাসি দিয়ে ম্যানেজ করতো। আর তাছাড়া ওর আছেই বা কী যে শিখা ওকে পছন্দ করবে ? এই তো একেবারে সাদা মাটা চেহারা। অতি সাধারণ মুখ। পিসি অবশ্য বলে ওর হাসি সুন্দর। সে বলতেই পারে পিসি মানুষ করেছে ছোট থেকে। সব কিছুই ভালো দ্যাখে। কিন্তু তা বলে শিখার মত মেয়ে ওকে পছন্দ করবে এটা ও ভাবতে পারেনি। শিখারই এক বন্ধু একদিন ডেকে বলল কথাটা। শুনে তো সুখেনের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবার অবস্থা। দিনটা আজও স্পষ্ট মনে আছে ওর। ক’দিন থেকেই ধনাই এর মেজাজ খাট্টা।