গতকাল ছিল লাটু’বাবুর গিন্নি পদ্মকলির জন্মদিন। তাই অনেক রাত পর্যন্ত হৈচৈ করে আজ ঘুম থেকে উঠতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য অসুবিধা কিছু নেই; কারণ রান্নাবান্নার কোনও ঝামেলা নেই। সেকারণেই বাবা-মা-মেয়ে, তিনজনেরই আজ ফুরফুরে মেজাজ! শুধু বৃহস্পতিবার বলে লাটু’বাবু বাজারে গেলেন ফুল-পাতা আর কিছু ফল আনবেন বলে।
পদ্মকলির মোবাইলে তখনও বাসি পায়েসের স্বাদ নিয়ে বাসি শুভেচ্ছাগুলো হুহু করে ঢুকছে! তিনিও একের পর এক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা আর শুভেচ্ছা ফেরত পাঠাচ্ছেন! ওরই মধ্যে একফাঁকে দ্যাবা-দেবী’র চায়ের পাটটুকু কোনোরকমে চুকিয়ে নিয়ে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন তার বেড-টি নিয়ে।
মেয়ে তখনও ল্যাদ খেতে খেতে কানে মোবাইল রেখে প্রীতমের সঙ্গে টক-ঝাল-মিষ্টিতে মুখোরোচক সব কথা বলে চলেছে। বলবে নাইবা কেন, খুব শিগগিরি মেয়েটা চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে! পাসপোর্ট-এ্যপ্লাই হয়ে গেছে। ভেরিফিকেশনটা হতে শুধু বাকি। এই অবস্থায় প্রেমিকের মনের অবস্থাটাও তো একটু বুঝতে হবে না-কি!
হাতের ইশারায় তন্নী মা’কে চায়ের কাপটা রেখে দিয়ে মাথাটা একটু টিপে দিতে বলল।
এমন সময় কানপুর থেকে পদ্মকলির ছোটবোন কৃষ্ণকলির কল এল! ব্যস, শুরু হলো কলকলানি! দুজনেই শুরু করলেন “আর বলিস না” দিয়ে, শেষও করলেন “আর বলিস না” দিয়ে! মাঝখানে টানা আধঘণ্টা বলে গেলেন! তন্নী হাতের ইশারায় অন্য ঘরে যেতে বললেও মা’র তাতে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই! এপাশ থেকে ‘হা-হা’ তো ওপাশ থেকে ‘হো-হো’ হয়েই চলেছে! এখন আর মা’কে থামানো যাবে না, বুঝতে পেরে মেয়ে শেষে কথা বলা বন্ধ করে প্রীতমকে টেক্সট করতে শুরু করল। “হে ভগবান, কী কুক্ষণে যে মা’কে মাথা টিপতে বললাম”!
ওদিকে কলিংবেলের শব্দ শুনে পদ্ম বিরক্ত হয়ে বললেন-
“দরজা খোলা আছে! হাত-পা ধুয়ে চায়ের জলটা বসিয়ে দাও। আমার চা’টা ঢাকা দিয়ে রেখো কিন্তু…!
“কে এল রে দিদি”?
“কে আবার, তোদের লাটুদা”।
“যা-ই বলিস, কপাল করে এখখানা স্বামী পেয়েছিস মাইরি! আমাদের তন্ময় তো একটা ডিম সেদ্ধও করতে পারে না! আর লাটুদা কত কীই না করছে”!
“করাতে জানতে হয় রে পাগলি”!
রান্নাঘরের আওয়াজে মনে হলো- চায়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে!
খানিক্ষণ পরে তন্নীর ফোনে লাটুবাবুর ফোন থেকে একটা এসএমএস ঢুকল- “তোমার প্যান এবং আধার কার্ডগুলো কোথায় রেখেছো? ওগুলো লাগবে তো”!
“মা, আলমারি থেকে আমার আইডি-প্রুফগুলো বের করে বাবাকে একটু দিয়ে এসো না প্লিজ”!
“দেখছিস তো ছোটমাসির সঙ্গে কথা বলছি! বাবাকে বল- আমার বালিশের নিচে চাবি আছে, নিয়ে নিতে”।
সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা এসএমএস ঢুকল-“ঠিক আছে, ঠিক আছে, লাগবে না”।
*******
স্বামীকে দিয়ে কীকরে কাজ করাতে হয়, বোনকে সেই পরামর্শ দিয়ে পদ্ম যখন বেরিয়ে এলেন, তখন ঘর ফাঁকা! শুধু সিগারেটের ছাইদানি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে! পাশে এককাপ চা অতি যত্ন সহকারে ঢাকা দিয়ে রাখা আছে এবং লাটুবাবুর স্মার্ট ফোনটা যথারীতি ডাইনিংটেবিলের ওপর মোবাইল স্ট্যান্ডে স্মার্টলি দাঁড়িয়ে আছে! কিন্তু মালিকটা গেল কোথায়!!!
সারা বাড়িতে একটা গা-ছমছমে ভাব! পদ্ম ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি তন্নীর ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন! তন্নী সঙ্গে সঙ্গে বাবার ছোট ফোনটাতে ফোন করল-
“বাবা, তুমি কোথায় আছো”?
“এই তো এসে গেছি, বাড়িতেই ঢুকছি। কিছু আনতে হবে না কি? বল তাহলে”।
“কিছু আনতে হবে না, “তুমি তাড়াতাড়ি ঘরে এসো”!
“তোর মা’র শরীর খারাপ হয়েছে বুঝি”?
“এতক্ষণ ঠিক ছিল, কিন্তু এখন হবে হবে করছে”!
“সে আবার কী কথা! এতক্ষণ যখন হয়নি তাহলে আরেকটু সবুর করতে বল, আমি এক্ষুণি আসছি”!
হঠাৎ পদ্মকলির মোবাইলে টুং করে একটা মিষ্টি মেসেজ ঢুকল অচেনা একটা নম্বর থেকে- ওটা পড়ে পদ্মকলি পাপড়ি মেলে খুশি হবেন, না কি হাত-পা গুটিয়ে লজ্জায় সিঁটিয়ে যাবেন- বুঝতে পারলেন না! তবে আনন্দ যে একটু হয়েছে তা ওঁর টোপা টোপা গাল দুটো দেখেই বোঝা গেল!
ওটা আর মেয়েকে দখায় কীকরে, তাই ফোনটা কাপড়ের আঁচলে লুকিয়ে ফেললেন!
লাটুবাবু ঘরে ঢুকে মেয়ের মুখে সব শুনে তো আকাশ থেকে পড়লেন! কিছু চুরি হয়ে গেলে তবু মেনে নেওয়া যেত, কিন্তু সিগারেটের টুকরোটা অ্যাস্ট্রের ভিতর থেকে এমন একটা বিদঘুট-ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে যা দেখে লাটুবাবুর পুরুষত্বে আঘাত লাগল!
পদ্মকলি বললেন- “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এখনও দেখছোটা কী? এক্ষুণি থানায় ফোন করো! এটা নিশ্চয় কোনও চেনাজানা লোকের ফাজলামো হবে”!
তন্নী গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে রান্নাঘরের দিকে গেল, তারপর চোখ কপালে তুলে একটা চিৎকার লাগল- “ওমা এদিকে এসো, কী অসভ্য লোক দেখো! দুটো ডিম ভেঙে একটা ওমলেট করে খেয়ে গেছে”।
লাটুদা অনেকটা ‘ফেলুদা’ গোছের হাবভাব করে গোটা বাড়িটা তল্লাশি করলেন! তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন-
“অবাক কাণ্ড! কিচ্ছুটি চুরি গেল না! একজন লোক এসে রান্নাঘরে ঢুকে প্রথমে চা বানিয়ে খেল, তারপর ডাবল ডিমের ওমলেট, তারপর ডাইনিংটেবিলে বসে সেগুলো তৃপ্তি করে গিলল। হাত-মুখ ধুয়ে-মুছে আবার ডাইনিংটেবিলে বসে গোটা একটা সিগারেট খোশ মেজাজে টানল! যাওয়ার আগে সিগারেটের ধোঁয়াটা শুধু রেখে গেল আমার জন্য! এসব কি আমায় বিশ্বাস করতে হবে”!?
“তারমানে তুমি কী বলতে চাইছো? আমি পল্টনকে ডেকে এনে আদর করে খাইয়েছি”?
তন্নী বলল- “পল্টনটা আবার কে”?
“তোমার মায়ের এক গ্রামতুতো ভাই”।
“না রে তন্নী, পল্টন হচ্ছে আমার বন্ধু। ও আর আমি এক সঙ্গে এক স্কুলে পড়েছি”।
“সে তো ভালো কথা। কিন্তু বাবা, মা তো সারাক্ষণই আমার ঘরে আমার কাছে ছিল, মায়ের পরিচিত কেউ হলে তো আমি জানতেই পারতাম!
বড় সাহেব প্রথমে লাটুবাবুর সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তারপর ভারী গলায় বললেন-
“এবার আমার কথাটা আপনি মন দিয়ে শুনুন”-
“এসআই দাসকে পাঠিয়েছিলাম আপনার মেয়ের পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন করাতে! কী আশ্চর্য লোক আপনারা মশাই, কেউ একটিবার বেরিয়ে দরজাটা পর্যন্ত খুললেন না! উল্টে আপনার গিন্নি আমার অফিসারকে চা করতে বললেন! আচ্ছা বলুন দেখি- শুধু চা কী আর খাওয়া যায়? তাই দুটো ডিম ভেজে খেয়েছে! এতে দোষটা কী হয়েছে শুনি! আপনাদের তো ভাগ্য ভালো যে আলমারির চাবিটা কোনও চোরের হাতে পড়েনি! তাহলে তো সর্বশান্ত হয়ে যেতেন! সেটা ভালো হতো বুঝি”?
“না মানে কাল ওঁর জন্মদিন ছিল বলে সবকিছু উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে স্যার! বলছি স্যার, মেয়ের পাসপোর্টটা হয়ে যাবে তো”?
“ওটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। শুধু আসার সময় বড় দেখে একটা কেক নিয়ে আসবেন। দাস এনেছিল বটে, কিন্তু পরিমানে এত কম ছিল যে এতগুলো লোকের কুলোল না! তবে হ্যাঁ, কেকটা কিন্তু এ-ক্লাস ছিল! ওটাই আনবেন কিন্তু”!
“নিশ্চই স্যার, অবশ্যই স্যার! একটা নয়, দুটো কেক নিয়ে কাল আমি আপনার সঙ্গে দেখা করব”!
“আরে মশাই, আমার সঙ্গে দেখা করাটা বড় কথা নয়, দাসের সঙ্গে অবশ্যই করবেন! আর হ্যাঁ, শুধু আপনি আসলে হবে না, মেয়ে আর ম্যাডামকেও সঙ্গে নিয়ে আসবেন। দাসের সঙ্গে কথা বলে ওঁর অভিমানটা ভাঙাতে হবে তো না-কি”!
বলেই সাহেব ভুঁড়ি কাঁপিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন! পাশ থেকে এসআই দাসও! মনে মনে যতই বিরক্ত হন, লাটুবাবুও হাসিতে হাসি মিলিয়ে ফোন ছাড়লেন!
বড় সাহেবের কথা শুনে পদ্মকলি মনে মনে খুশিই হলেন-“যিনি এত সুন্দর করে এসএমএস লেখেন, তিনি না জানি দেখতে কত সুন্দর হবেন”!
কিন্তু লাটুবাবু পড়লেন উভয় সংকটে!
“শালা নিজের হাতে চা করে খেল, ওমলেট খেল, ফ্রিজের ভিতরে রাখা কেকটাকেও রেহাই দিল না! এর পরেও সপরিবারে গিয়ে হনুমানের অভিমান ভাঙাতে হবে! এঁদেরকে কেউ বিশ্বাস করে! নিমন্ত্রণ ছাড়াই যদি শাআলাআ এতকিছু খেতে পারে, নিমন্ত্রণ পেলে তো কথাই নেই- কী না কী খেয়ে চলে যাবে আমি শালা টেরই পাব না”!