যদি কেউ মনে করেন , আসলে এটি ভাট -কথন , স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যেতে পারেন। তবে ব্যাপারটা হল , আমি তো এখন প্রায় প্রবীণ শ্রেণীভুক্ত , সুতরাং একটু স্মৃতি রোমন্থন করা আমার গণতন্ত্রিক অধিকার , আর ফেসবুকের মত জনগণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম কি আর আছে ? ভোট সংক্রান্ত আমার প্রথম স্মৃতি ১৯৭২ সাল – তখনও স্কুলে ভর্তি হই নি , তবে সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশ যুদ্ধের পরে আমরাও চলেছিলাম স্থানান্তরে – পশ্চিম ত্রিপুরার খোয়াই থেকে দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়া। চারদিকে তখন ইন্দিরা গান্ধির জয়জয়কার – কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁট ছড়া বেঁধেছিল শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গির সি পি আই -দুস্টু লোকেরা যথাক্রমে ইন্দিরা গান্ধীকে গাই এবং সি পি আই কে বাছুর বলে চিত্রিত করত কার্টুনে- তাতে অবশ্য কাউকে জেলে টেলে যেতে হয় নি। ভোটের প্রচার বোঝার বয়স তখন হয় নি , তবে সি পি আইয়ের স্লোগান , ভোট দেবেন কিসে , কাস্তে ধানের শীষে , বেশ মনে ধরেছিল। তা সে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে ত্রিপুরা বিধানসভারও ভোট হয়ে গিয়েছিল -আর সুখময় সেনগুপ্ত ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। পরের দিকের ব্যাপার জানি না , তবে ত্রিপুরার অন্তত প্রথম তিনজন মুখ্যমন্ত্রী জীবনযাত্রায় খুব সাধারণ ছিলেন। আমার একবারে ছোট বয়সে মা আমাকে নিয়ে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছিলেন – রিকশা থেকে গান্ধি টুপি পরা এক ভদ্রলোক নামলেন , মা আমাকে দেখালেন – উনি আমাদের চিফ মিনিস্টার , শচীন সিংহ। মা হাত জোড় করে নমস্কার করলেন , উনিও প্রতি -নমস্কার করলেন। মজার কথা এই , ওঁর ছেড়ে দেওয়া রিক্সাতেই আমরা চেপে বসেছিলাম – কোথায় পাইলট কার আর কোথায় জেড প্লাস ! ১৯৭২ এর নির্বাচনের পর শচীন সিংহের জায়গায় সুখময় সেনগুপ্ত মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বিলোনিয়া এলেন। মনে আছে , নদীর তীর থেকে ওঁকে নিয়ে একটি মিছিল বেরিয়েছিল – গলায় গাঁদাফুলের মালা পরে উনি প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁটছিলেন। আমি দিদিদের সঙ্গে দেখতে গিয়েছিলাম সেই মিছিল , আমার প্রশ্ন জেগেছিল , উনি জুতো পরেন নি কেন ? ওঁর মা বকে না ? এর পরে স্বল্পস্থায়ী কয়েকজন মুখ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলালেও বলতে গেলে তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রী সি পিএমের নৃপেন চক্রবর্তী -অকৃতদার এই জননেতার জীবনযাত্রা বলতে গেলে স্পার্টান। তবে জরুরি অবস্থার ঠিক পরে যেই ভোটটি হয় , আমি তখন ক্লাস সেভেন এ , ১৯৭৭ সাল। বাবা আবার বদলি হয়ে সেই বিলোনিয়া স্টেশনেই চলে এসেছেন। জনতা পার্টির হয়ে প্রচার করতে এলেন চন্দ্রশেখর , মধু লিমায়ে , প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র , প্রার্থী মানিক মুহুরীর সমর্থনে। মানিক মুহুরী কলেজে আমার বড়দির সিনিয়র বা সহপাঠী ছিলেন , এককালের যুব কংগ্রেসের দামাল সে নেতা কংগ্রেস ছেড়ে সি এফ ডি বা জনতা পার্টির হয়ে জোট প্রার্থী হয়েছিলেন। ত্রিপুরার বাঙালিরা পশ্চিমবাংলার মতোই হিন্দি বেশ ভালোই বুঝত, চন্দ্রশেখর কেন যেন ইংরেজিতে বক্তৃতা করেছিলেন , মনে হয়েছিল এক্সটেমপোর। এককালের তরুণ তুর্কী সুবক্তা ছিলেন , সন্দেহ নেই। সে বছরই বোধহয় দুটো স্বল্পমেয়াদী মন্ত্রিসভা হয়েছিল , প্রথমটা সি এফ ডি র প্রফুল দাসের নেতৃত্বে , পরেরটি জনতার রাধিকা রঞ্জনের নেতৃত্বে। সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার জানুয়ারি নাগাদ বোধহয় বিধানসভার ভোট ঘোষণা করা হয়েছিল। একটা কথা বলে রাখি , আমি খুব একটা টানা স্কুল করি নি , খামচে খামচে পড়াশুনা করেছি। শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি বাবা বদলি হয়ে এলেন মহকুমার এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়। আমার নাম পুরোনো স্কুলে রয়ে গেল এবং মাঝে মাঝে নতুন জায়গার স্কুলে গিয়ে ক্লাস করব সেরকম একটা ভদ্রলোকের চুক্তি আমার ছোড়দি করে এসেছিল নতুন জায়গার স্কুলে। তাদের একটা শর্ত ছিল, সামনের বছর নতুন ক্লাসে ভর্তি হতে গেলে পুরোনো স্কুলের পরীক্ষার ফল আর ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে , সেই সময় পুরোনো জায়গাটি বাবার এডিশনাল চার্জে চলে এসেছিল , সুতরাং পরীক্ষার সময় বাবার সঙ্গে আমি পুরোনো জায়গায় পরীক্ষা দিতে চলে গেলাম , ঠাঁই নিলাম পি ডব্লু ডির ইন্সপেকশন বাংলোয়। এতখানি সাত কাহন বললাম এই জন্য , বিদায়ী মন্ত্রী সভার এক ডাকসাইটে মহিলা মন্ত্রী সেই ডাকবাংলোয় আমাদের পাশের ঘরে থাকতেন। ওর একটি ছোট ছেলে ছিল,অতি দুস্টু সে এক দিন আমাকে কাঁঠাল পাতা খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল। রাজনীতিকরা সাধারণ মানুষকে অনেক সময় গরু ছাগল ভাবেন বটে , তবে বাচ্চাটি মায়ের থেকে সেই শিক্ষা পেয়েছিল , এতটা ভাবা বোধহয় ঠিক নয় ! যাই হোক , রাত্রে আমি করতাম পড়া মুখস্থ , আর উনি করতেন ভাষণ মুখস্থ। একটি ডায়লগ এখনো মনে আছে -গান্ধীজী কী বলেছিল ? গান্ধীজী বলেছিল, আমার জীবনই আমার বাণী ! সেই মন্ত্রী যেসময় সে কথাটি বলেছিলেন , এটেনবারো সাহেব অবশ্য তখনও ফিল্মে হাত দেন নি ! পরে কলকাতা চলে আসার পর ভোটের জাঁক জমক বুঝতে পেরেছি – বহুবর্ণ দেওয়াল লিখন , পোস্টার , জনসভা , পথসভা সবই অভিজ্ঞতায় এসেছে। তবে সরাসরি ছাত্র রাজনীতি করি নি বলে ব্রিগ্রেড বা ময়দানে কোনো সভা দেখি নি – স্থানীয় সভা গুলো শুনতে যেতাম কৌতূহলের বশে। জোছন দস্তিদার , গৌতম ঘোষদের তখন দেখতে পেয়েছি – আই পি টি এর অথবা শিল্পী ও কলাকুশলী সংঘের তরফে , বামফ্রন্ট কে চোখের মনির মতো রক্ষা করার আহবান নিয়ে ওরা প্রচারধর্মী নাটকগুলো করতেন। আরেকটি জিনিস বহুদিন চালু ছিল – রেডিওয়তে নির্বাচনী প্রচার। আজকের রাজনীতিকরা বোধহয় চিন্তাও করতে পারবেন না , গালিগালাজ না দিয়ে কী করে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখা যায়। বক্তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বোধহয় ছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। একবার উনি ব্রুটাস দিয়ে শুরু করেছিলেন , আরেকবার ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে দিয়ে’ !তবে হাওড়ার কারখানা খোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উনি সেরকম কিছু করতে পারেন নি , সেটাকে ব্যঙ্গ করে ওর হাতে একটা বিরাট চাবি ঝুলিয়ে সি পি এম একটা জম্পেশ কার্টুন বেরিয়েছিল , আমাদের বয়সীদের অনেকেরই মনে থাকবে। জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই আনসাং হিরোরা থেকে যান ,ভোটার ময়দানে দেওয়াল লিখন বা কার্টুন শিল্পীদের নাম সবার আগে আসবে। তবে আমার এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম ওদের পাড়ার এক ভদ্রলোকের কথা , এককালে গ্রামে যারা করতেন , এখন টুকটাক কাজ করেন। ভোটের সময় নাকি ওকে বিভিন্ন পার্টি ভাড়া নেয় ওর গলার জন্য – উনি ওর সিগনেচার ভয়েসে স্লোগান তুললে মিছিলের অন্য সবাই গলা মেলায়। একবার একপার্টির মিছিলে ভুল করে অন্য পার্টির স্লোগান তুলে মার্ খাওয়ার উপক্রম হয়েছিল , স্থানীয় নেতারা ওকে চিনত বলে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিল। চাকরিতে ঢোকার পরে অবশ্য যথেষ্ট সিনিয়র হওয়ার আগে ভোটের দায়িত্ব পড়ে নি আমার। এখানেও একটা গল্প বলে নেই – আমি দূরপাল্লার বাস বা ট্রেনে চড়ার আগে প্লেনে চড়েছি ( ত্রিপুরাতে সেটাই ছিল কলকাতার সঙ্গে যোগসূত্র ); সাইকেল বা স্কুটার কস্মিনকালেও না চালিয়ে গাড়ি চালানো শিখতে বাধ্য হয়েছিলাম , আর প্রিসাইডিং বা রিটার্নিং অফিসার না হয়ে,হয়ে গিয়েছিলাম একবারে নির্বাচন পর্যবেক্ষক ! বলে না , মারি তো গন্ডার , লুটি তো ভান্ডার সে রকম আর কী ! হালকা চালে এতগুলো গল্প করলেও , সংসদের বা বিধানসভার ভোটে উত্তাপ ছড়ায় , সবাই জানি। তবে পাড়ার ক্লাবে ,স্কুল কলেজের ইউনিয়ন নির্বাচনে ,মায় আবাসন সমিতির নির্বাচন ঘিরে উন্মাদনা কিছু কম হয় না। একবার প্লেনে আমার পাশে বসা দুই বয়স্কা সহযাত্রী সারাক্ষণ গল্প করে গেলেন লেক ক্লাবের আসন্ন ভোট নিয়ে ! তবে এর থেকেও অবাক করা ঘটনা ছিল , চাকরি জীবনের গোড়ার দিকে , একটা চার্টার্ড বাসের সদস্য ছিলাম। একবার সেই পথচলতি বাসের সংগঠনের বার্ষিক সাধারণ সভায় গিয়েছিলাম , সেখানে পরের বছরের জন্য সেক্রেটারি , কোষাধ্যক্ষ সব নির্বাচন হবে , সেরকম কথা ছিল। সভায় গিয়ে দেখি হৈ হৈ কান্ড ! চার্টার্ড বাসের সংবিধান নিয়ে এক নব্য সদস্য এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন , সেই বাসের লঙ্ঘন দুভাগ হয়ে গেল , আর ভোটও পন্ড হয়ে গেল! আরেক ভোটের সম্মুখীন হয়েছিলাম প্রবাসের প্রথম বছরে। বতসোয়ানায় বসবাসকারী বাঙালীর সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল সে সময় – ৩৫ টি পরিবার জড়ো হয়ে গিয়েছিল। পুজোর স্থান নিয়ে একটা মতবিরোধ দেখা যায় সে সময় – সমাজপতিরা গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা করেন , স্থির হয় , সংখ্যাগুরুর রায় সবাই মেনে নেবে। কিন্তু , এতজন বাঙালী একজায়গায় থেকে একটা মাত্র পুজো করলে অধর্ম হয় না ? সুতরাং , ভোটের ফল যাই হোক , সমিতি দু’ভাগ হলো , পুজোটাও ভেঙে দুভাগ হয়ে গেল! তবে , এসব কুচোকাঁচা ভোটে আর যাই হোক ,রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ভোটের সেই আভিজাত্য থাকে না । বহুদলীয় গণতন্ত্র তো বটেই , দ্বিদলীয় ব্যবস্থাতেও , বুথের ব্যবস্থাপনা , ব্যালট বাক্স , প্রচার ব্যবস্থা, বিতর্ক সভা , সাংবাদিকদের হুড়োহুড়ি , ঝামেলা কম ! তবে জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের প্রধান ছিলেন , একবার একটা আস্থা ভোট নিয়েছিলেন , সেরকম ভোট বেশ সহজ সরল। এর বর্ণনা আনন্দবাজারে ফলাও করে দিয়েছিল। দেশ জুড়ে প্রতিটি ভোটের বুথে দুটি আলাদা বাক্স রাখা ছিল -হ্যাঁ ভোট আর না ভোট। যার যেখানে পছন্দ , ব্যালট পেপারটা গুঁজে দিলেই হল। ভোটের বাক্সের পাশে এক বন্দুকধারী মিলিটারি দাঁড়িয়ে ছিল , বোধহয় ভোটারদের নির্ভয়ে ভোট দেওয়া সুনিশ্চিত করার জন্য ! এরকম ভোটের ব্যবস্থা কজন করতে পারেন , বলুন তো ?তবে , পুতিনকে আমি এই লেখায় জড়াচ্ছি না – দুর্জনে বলে , রাসপুটিন হ্রাস পেয়ে নাকি পুতিন হয়েছে !