দীপান্বিতার রাত
স্বপ্না নাথ
তখন আমি পঞ্চদশী।
আমি বাংলাদেশের
মেয়ে, অবশ্য যখন জন্মেছি তখন ছিল পূর্ব পাকিস্তান।
বিয়ে হয়েছে এপার বাংলায় । ভারতে এসে প্রথম প্রথম একেবারেই অন্যরকম লাগতো।
বাংলাদেশের কোন চিত্রই এখানে খুঁজে পেতাম না।
তবে নতুন পরিবেশে বেশ ভালই লাগতো।
আমার বিয়ে হয়েছিল মে মাসে।
দেখতে দেখতে কটা মাস পেরিয়ে দুর্গাপুজো এসে গেল।
আমার কর্তা কলকাতায় দুর্গা ঠাকুর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে এত সুন্দর পূজো প্যান্ডেলের প্রচলন ছিল না। ওখানকার পূজায় একটা ঘরোয়া ভাবছিল। এখানে অনেকটা বাণিজ্য কেন্দ্রিক। তখন অত কিছু বুঝতাম না, পূজার চাকচিক্য আর বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
দেখতে দেখতে কালীপুজো এসে গেল।
বাংলাদেশে আমাদের বাড়িতে কালীপুজোর দিন লক্ষ্মীপুজো হতো।
আমাদের ছোটদের কাছে সে পুজো ছিল বড়ই উপভোগ্য, বড়ই আনন্দের।
সে ছিল খুব সমারোহের পুজো।
বিয়ের পর এখানে আমার প্রথম লক্ষ্মী পুজো। বলাবাহুল্য শ্বশুরবাড়িতেও দীপান্বিতা লক্ষী পুজো।
তখন সদ্য বিবাহিতা আমার কাছে সবই নতুন, মনের মাঝে এক রিমঝিম অনুভূতি। না দাম্পত্যের ভালোলাগা নয়, তখন বরং ও সব কিছু বুঝতাম না।
কিন্তু প্রথম শাড়ি পরা, সোনার গয়না, শাঁখা -সিঁদুর, নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ আর মাথায় কাপড় দিয়ে বউ সেজে থাকা!
তখন আমাদের যৌথ পরিবার। ভাসুর, জা, দেওর, বিবাহিতা দুই ননদ, ভাসুরদের ছেলে মেয়েরা ঠিক আমাদের বাংলাদেশের মতো।
আমাকে সবাই খুব ভালোবাসতো, বিশেষ করে ছোটরা।
ওদের সাথে আমার খুব ভালো সময় কাটতো।
সেদিন ছিল দীপান্বিতা লক্ষ্মী পূজা। আমার স্বামী দেওর মিলে ওপারে যাবে লক্ষী পূজার বাজার করতে।
আমরা ওপার বলতে বুঝতাম নদীর ওপার। বাংলাদেশের অধিকাংশ শহর, গ্রাম নদীর তীরে।
পরে বুঝলাম রেল লাইনের ওপার। এখানে নদী কোথায়!
তো পুজোর দিনে বাজি আর প্রদীপের আলোকসজ্জার ধুম পড়ে গেল।
তখন পুজো পার্বনে মোমের আলোর প্রচলন ছিল না। দুই তিন দিন আগে মাটির প্রদীপ তৈরি করে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হতো।
বাজারে এখনকার মতো মাটির প্রদীপ কিনতে পাওয়া যেত না।
সময়টা ১৯৭৩ সাল।
সকাল থেকেই পূজোর তোড়জোড়। আমি আঁকতে পারতাম, তাই আলপনা দেওয়ার ভার আমার উপরই বর্তালো।
ঠাকুরের আসন থেকে শুরু করে, ছাড়া বাড়ির আনাচে-কানাচে আলপনায় ভরে দিলাম। সবার প্রশংসায় উৎসাহিত হয়ে পাশের পিসতুতো ভাসুরের বাড়িতেও আলপনা দিলাম।
আমার স্বামী, দেওর, ভাসুর ঠাকুরের ছেলেমেয়েরা অনেক বাজি রোদে দিয়ে রেখেছে, পুজোর পরে সন্ধ্যাবেলায় পোড়ানো হবে।
বিকালে আমার মেজো জা একটা লাল নতুন শাড়ি আমাকে পরতে দিলেন। সেজেগুজে পুজোর সামনে বসতে হবে।
সন্ধ্যেবেলায় পুরোহিত এসে গেল। বড়রা সবাই পূজোর সামনে বসে পড়েছে। আমিও আছি।
হঠাৎ আমার বড় ভাসুরের মেয়ে আমার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি ছোটরা বাজি পোড়ানোয় মেতেছে।
সেখানে আমার স্বামীও আছে।
আমিও ওদের সাথে মেতে উঠলাম। তারাবাজি, রং মসলা, সাপ বাজি, কালি পটকার পর চরকি বাজির পালা এল।
আমার কোন হুশ নেই, ভুলে গেছি আমি এবাড়িতে নতুন বউ।
হঠাৎ একটা চরকি বাজি ঘুরতে ঘুরতে আমার পায়ের কাছে শাড়ি কুচির উপর এসে আটকে গেল।
কিছু বোঝার আগেই আগুন জ্বলে উঠলো!
আমি তো দিশাহারা, লজ্জায় শাড়ি খুলতেও পারছিনা।
ছোটরা আগুন আগুন বলে পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ে দিল, সেই সাথে আমার স্বামীও।
কিন্তু সে ছুটে এসে আগুন নেভানোর কোন চেষ্টাই করলো না।
আমার দু পায়ে পোড়ার জ্বালায় কাঁদতে শুরু করেছি, ঠিক তখনই আমার বড় ভাসুরের ছেলে ছুটে এসে, এক টানে শাড়ির সামনে টা খুলে দিয়েই দু পা দিয়ে দপা দপ করে আগুনটা নিভিয়ে দিল।
আমি ওই পোড়া শাড়ি, কোনরকমে গুটিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলাম।
তারপর যা হয় আর কি, যতনা পোড়ার জ্বালা তার থেকে বেশি সবার উৎকন্ঠায় আর তিরস্কারে নিজেকে অপরাধী মনে করা।
না সেরকম মারাত্মক কিছু পোড়েনি। পায়ের কয়েক জায়গায় ফোসকা পড়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সেদিনের ওই ঘটনা আজ হয়তো লিখতে পারতাম না, যদি না আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট আমার বড় ভাসুরের বড় ছেলে সেদিন মরিয়া হয়ে তার কাকিকে না বাঁচাতো!
ওইটুকু ছেলের উপস্থিত বুদ্ধিতে আমি বেঁচে গেলাম, যা ওখানে অন্যরা বা আমার স্বামীও করতে পারল না।
তার অনেক বছর পর, নিজের পৃথক সংসার হল, ঠাকুরের সিংহাসন হল, নিজের আলাদা পুজো হলো। কত আত্মীয়-স্বজন লোকসমাগম।
কত পুজো এলো কত পুজো গেল, সেসব দিনের কথা আলাদা করে আর মনে পড়ে না।
কিন্তু আমার বিবাহিত জীবনের সেই প্রথম দীপান্বিতা আমার জীবনে চিরস্থায়ী দাগ রেখে গেলো।
—oooXXooo—