কোথা ভেসে যাই
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
১)
….
জোয়ারের জল আর কিছুক্ষণের মধ্যে এসে বাগবাজারের ঘাটটিকে একটি নতুন দিনের জন্য নিয়ম করে মুক্তিস্নান করাতে চলেছে। শীতকাল সদ্য শেষ হয়েছে বলে চারপাশের দৃশ্যাবলী দিনের বেলা ইদানিং বেশ মনোরম ।
এরমধ্যে কয়েকটা কেরাঞ্চি গাড়ি তার ঘোড়াদের ক্ষুরের শব্দ উঠিয়ে চলে যেতেই দেখা যাচ্ছে আর তার একটু পরেই ক্রমশ পূবের আকাশটা একটু একটু করে লালচে হয়ে উঠছে।
এই গাড়িগুলো আসলে বাবুদের বনিতাপল্লী থেকে প্রায় বেহুঁশ অথবা অর্ধচেতন অবস্থায় নিজের ভদ্রাসনে ফেরার সময় জানান দেওয়ার শব্দ।
কলকাতার বাবু কালচারের এটাকে এক ধরণের ট্রেডমার্ক বলা যেতে পারে। গাড়ির ভিতরের মালিকটির হুঁশ না থাকলেও চলবে কিন্তু তার গাড়ি আর সহিস রাস্তায় হেঁকে ডেকে না চললে কাপ্তানির আসল মজাটাই তো মাটি! তাই সেটা তো আর হতে দেওয়া যায় না।
এরমধ্যে দু একজন বৃদ্ধ পুরোহিত হরিনাম গুনগুন করতে করতে ঘাটের দিকে এগোচ্ছেন। এই সময়ে স্নানাদিকর্ম সেরে তাদের কেউ কেউ যাবে যজমান বাবুদের ঘরে নিত্যসেবার ডাকে সাড়া দিতে আর কেউ যাবে মন্দির বা সেরকম কোন বাঁধা দেবালয়ের মাসিক পালার সামাল দিতে।
ঠিক একইসময়ে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে ঘাটের পোস্তার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। একটু কাছে আসতেই বোঝা গেল যে ওই আগন্তুকটির পর্বততূল্য ভারী চেহারাটিতে একটা দর্পী অথচ বীর ভাবের লক্ষণ আছে সেটাও বেশ প্রকট।
পথিকটি আর একটু এগিয়ে আসতেই বোঝা গেল যে তিনি এ তল্লাটের মোটেও অচেনা কেউ নন। বরং ইনি সাকিন কলকেতার একজন বিশিষ্ট ও মানী ব্যক্তি।
মধ্যবয়স্কলোকটি পেশায় সাহেব কোম্পানীতে বুক কিপার ছিলেন এই কিছুদিন আগেও। তবে নিজের চেষ্টায় তিনি অল্পবয়স থেকে বেশ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ আর বিদ্বান হয়ে উঠেছেন। গড়গড়িয়ে ইংরেজী আর বাংলা দুটোই বলতে পারেন, এমনকি সংস্কৃতও।
নিজেই নিজের মর্জিতে চলতেন এই কদিন আগে পযন্ত । আড়ালে লোকে বিশ্ববকাটে বলে নিন্দে করলেও সবাই জানে তাঁর মেজাজের মতই মাত্রাতিরিক্ত পানাসক্তি ও নারীসঙ্গ তাঁর সৃজনপটু মননটিকে কিন্তু একটুও ক্লেদাক্ত করতে পারেনি।
এর অবশ্য দুটো কারণ। তার মধ্য একটি অবশ্য সর্বজনবিদিত। বাংলা রঙ্গমঞ্চ আর তিনি এ দুটোর অস্তিত্ব আসলে সমার্থক। এমনকি খবরের কাগজও মেনে নিয়েছে যে লোকটি যেন ‘বাংলার গ্যারিক’ !
প্রহ্লাদ চরিত্র , চৈতন্যলীলা, সধবার একাদশী প্রভৃতি নাটক লিখে একাধারে যেমন একজন সফল নাট্যকার ও বাংলার স্টেজে সুঅভিনেতা হিসাবে থিয়েটারের আকাশে একজন নক্ষত্র বিশেষ হয়ে উঠেছেন তেমনই ঘনিষ্ঠ মহলের লোকেরা বোঝে যে তাঁর বাইরেটা শক্তপোক্ত হলেও ভেতরটা নারকেলের শাঁসের মতন কোমল। তাঁর নাটকের দলের দু’জন অভিনেতা অমৃতলাল বোস ও অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি এই দুজনে ওঁর পাশাপাশি বেশ নাম করে ফেলেছে বলে ওনার নিজেরও বেশ গর্ব হয় ।
একদা উনি সখেদে বলতেন যে ‘অনুগামী তো সবাই! সহগামী কই? ‘ সেসব আজ আর অতটা জোরের সাথে বলতে পারেন না। নিজের হাতে তৈরী করেছেন বনিতাপল্লী থেকে উঠে আসা বিনোদিনী, তিনকড়ি বা তারাসুন্দরীর মত অভিনেত্রীদের । তাঁদের মত এরাও তো আজ বাংলা থিয়েটারের একেকজন সম্পদ!
তবে এহেন চরিত্রের ক্লেদাক্তকরণ না হওয়ার অন্য কারণটি কিন্তু আরও চমকপ্রদ। বন্ধুবর সুরেন্দ্রের বাড়িতে আসা একজন ব্রাহ্মণসন্তান অথচ প্রেমদরিয়ার একজন দিব্যপ্রাণ নাবিকতূল্য মানুষ তাঁর ব্যক্তিজীবনের হালভাঙা ও পালছেঁড়া জীবনতরীটিকেও সস্নেহে নিজেই দিশা দেখাতে রাজী হয়েছেন। এমনকি তাঁর মদ্যপানাসক্তি ও থিয়েটার সংস্রবের বিষয়টিকেও ঘৃণা না করে বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর স্নেহকরচ্ছায়া।
সকলের সামনে আবার সেই মানুষটি এও বলেছেন – ‘ওর ধাত আলাদা। ওর দোষ হবে না। গিরীশের ভৈরবের অংশে জন্ম। ওকে মা কালীর মন্দিরে দেখেছি— উলঙ্গ অবস্থা, ঝাঁকড়া চুল, বগলে বোতল— নাচতে নাচতে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার বুকে মিশিয়ে গেল!’
তবে এসবের সাথে কথার ফাঁকে মায়াময় হাসিমুখে যেমন ‘ হ্যাঁগা আর কদ্দিন খাবি র্যা!’ এই প্রশ্নটির প্রশ্রয়বলে তাঁর নেশাটিকে যেমন ক্রমশঃ দূর্বোধ্য সংরাগে বদলে দিচ্ছেন আর ‘ যা কচ্চিস্ করে যা! থ্যাটারে লোকশিক্ষে হয়!’ বলে উজাড় করিয়ে নিয়েছেন এই মধ্যবয়স্ক নটটির সৃজন সম্ভারটিকে।
এসবেরই ফসল হিসেবে ‘বিল্বমঙ্গল ঠাকুর’ নামের আরও একটি নতুন নাটকের জন্ম দিয়েছেন গতরাত্রে।লেখার কাজটি সম্পূর্ণভাবে সেরে গতরাতে নির্ঘুম মস্তিষ্কটিকে বিশ্রাম প্রদানের জন্য তাই তিনি এখন বাগবাজার ঘাটের দিকে এগোচ্ছেন।
লেখার সময় একটু কারণবারি পান করলেও তার ঘোরটি আস্তে আস্তে কাটছে গাঢ়ে এখন ঠান্ডা জোলো হাওয়া এসে লাগছে বলে।
পিরানটি খুলে ধুতি গুটিয়ে জলে নামতে যাওয়ার আগে তাঁর পা ঠেকল একদলা কম্বলমোড়া একটি অবয়বের গায়ে। ‘ আহ্ মা গো’ বলে একটি অস্ফূট কাতর ধ্বনি কানে আসতেই তিনি লজ্জা পেলেন। নীচু হয়ে বসে কম্বল সরিয়ে আবিষ্কার করলেন এক অর্ধচেতন কৈশোর উত্তীর্ণ অভাগা মানবসন্তানের মুখখানি।
তার রোগজীর্ণ মুখটি এই সদ্যজাত ঊষাকালে তাঁর বড় চেনা চেনা ঠেকছে।
আরে! এই ছেলেটি তাঁদের বোসপাড়ার সেই ভবঘুরে ছেলেটা না! সে লোকের বাড়ির ফাইফরমাশ খেটে দু’পয়সা রোজগার করে বলেই তো জানেন!
এমনকি তিনিও তো ওকে দিয়ে গাছ থেকে জামরুল পাড়িয়েছেন! তবে পয়সা দেওয়ার সময় আবার কয়েকটি জামরুলও বেঁধে দিয়েছেন ছেলেটির গামছায়। তা এইসময়ে ছোঁড়াটা এখানে কি করছে? আর রোগ বাঁধালোই বা কি করে !
এবার তিনি নিজের ডানহাতটি দিয়েছেলেটির কপালে একবার ছুঁয়ে দেখলেন। নাঃ এতো সেই ছেলেটাই! আর কোন সন্দেহ নেই! গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
ভাবলেন ওকে ডেকে তুলে হাতে কিছু পয়সা দিয়ে যাওয়াই যায়। বেলা বাড়লে অবিনাশ কোবরেজের দোকান থেকে না হয় কিছু ওষুধ কিনে এনে খেতে পারবে।
পিরানটির দিকে হাত বাড়ালেন কয়েকটা পয়সা খুঁজে দেখার জন্য। গঙ্গার জলে জোয়ার ততোক্ষণে এসে গেছে। ছেলেটি অস্ফূট স্বরে ওনার হাতটি ধরে একবার বলে উঠল, ‘মা! মাগো!’
এই ‘মা’শব্দটি বুকের ভিতরে এসে সজোরে ধাক্কা দিল। ‘মা’! ডাকটির জন্য কাতর তো তিনিও। কবেই সব চুকেবুকে গেছে তাও মায়ের মুখটি মনে পড়লে তিনি এখনও কাতর হয়ে যান বৈকী।
চন্ডমূর্তিধারী তিনি আর মায়ের পদরেণুপ্রার্থী তিনি এই দুটো ভিন্ন চরিত্র কোন নাটকে এঁকে দিলে যা জমবে না! সব হাউসফুল! হাউসফুল!
….
ছেলেটি ঘোলাটে চোখে তাঁর মুখখানি দেখে বোধহয় চিনতে পেরেছে। হাতদুটো মাথার ওপরে তুলে একবার প্রণাম করতে না করতেই সে বুঝতে পেরেছে যে সে আর ঘাটে শুয়ে নেই। বরং পাঁজকোলা করে তাকে দুটি বলশালী সজোরে উঠিয়ে নিয়ে কোথাও যেন চলে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে গঙ্গা স্নান মুলতুবি রেখে নটসম্রাট ছেলেটি নিয়ে চললেন তাঁর বাড়িতে। বাইরের ঘরে শুইয়ে রেখে আপাতত একটু গরম দুধ আর নিজের হোমিওপ্যাথি চর্চার কয়েক দাগ ওষুধ দিলেই চলবে।
তারপর সোজা অবিনাশ কোবরেজের হাতে তুলে দিয়ে আসতে হবে। অবশ্য দিনকয়েকের পথ্য আর ওষুধের খরচ তিনি নিজেই দেবেন।
আজ যে সব গন্ডোগোল হয়ে গেল যে! ছোকরা তাঁর হাত ধরে ‘মা মা গো!’ বলে না কেঁদে উঠলে তিনি আদৌ এসব করতে যেতেন কি? নিজের মেজাজমর্জির মালিক গিরীশ চন্দ্র ঘোষের মধ্যেও তাহলে এত অবরুদ্ধ আবেগ জমা ছিল ! আজ ভোরে ছোকরাটির সাথে দেখা না হলে নিজেও সেটা জানতে পারতেন কি?
……..
২)
….
দিন কয়েক যমে মানুষে ছোকরাটিকে নিয়ে লড়াই চলল। দুবেলা কোবরেজের ঘর থেকে ওষুধ আনিয়ে খাওয়ান। প্রয়োজনে রাতের বেলা গরম দুধ আনান ভেতরবাড়ি থেকে। মানুষের ভালো করলে এত আনন্দ হয় বুঝি?
আজ সকাল থেকে অনেকটা সুস্থ দেখতে লাগছে। নাট্যাচার্য বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসলেন মহলাঘর থেকে। সামনের মাঘী পূর্ণিমায় ‘নিমাই সন্ন্যাস ‘নামের একটা নতুন থিয়েটার নামতে চলেছে। সচেতন ভাবেই এবার এই নাটকটিকে তিনি সাজিয়েছেন ‘চৈতন্য লীলা’র পরবর্তী কথনের আঙ্গিকে। সারাদিন কেবল পরমহংসদেবকে মহলার সময় বড্ড মনে পড়েছে। এই তো সেদিনের কথা। বিনি’র অভিনয় সেদিন মর্ত্যের দেবতাকে টেনে এনেছিল প্রান্তবাসী মেয়েদের দূয়ারে। সবাইকেই যেন তিনি স্পর্শ করেছিলেন ঐশী কিরণময় এক স্বপ্নালোকে। তিনি নিজে সেদিন কিন্তু একটু হলেও দ্বিধায় ছিলেন। ব্রাহ্মণ সন্তান সাথে সাধকোত্তম তিনি কি আদৌ ‘থ্যাটারে’র আসনটিতে বসবেন? আরাধ্যের জন্য পুষ্পবেদী কি গিরীশ কখনও সাজাতে পারবেন? কিন্তু আজ আর সেই দ্বিধাটি নেই।বরং কাশীপুরের বাগানবাড়িতে গিরীশ জোর গলায় বলে এসেছেন, ‘ব্যাস, বাল্মিকী যাঁর কথা সহজে বলতে পারেন নি! তিনি সামান্য মানুষ হয়ে তাঁর সম্পর্কে আর কি বা বলে উঠতে পারবেন ‘!
সেকথা শুনে সেই ভক্তপ্রাণ সাধকের মুখে লেগে থাকা স্মিত হাস্য সেদিন যেন ভুলিয়ে দিয়েছিল গলরোগের অতলস্পর্শী কষ্ট! আজ তাঁকে কথায় পেয়েছে। আস্তিন থেকে ছোট আকৃতির মদিরাপাত্র যেটি গিরীশের কাছে অমৃতকুম্ভ, সেই বোতলটিকে কয়েকটি চুমুক শেষ করে তিনি বেশ আয়েশ বোধ করতে করতে এসে দাঁড়ালেন ছোকরার সামনে।
সে জড়োসড়ো হয়ে উঠে বসতেই তাঁর হুঙ্কার শুনতে পেল, ‘ ওরে ছোঁড়া ! কি খপর রে তোর! শালা! তোর জ্বরোরুগীর ওই মায়াবী চোখদুটো আমার মত পাষন্ডকে কাবু করে দিল যে! নৈলে কেউ কি এই শর্মার চোখে জল দেখেছে কখনো? তুই কি আমার গতজন্মের কেউ ছিলি নাকি?
এবারে একখানা টিনের কৌটো এগিয়ে ধরলেন তিনি।
– ‘ শোন! এতে বারোটা টাকা আছে। তোর কাছে রেখে দে! কটা দিন পর আবার ভাতের খোঁজে বেরোস্ না হয়। জানিস্ তো সামনে একটা নতুন পালা নামছে। তাই সামনের কদিন কখন যে কোথায় থাকব তার ঠিক নেই। নে! রেখে দে দিকি!’
ছেলেটি অবাকচোখে তাকিয়ে দেখতে থাকে অল্পচেনা এই দয়াবান, বিদ্যাবান ও মেজাজী একজন পর্বততূল্য মানুষটিকে।
কঠিনতার মোড়কে এক কমনীয় বৈপরীত্য তাকেও এই ভরসন্ধ্যেবেলা তার মায়ের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। অসহায় বিধবা মহিলাটি তার শৈশবের কিছু দামী স্মৃতির গায়ে দাগ বুলিয়ে দিয়ে নিমতলার ঘাটে কবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! আজ এই সদ্য গোঁফ গজানো বয়েসে কয়েকঘর গৃহস্থের বাড়িতে নানা ফাইফরমাশ খাটা এই আপাত মূল্যহীন জীবনে কি তাহলে সব আলো লুকিয়ে আছে বিপ্রতীপের কালো অন্ধকারে? কথা সরছেনা আর। সে মুখে হাত ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে।
বিপরীতে বসে থাকা মানুষটি ততোক্ষণে জলদগম্ভীর গলায় বলে চলেছেন, ” জীবন আমাকে কেবল নাচিয়েছে রে ! বিশ্ববকাটে আমি যার মা নেই! বোন নেই! মেয়ে নেই! কেউ কোত্থাও নেই! কেবল যেন Scale of dragon, tooth of wolf,/ Witches’ mummy; maw, and gulf /Of the ravined salt-sea shark…! তবে এর মধ্যে থাকার মত থাকা দু-এক জনের ! একজন হলেন আমার গুরু! আর একজন তাঁর সহধর্মিনী! তুই দেখলে বুঝতি! যেন সাক্ষাৎ ভগবতী ! এই ওষ্ঠে আঙুল স্পর্শ করে গরাস্ তুলে ভাত খাইয়ে দিয়েচেন আমায়! একদম যেন আসল মা’ ! ব্যস্ ব্যস্! এরা ছাড়া আর কেউ ছিলনা এতদিন। আর সব বাকিটা স্টেজ! সেখানে শুধু তিরস্কার আর পুরস্কারের বৈচিত্র! হা হা হা! “
….
৩)
এসবের মধ্যে আরও কয়েকমাস অতিক্রান্ত। লোকে যাদের বাউন্ডুলে বলত সেই দলের দুই জ্যোতিষ্ক নরেন ও কালী এই দুজন আপাতত বিদেশে জোরকদমে পরমহংসদেবের কথা প্রচার করছেন।
ভুল হল! তারা দুজনেই শ্রীরামকৃষ্ণ আলোকে এক নতুন ভুখন্ডকে পৃথিবীকে চিনতে শেখাচ্ছে। যেন অদ্বৈতস্বরূপ ব্রহ্ম ছল করে বিশ্বকে প্লাবিত করে দিচ্ছে প্রেমস্বরূপা জাহ্নবীর মত।
গিরীশ এসব সংবাদ পেলেই পুলকিত হন। ওদিকে জয়রামবাটীতে তাঁর শক্তিস্বরূপিনী মা বেশ অনেকদিন হল গিয়ে অবস্থান করছেন।
ঠাকুরের চেলাদের অনেকেই অবশ্য কলকেতায় একটা বাড়ি যোগাড়ের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। যেন একটি নতুন দেবীপীঠস্থানের জন্য মাটি যোগাড় করে তাদের মা’কে সেখানে প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে সব ব্যর্থ।
এদিকে গিরীশ মনে মনে চাইছেন যে মা’র বাসাটি তাঁদের বোসপাড়ার কাছাকাছি হলে বেশ হয়। বাংলা থিয়েটার যেন মানিনীর মত আজকাল তাঁকেও প্রত্যাখ্যান করতে চাইছে। সব জ্বালা জুড়িয়ে এবার তিনি শান্ত ছেলের মত মায়ের আশ্রয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চান।
সকালে গঙ্গার ঘাটে স্নান করতে এসে শুনলেন ঘাটে খুব শোরগোল শোনা যাচ্ছে। তাহলে কি সদ্য বর্ষায় ইলিশ মাছের নৌকো এল। একি তারই হাঁকডাক?
একটু এগোতেই দেখলেন পুলিশের দুজন হাবিলদার এসে চাটাইতে করে মরা নিয়ে যাচ্ছে। লোকমুখে শুনতে পেলেন ঘাটে স্নান করতে এসে ডুবে মরেছে কেউ। তারই লাশ চালান যাচ্ছে এখন। পুলিশের হাবিলদারেরা আর একটু কাছে আসতেই দেখতে পেলেন মরদেহটি।
একটি সদ্য কৈশোর পার করা ছেলে শুয়ে আছে সেটায়। গঙ্গার জল ঢুকে ফুলে গেছে গোটা শরীর। ঈষৎ হাঁ করা মুখটিতে যেন অর্ধসমাপ্ত বাচনের অসহায় ছোঁয়া। চোখ বিস্ফারিত, তবুও যেন মায়াময়!
এইরকম নির্মম মৃত্যু গিরীশ এ জীবনে কম দেখেন নি। তাও আজকাল চেনা মানুষের নিষ্প্রাণ অবয়ব তাঁকে নাড়া দিয়ে যায়। এবারেও তার অন্যথা ঘটল না। সেদিনের জ্বরতপ্ত সেই কিশোরের অক্ষম ‘মা’, ‘মা’ ডাকটি যেন আবার নতুন করে শুনতে পেলেন।
ঘাট থেকে বাড়ির পথ ধরতে ধরতে চোখের পাশটা মুছে নিলেন। ধরা গলায় বলে উঠলেন, ” যাঃ ব্যাটা ! তোরও দেখচি যে বেমালুম ছুটি হয়ে গেল ! দিব্যি পূণ্যি করিছিলি তো ! “
—oooXXooo—