বিছানায় শুয়ে উসখুশ করছিল সুখেন। ঘুম আসছে না। শিখার জন্য মন খারাপ লাগছে। সত্যিই এদিক টা তো ভেবেই দেখে নি ও। পিসিও বলল আর ও নিজেও আগু পিছু ভাবনা চিন্তা না করে মেয়েটাকে ঘাড়ে নিয়ে চলে এলো। দূর দূর। কোন মানে হয় এসবের ? এই জন্যই শিখা রেগে যায় ওর ওপর। এখন ভোগো। একবারও মনে হল না যে এনে তুলবে কোথায়?এইটুকু তো ঘর। আর ওই এক চিলতে দাওয়া। রান্নাঘর বলে আলাদা তো কিছু নেই। ঘরের পাশে দাওয়ার একধারে একটা টা লির ছাউনী। হয়ত বাড়ি ওয়ালা ভেবেছিল ওখানেও ভাড়া বসাবে। কিন্তু ঢোকা বেরোনোর জায়গা নেই বলে আর পারে নি। সেখানেই নিজের রান্নাঘর সাজিয়ে নিয়েছে শিখা। বর্ষাকালে জল পড়ে। উনুন নিভে যায়। তবু শিখা চেষ্টা চালিয়ে যায়। বরাবর ওর আলাদা রান্নাঘরের শখ। কাজের বাড়িতে দ্যাখে তো। সেই দেখেই ইচ্ছে হয় বোধহয়। সুখেন আর ওসবের শখ মেটাবে কী করে?সামান্য কারখানার চাকরি। তাই ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না। তবু শিখার আবদারে আলাদা কলঘর শুদ্ধু ঘর নিয়েছে। আর তাতেই দম শেষ। বাধ্য হয়েই তো কাজে ঢুকতে হল শিখাকে। ওসব কি ওদের জন্য ? কিন্তু শিখা হার মানার মেয়ে নয়। নিজেই সব ব্যবস্থা করল। সুখেনকে দিয়ে মাথায় প্লাস্টিক লাগিয়ে জল আটকালো। ইট পেতে তাতে তক্তা বসিয়ে দিব্যি তাক তৈরি করে নিলো। আবার নিজের ছেঁড়া শাড়ি দিয়ে তাতে পর্দা তৈরি হল। এমনিতেই কাজ ওর খুব পরিষ্কার। কৌটো কাটা, বাসন কোসন একেবারে পয় পরিষ্কার। ফলে ছিরি ফিরলো রান্নাঘরেরও। মোদ্দা বেশ দিব্যি একখানা সাজানো রান্নার জায়গা হয়েছে ওদের এখন। বাড়িওয়ালা জীবনবাবু দেখেও গেছে। ওটা বিনা ভাড়ায় ব্যবহার হচ্ছে বলে শুনিয়েওছে দু চার দিন। শিখার সঙ্গে পেরে ওঠেনি অবিশ্যি। স্পষ্টই শুনিয়ে দিয়েছে ও। “আপনি ভাড়া বসান না আমি জায়গা ছেড়ে দেব। পড়ে আছে তাই ব্যবহার করছি। কী এমন তাতে ক্ষতি হচ্ছে আপনার? বরং লাভই তো হচ্ছে জায়গাটা পরিষ্কার থাকছে। নইলে তো সাপ, খোপ, ভামের বাসা হবে ওখানে।” কথাটার যে যৌক্তিকতা আছে সেটা বুঝলেও জীবনবাবু ছাড়নেওয়ালা নয়। তারও সাফ কথা — জায়গা কি মাগনা পাওয়া যায়? ব্যবহার করতে গেলে ভাড়া দিতে হবে। দুজনের মাঝে পড়ে সুখেন তো তখন প্রমাদ গুনছে। কী জ্বালা ! শিখার রান্নাঘরের শখের জন্য আবার এক্সট্রা পয়সা গুনতে হবে নাকি? অবশ্য সেটা আর হল না। জীবনবাবু দু একবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন। দিতেই হল। না আছে দরজা না আছে কিছু। তালা দিয়ে যা রাখবে সে উপায়ও তো নেই। তাছাড়া কতদিনই বা আর এসে এসে পাহারা দেবে ? ফলে শিখার সাধের রান্নাঘর দিন দিন সেজে উঠতে লাগল । পারেও বটে ও। কোন কাজের বাড়ি থেকে তাদের পুরোনো একটা মিটসেফ নিয়ে এলো একদিন। অবশ্য নিজে আনতে পারেনি। সুখেনকে খবর পাঠিয়ে ওকে দিয়েই আনিয়েছে। তা জিনিসটা দিব্যি ! বেশ শক্তপোক্ত। জাল কিনে এনে লাগিয়ে আর রঙ করে নিতেই নতুনের মত ঝকঝক করতে লাগল। রান্না করা তরি তরকারি দিব্যি রেখে খাওয়া চলছে। আগে তো রান্নাঘরে দরজা নেই বলে ঘরেই রেখে যেতে হতো। খাবার জল , টুকিটাকি জিনিস সবই দাওয়ায় রাখতে হতো। এখন রান্নাঘরে রেখে নিশ্চিন্তে দাওয়ায় বসে দু দণ্ড জিরোতে পারে ওরা। বসতে পারে হাত পা ছড়িয়ে। বেশ লাগে কিন্তু সুখেনের। কেমন কাজ থেকে ফিরে এসে ছোট্ট দাওয়াটিতে দুজনে বসে চা খাওয়া। মাঝে মাঝে তেল নুন আর কাঁচা পিঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মেখে আনে শিখা। কী যে ভালো লাগে ! হোক না সুখেন একটা ছোট্ট কারখানার লেবার, হোক না শিখা দু বাড়ির রান্নার লোক। তবু ওই সময় টুকুতে নিজেদের যেন সবচেয়ে সুখী মনে হতো। শিখার সারাদিনের কাজকর্মের কথা, ওর কারখানার নানা লোক জনের গল্প, নিজেদের ছোট ছোট আশা আকাঙ্ক্ষার কথা বলতে বলতে কখন সন্ধ্যে পেরিয়ে যেত। শিখা উঠে গিয়ে গামলায় করে আটা নিয়ে এসে বসত। দাওয়ায় বসেই মাখত। মাখা শেষ হলে রান্নাঘরে ঢুকে যেত রুটি করতে। সুখেন চুপ করে সামনের দরজা খুলে তাকিয়ে বসে থাকত অন্ধকার আকাশের দিকে। এর পর দুজনে মুখোমুখি বসে খাওয়া। রাত কাটত একে অন্যকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু এখন ? সেসব কি তবে হারিয়ে যাবে?
অসাধারণ লাগছে পড়তে …. আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ….