ভিটের টানে (চতুর্থপর্ব)
সলিল চক্রবর্ত্তী
ফেলে যাওয়া সেই ভিটের টান” অনুভূতিটা আমার সহধর্মিণীর। স্থান,কাল,পাত্র অতীতের স্মৃতিকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে।
ভোর পাঁচটায় এ সি লাক্সারি রকেট সার্ভিস বাস এসে দাঁড়াল খুলনার সাতক্ষীরা বাস স্ট্যান্ডে । এটি একটি মফস্বল শহর।
বাস থেকে নামতেই একটা ফুরফুরে শিতল মনোরম বাতাস সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল, যেটা বাসের ভিতরের কৃত্রিম ঠাণ্ডার সাথে কোনভাবেই তুলনা করা চলে না। গ্রামের মাটিতে পা পড়ায় আমার স্ত্রী একটু চিৎকারের সুরে মেদিনী ছুয়ে প্রণাম করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের একটা লাইন গেয়ে উঠল-” ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।” ভাগনে পল্লবের থেকে আমার স্ত্রী খুব একটা বড় নয়। ছোটো বেলায় একসাথে খেলাধুলা করেছে। স্মৃতির সমুদ্রে আমার স্ত্রী হাবুডুবু খাচ্ছে। উত্তেজনায় দুই হাত সোজা করে, বাতাসের অভিমুখে ফিরে বলল- ” পল্লব, মনে আছে, ভোরবেলা উঠে এমন ফুরফুরে ঠাণ্ডা বাতাসে আমি,তুই,আর ভাই ঘোষালদের বাগানে আম কুড়াতে যেতাম।” পল্লব যেন মাসির কথায় শৈশব ফিরে পেয়ে বলল-” মনে নেই আবার! তোর মনে আছে,ভোর হয়েছে ভেবে রাত সাড়ে তিনটের সময় গফুর চাচার কবরের পাশে আম কুড়াতে গিয়ে ভয় পেয়ে —-।”
—- সে কথা কি ভুলি! জামাইবাবু তোকে এক ঘন্টা,আর আমাকে আধ ঘন্টা কান ধরে উঠোনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।
আমি চুপচাপ লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ওদের সাঁইত্রিশ আটত্রিশ বছর আগের ফেলে আসা স্মৃতির সমুদ্রে বিচরণে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি। আমি ওদের অনুভূতিকে অনুভব করতে পারছিলাম, কারন আমার শৈশব বসিরহাটের এক অখ্যাত গ্রামেই কেটেছে। আমাদের স্মৃতির সরণীতে ব্যাঘাত ঘটাল এক টোটো ওয়ালা এগিয়ে এসে। ভাড়া ঠিক করে টোটোয় চাপলাম, চললাম গাজীরহাট, পল্লবদের ভিটে বাড়ি।
রাস্তার ডান ও বাম পাশে যতদুর চোখ যায় শুধু সবুজে সবুজ ধানখেত, তার মাঝখান দিয়ে চলেছে কালো ঝা-চকচকে পিচ রাস্তা। ড্রোন থেকে ছবি তুললে মনে হবে ঠিক যেন সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে একটা দৈত্যাকার অ্যানাকোন্ডা চলেছে।
আধ ঘন্টার উপর চলার পর আমার সহধর্মিণীর চোখ দুটো আবার চকচক করে উঠল। হঠাৎ চিৎকার করে বলল-” এই তো সেই গাজীরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। সেই মাঠ, সেই বাগান!” পল্লব মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল-” শুধু লম্বা এল প্যাটার্ন টিনের চালাটা এখন দোতলা বিল্ডিং হয়েছে। মাসি ওই দেখো, সামনে সেই ভাঙাচোরা বারোয়ারী স্থান। এখন কতবড় মন্দির হয়ে গেছে।”
— ও,তাহলে তো আমরা গাজীরহাট মোড়ের মাথায় এসে গেছি।
—- হ্যাঁ, এবার পাড়ায় ঢুকব।
টোটো বড় রাস্তা থেকে গ্রামের সরু পিচের রাস্তায় ঢুকল,সামান্যই এগিয়ে ইঁট পাতানো রাস্তায় ঢুকল। আমার স্ত্রী আর উত্তেজনা প্রশমণ করতে না পেরে বলল-” এই পল্লব, এটা সেই ঘোষালদের আমবাগান, এ-কি রকম আছে!! এ-ই তোর বাবার মামার বাড়ি! কিছুই তো পাল্টাই নি, আমি আবাক হচ্ছি, বাড়িগুলো আগে যেমন দেখে গিয়েছিলাম তেমনই রয়েছে!! এতো বছরে কোনো পরিবর্তন নেই!!” পল্লব মাসিকে একটু উত্তেজনা কমিয়ে দম নিতে দিয়ে বলল-” বাড়ি ঘর করে কি হবে কেউ থাকে নাকি, বুড়োবুড়িতে থাকে, ছেলেরা তো বিদেশে।” আমার স্ত্রী আবার বলে উঠল -” এটা ঘোষবাড়ি না? সেই সামনে বড়বড় দুটো পুকুর, এই পুকুরে যে কত সাঁতার কেটেছি। গামছা দিয়ে তেলাপিয়া মাছের বাচ্চা ধরতাম, পল্লব মনে আছে তোর?” পল্লব হাসতে হাসতে বলল-” মনে তো আছেই সেই সাথে এটাও মনে আছে, গামছায় আঁশটে গন্ধ হওয়ায় বাবার কাছে কেমন গাঁট্টা খেতাম।” মাসি বোনপোর সেকালের স্মৃতি চারনে আমার কাছে একটা ব্যাপার খানিকটা পরিষ্কার হল—
কোলকাতায় কিছু বয়স্ক মানুষ, যাঁরা জন্ম সূত্রে বাংলাদেশী, তাঁদের কাছে শুনেছি, তাঁদের নাকি ভিটে বাড়ি ছিল চার বিঘার, বাড়ির মধ্যে তিনটে পুকুর, ত্রিশটা নারকেল গাছ, আম,জাম,কাঁঠাল ইত্যাদি ইত্যাদি—–। সাধারণত কোলতার লোকেরা শুনে মুচকি হেঁসে ভাবে, এ-সব আবেগে মন গড়া গল্প। আসলে গল্প নয় বাস্তব। এক সময় বাংলাদেশের জনগনের ত্রিশ শতাংশ হিন্দুদের দখলে ছিল স্থল ভাগের সত্তর শতাংশ জমি। বর্তমানে এই অঙ্কটা ঠিক উল্টে গেছে। তাতেও হিন্দুদের পরিস্থিতি প্রায় একি রকম। উদাহরন স্বরূপ,এক হিন্দু ভদ্রলোকের ভিটে বাড়ি ও বাগান নিয়ে ছিল আট বিঘার উপর,আর চাষের জমি ছিল বিঘা চল্লিশের। ভদ্রলোকের চার সন্তান, স্বাধীনতার পরে দুই সন্তান চলে আসে ভারতে। হয় ভিটের মায়া ত্যাগ করে,অথবা সামান্য মূল্যের বিনিময়ে শরীকদের উইল করে দিয়ে। আবার যে শরীকরা থাকল তাদের উত্তরসূরীরা একই ভাবে কিছু থাকল, কিছু ভারতে চলে এলো। জমি যেটুকু কমে চাষের জমি, ভিটেতে হাত পড়েনা। এখানকার হিন্দুরা নুতন করে সম্পত্তি বাড়ায়নি, বাড়িয়েছে লিকুইড মানি। যেটা চট করে অন্যের নজরে পড়বে না। ফলে আমার সহধর্মিণী চল্লিশ বছর আগে হিন্দু এলাকার মানুষের বাগান সহ ভিটে বাড়ি যেমন দেখে গিয়েছিল, আজও সে সব তেমনি অক্ষত আছে। পাশাপাশি কোনো এক মুসলিম ভদ্রলোকের যদি একই সম্পত্তি ধরে নিই, সেখানে পরবর্তীকালে সেই সম্পত্তি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এর প্রধানত দুটি কারন, এক মুসলিমদের বহু বিবাহ প্রথা, দুই ভারতে আসার তাগিদ না থাকা। ফলে পরিবারের শরিকানার চাপে ভিটেবাড়ি,চাষের জমি টুকরো হতে হতে তলানিতে এসে পৌঁছায়। উভয় ক্ষেত্রেই এর ব্যাতিক্রম আছে। তবে সেটা উদাহরণ হতে পারেনা। যে সব মুসলিম পরিবার সম্পত্তি না বাড়াতে পেরে শুধু মাত্র পৈতৃক সম্পত্তি ভোগ দখল করে এসেছে তারাই এখন বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষ। যাদের মাথা গোঁজার জন্যে সামান্য ভিটে বাড়ি টুকু আছে। অন্যের জমিতে দিন মজুর বা অন্যান্য ছোটখাটো কাজকর্ম করে পরিবার প্রতি পালন করতে হয়। অফ সিজেনে এই সব প্রান্তিক মানুষ দলে দলে চোরাপথে বর্ডার ক্রস করে প্রতিবেশী দেশে যায় কিছু নগদ অর্থের আশায়। সাহিত্যিক শৌর্য দীপ্ত সূর্যের ‘মরা কার্তিকের কাব্য ‘ উপন্যাসটি সংগ্রহ করে পড়তে পারলে এই সব প্রান্তিক মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আখ্যান পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানা যাবে। যাইহোক,পাশাপাশি প্রান্তিক হিন্দু বলে বিশেষ কিছু নেই। সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায় যারা আছে তাদের আর্থিক কষ্ট তেমন নেই বটে তবে এক অজানা আশঙ্কায় থাকে, হয়ত সেই জন্যেই হিন্দু জনসংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে। জনসংখ্যার নিরিখে বাংলাদেশে হিন্দুরা বর্তমানে চতুর্থ স্থানে। প্রথমে মুসলিম সম্প্রদায়, দ্বিতীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়,তৃতীয় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়।
ভাবনার মধ্যে টোটো এসে দাড়াল একটা ছিমছাম একতলা বাড়ির বড়সড় গেটের সামনে। এটিই আমার বড় শ্যালিকার বড়ি। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে আমি রীতিমতো তাজ্জব! মাতৃভক্ত পল্লব এমন এক অজ পাড়াগাঁয়ে আধুনিক সুবিধা সমন্বয়ে এক ক্ষুদ্র প্রাসাদ বানিয়ে নিয়েছে। একলা বসবাস করার জন্যে তার মায়ের যেন কোনো রকম অসুবিধা না হয়।
আমার স্ত্রীর সাথে বড়ো শ্যালিকার প্রায় কুড়ি বছর পর দেখা। দুজনে যখন অপ্রত্যাশিত দেখা হওয়ার আনন্দে মসগুল, ততোক্ষণে আমি ও পল্লব ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরি মধ্যে তাপস নামে বছর ত্রিশের একটি ছেলে এলো এক খাদি ডাব ঘাড়ে করে। পল্লব তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল-” মনে আছে তো সব? সমবায় সমিতিতে গিয়ে খোদাবক্স চাচাকে বলবি পল্লবদা বাড়ি এসেছে।” তাপস মাথা নেড়ে চলে যায়। তারপর পল্লব সমস্ত বাড়িটা ঘুরেঘুরে আমাকে দেখাতে থাকল। কাঠা দশেক জমির ওপর অর্ধেক বাড়ি, অর্ধেক বাগান। বাড়ির সামনে লনে বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ লাগানো। সমস্ত বাড়িটা উঁচু পাঁচিল তুলে ঘেরা। বাগানটা আবার তার কাঁটার বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাড়ি বললে ভুল হবে, এ যেন অরণ্য দেবের বাগান বাড়ি। যদিও ছাদে উঠে তেমন কিছু বোঝা যায়নি, চারদিকে আম,জাম,কাঁঠাল গাছের জঙ্গল, তার মধ্যে বাড়ি।ত্রিসীমানায় আর কোনো বাড়ি দেখতে পেলাম না। পল্লবকে কারন জানতে চাইলে সে বলল -” আসলে জমিটা দাদুর বাগান বাড়ির শেষ সীমানায়। এখান থেকে বাবার মামার বাড়ি দেখা যায় না।” ছাতে সোলার প্লেট বসানো দেখে পল্লবের কাছে জানতে চাইলাম ঢাকা মেট্র সিটির মতো এখানেও কি সোলার সিস্টেম বাধ্যতামূলক? পল্লবের উত্তর শুনে একটু অবাক হলাম-” না, বাধ্যতামূলক নয়, তবে মা একা থাকে তো রাত-বিরেতে বিপদাপদ!!” বিপদাপদ শব্দটা শুনে আমার কেমন যেন খটকা লাগল। পাল্টা প্রশ্ন করতে যাব এরই মধ্যে তাপস হাঁক পাড়ল -” ও পল্লবদা চা হয়ে গেছে নিচে এসো।”দুপুরে খাওয়ার আয়োজনে বেশ বাঙালি আনার ছোঁয়া ছিল। মাছ ছিলো প্রমাণ সাইজের ট্যাংরা,পাবদা,কই। সঙ্গে ছিলো দই। পেট রোগা মানুষ আমি,আয়োজনের মর্যাদা দিতে পারিনি। ফলে বড়দিকে অখুশি করে দুপুরে মস্ত একটা ভাতঘুম দিলাম।
সাড়ে চারটায় বিকালের চা রেডি করে বড়’দি ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন। চায়ের আড্ডায় আমার স্ত্রী কথায় কথায় দিদিকে আবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল-” এই নির্জন পুরিতে তুমি একা থাক কি করে?? ভুত,প্রেতকে না হয় ভয় পাওনা, চোর ডাকাত কে তো ভয় করে না কি!!!” দিদি একটু বিষন্নতার হাঁসি হেঁসে বললেন- ” যে কয়দিন বাঁচি ওদের সাথেই বেঁচে থাকব।” আমার স্ত্রী উচ্চ স্বরে বলল- ” তুমি কি পাগল!!!” দিদির মুখে বিষন্নতার এ-কি রকম হাঁসি। আমার ব্যাপারটা একদম ভাল লাগলনা। “যে কয়দিন বাঁচি ওদের সাথেই বেঁচে থাকব”, কথাটা শুনে কোথায় যেন একটা রহস্যের গন্ধ পেলাম। এরি মধ্যে পল্লবের ফোন আসল। পল্লব ফোনে কথা শেষ করে আমাকে বলল-” চলুন মেসো, সমবায় সমিতি থেকে খোদাবক্স চাচা ফোন দেছে, আজ আপনার অনারে ইফতার পার্টি হবে।” আমি আর পল্লব হাটা পথে গাজীরহাট মোড়ের দিকে হাটতে থাকলাম। এই পাড়াটায় হিন্দু ধর্মের মানুষের বসবাস। ফলে রাস্তাঘাটে লোকজন যেমন কম,বাড়িঘর তো প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু একের পর এক আম কাঁঠালের বাগান আর বাগান। আমার মনের কথা অনুমান করে পল্লব বলল-” হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন কেন যে ইণ্ডিয়া চলে যাচ্ছে বুঝিনা।” মনেমনে হেঁসে ভাবি, কোথাও নিশ্চই একটা আশঙ্কা উঁকি মারে। পল্লব বেশ জোর দিয়ে বলল-” জানেন মেসো বড়মামা যখন জলের দামে ভিটে বাড়ি জমিজমা বেচে চলে যায়, আমি তখন খুব ছোটো। আজকের দিনে হলে আমি এমনটি হতেই দিতাম না। দেখতাম কোন মিঞার ঘাড়ে কটা মাথা আছে। তবে আমার ইচ্ছে আছে মিঞা সাহেবদের কাছ থেকে ওই সম্পত্তি একদিন ফিরিয়ে আনব।” ফেলে যাওয়া মামাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে আনার অদম্য ইচ্ছেকে আমি কুর্নিশ না করে পারলাম না।
“পল্লব এখানে”, আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি। রাস্তার পাশে এক পাল্লা ওয়ালা বড় ঘরের ভিতর থেকে ডাক ভেসে এলো। পল্লব ভিতরে প্রবেশ করে আমার সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দিল। খোদাবক্স ভাই তাঁর পাশের চেয়ারে আমাকে বসতে দিলেন। আমার সামনের টেবিলে একজন মুসলিম ভাই ফল কেটে থার্মোকলের প্লেটে সাজাচ্ছেন। পল্লব সমবায়সমিতি খোঁজখবর নিতে সেখান থেকে অন্যত্র সরে যায়। আমি অগত্যা মুসলিম ভাইদের সাথে খেজুরে আলাপ জমিয়ে দেই। আসরে কিছু হিন্দু ধর্মের মানুষও আছেন। আমি বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে খোদাবক্স ভাইয়ের কাছে জানতে চাই ইফতার মুসলিম ধর্মে কি নির্দেশ করে। খোদাবক্স ভাই আমাকে প্রাণ জল ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন-” কিছুই না, শুধু মাত্র একটা প্রথা। যেমন হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো বাড়িতে পূজা পার্বনে পরিবারের লোকজন সকাল থেকে উপবাস করে পুজোর পর নিমন্ত্রিত অতিথিদের প্রসাদ বিতরণ করে নিজেরা ফলমূলাদি আহার করে উপবাস ভঙ্গ করে, ঠিক তেমনি আমরাও নিষ্ঠাচিত্তে রোজা শেষে মেহমানদের ফলমূলাদি বিতরণ করে নিজেরা নিয়ম ভঙ্গ করি। এর মধ্যে কোন ধর্মের বেড়াজাল নেই, আছে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।” ইতি মধ্যে সকলে চলে এলো, এবং প্রত্যেককে পৃথকভাবে আট দশ রকমের ফল, দু’রকম তেলেভাজা,ঘুগনি,সিমাই সহযোগে প্লেট সাজিয়ে দেওয়া হল। টেবিলের মাঝখানে রাখা হল বড় একটা টিসু পেপারের বাক্স। প্রসঙ্গক্রমে বলি, আমাদের কোলকাতায় টিসু পেপার ব্যবহার করা হয়, হোটেল,রেষ্টুরেন্ট, অনুষ্ঠানবাড়ি, বা উচ্চবিত্তের গৃহে। কিন্তু বাংলাদেশে উক্ত ক্ষেত্রে টিসু পেপার ব্যবহার তো হয়ই,এমনকি মধ্যবিত্ত,সাধ্যবিত্তের গৃহেও টিসু পেপারের ব্যবহার প্রচলিত। যাইহোক ইফতার পার্টিতে সন্ধ্যেটা গল্পগুজবে সুন্দর ভাবেই কাটল। আমি একটু ঘুরে ফিরে দেখতে থাকলাম। বাস রাস্তার দুইদিকে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু দোকান পাট, যেখানে সন্ধ্যার পর বেচাকেনা যা হয় তারথেকে মজলিস হয় বেশি। এক-একটা দোকান যেন এক একটা সংবাদ চ্যানেল, সন্ধ্যায় গ্রামের লোকেদের নিয়ে ডিবেটে বসে যায়। ভারতীয় দ্রব্য বর্জন ঠিক না ভুল, হাসিনা সরকার জনগনের জন্য কতটা মঙ্গল জনক,ইত্যাদি ইত্যাদি। চলতে থাকে এই নিয়ে বিরামহীন তর্কযুদ্ধ। শ্রোতা হিসেবে ভালই লাগছিল। আটটা নাগাদ রসভঙ্গ করে বাসায় ফিরছি। বাগানের মধ্যে দিয়ে পথ,এত নিকষ কালো অন্ধকার যে পাশে থাকা পল্লবকে ছায়ার মতো দেখছি। পরিস্থিতি সম্মুখীন হ’য়ে পল্লবকে জিজ্ঞেস করলাম,ইলেকট্রিকের পোস্ট আছে অথচ পোস্টে একটা লাইট নেই! পল্লব তো আর এখানে থাকেনা, কি আর উত্তর দেবে, শুধু হেঁসে বলল-” গ্রামের মানুষ অন্ধকার ভালবাসে, সেই জন্যেই তো অন্ধকারে পড়ে আছে।”
রাতে সবাই মিলে একসাথে খেতে বসেছি। ইলেকট্রিক লাইট জ্বলছে, কিন্তু চারদিক এতটাই অন্ধকার যে লাইটের তীব্র জ্যোতিকে মুহুর্তের মধ্যে শোষণ করে একটা লো ভোল্টেজের মিনমিনে আলো ছড়াচ্ছে। খেতে খেতে আমাদের আগামি কয়েক দিনের ঘোরাঘুরির মাস্টার প্লান তৈরি চলছে। দিদি আমাদের পরিবেশন করতে ব্যাস্ত। উনি রান্নাঘরে কিছু একটা আনতে গেছেন,হঠাৎ রান্না ঘরের টিনের চালে নারকেল পড়ার মতো একটা বিরাট আওয়াজ হল। পল্লব খাওয়া ফেলে এক লাফে ছুটে গেল রান্না ঘরের দিকে। মিলি আমার থেকে একটু তফাতে খেতে বসেছিল, সে ধড়ফড় করে খানিকটা আমার দিকে সরে এসে আমার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। সবাই ক্ষণিকের জন্যে চুপচাপ। তারপর দিদি বললেন-” চল, খেতে চল, খাওয়া ছেড়ে উঠলি কেন! টিনের চালে আম পড়েছে হয়ত।” পল্লব মায়ের পরিস্থিতি সামাল দেওয়াকে উপেক্ষা করে বলল-” আম পড়ার শব্দ? বেল পড়লেও এত জোরে শব্দ হয়না। একমাত্র নারকেল, কিন্তু সে গাছ তো রান্না ঘরের থেকে অনেক দূরে!” দিদি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন-” তুই যে আজ এখানে এসেছিস ওরা মনে হয় বুঝতে পারেনি।” আমার গালে দলা পাকানো ভাতটা রয়েই গেছে, শব্দ শোনার পর আর গিলতে পারিনি। মিলি কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে উঠল -” এ-সব তোরা কি বলছিস!!” পল্লব সাহস যুগিয়ে বলল-” তোমরা যা ভাবছ,সে-সব কিছু নয়। খাও আমি বলছি ব্যাপারটা।” দিদি বললেন-” মধ্যে বেশ কয়েক মাস সব কিছু বন্ধ ছিল, আবার মাস ছয়েক হল প্রায়ই রাতে এই ভাবে জ্বালাচ্ছে।” পল্লব তাচ্ছিল্যের সুরে বলল-” দেখো তখন হয়ত জেলের ঘানি টানছিল।” মিলি অশরীরীর ভয় পেলেও আমি মা ছেলের কথোপকথনে ব্যাপারটা শরীরী না অশরীরী তা বুঝে উঠতে পারলাম না। এরই মধ্যে ঠিক সেই এ-কি রকম আওয়াজ আবার হল। পল্লব খেতেখেতে উঠে দাঁড়িয়ে একটা গ্রাম্য বাজে ভাষা বলে চিৎকার করতেই, সব যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ বাগানের দিক থেকে মচ্ মচ্ করে শুকনো পাতার উপর দিয়ে পায়ে হাঁটার শব্দ দূরে সরে যেতে থাকল। ভয়ডরহীন ভদ্র মহিলা, আমার শ্যালিকা কেমন নিশ্চিন্তে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন-” যাক বাবা,আজ আর জ্বালাতে আসবে না।” দিদির এই স্বস্তির বাক্যটি আমাকে যে কতগুলো প্রশ্নের মুখে ফেলে দিল সেটা দিদি ঘুনাক্ষরেও টের পেলেন না।
কোনো রকমে খাওয়া দাওয়া শেষ করে,দিদির ঘরে মিলি এবং পল্লবের ঘরে আমি শুতে গেলাম। মিলির ইচ্ছে ছিল চারজনেই এক জায়গায় শুই। সেটা হলো না, কারণ দিদি কিন্তু ঘটনাটিকে তেমন গুরুত্ব দিতে নারাজ। সন্দেহটা আমার দানা বাঁধছে এই জায়গা থেকে।
গরমকাল,একতলা বাড়ি, চার জানালা বিশিষ্ট বড়ো ঘর। পল্লব চারটি জানালা খুলে দিয়ে বলল-” দারুণ দক্ষিণা বাতাস মেসো, পাখা না হলেও চলে, কি বলেন?” আমি পল্লবের ইচ্ছের উপর নির্ভর করতে না পেরে মৃদু স্বরে বললাম, মনে হয় জানালা বন্ধ করে পাখার হাওয়াই ভাল ছিল। পল্লব তো আমার কথা শুনলোই না,বরং হেঁসে বলল-” ভয় পাচ্ছেন ও কিছু না, আরে এখানে কিছু ছিঁচকে চোর আছে, পুলিশের কেস শর্ট পড়লে ওই গুলোকে তুলে নিয়ে যায়। যেহেতু এই এত বড়ো বাগান বাড়িতে মা ছাড়া কেউ থাকেনা ফলে ওই ছিঁচকে চোর গুলো নিরাপদ স্থান হিসাবে এই জায়গাটাকে বেছে নিয়েছে।” আমি শুধু শুনলাম, মনে একটা প্রশ্ন আসল কিন্তু করলাম না। প্রশ্নটা হল, চোর যখন নিশ্চন্ত আশ্রয়ে পালিয়ে থাকবে তখন গৃহস্বামিনীকে উৎপাত করবে কেন, তাতে তো তারই সমস্যা হবে। আমার ভাবনার মধ্যেই পল্লব ঘুমিয়ে পড়ল, এবং উচ্চ স্বরে নাসিকা গর্জন শুরু হল। পোড়া চোখে আমার ঘুম আসছে না। বাইরের আলোয় ঘরের ভিতরটা ছায়া ছায়া অনুভব হচ্ছে। বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছে জানালার দিকে। মনে হচ্ছে কে যেন জানালা ধরে দাড়িয়ে আমাদের দুজনের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে চিত হয়ে শুয়ে থাকলাম।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা, মনে একটা ত্রাস তো ছিলই, ফলে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল একটা মৃদু শব্দে। সতর্ক হলাম, হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছি। ছাতে বুট পরে হাটার শব্দ। গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে উঠল। পাশে পল্লব ঘুমের দেশে, সেটা ওর নাসিকা গর্জনই বলে দিচ্ছে। মৃদু স্বরে নাড়া দিয়ে ওকে ডেকে তুললাম। ঘুম চোখে আওয়াজটা শুনে বলে উঠল-” হারামজাদাটা আবার এসেছে??” এই বলে লাফ মেরে উঠে পাঁচ সেলের একটা টর্চ লাইট বার করে বলল-“চলুন তো ছাতে।” রাত তিনটে বাজে, কি জ্বালায় পড়লাম রে বাবা। না পারব ঘরে একা থাকতে, না ইচ্ছে করছে মাঝরাতে ওর সাথে ছাতে যেতে। অগত্যা পল্লবের পিছু নিলাম। নিঃসাড়ে দরজা খুলে আমি আর পল্লব ছাতে গেলাম। কিন্তু কোথায় কি!! শোঁশোঁ করে বাতাস বইছে, আর একটা উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধে জায়গাটা ভরে আছে। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, ছাতে শুধু আমরা দুজন নেই। শরীরটা ভার হয়ে গেল। পল্লবের গা ঘেঁষে দাঁড়াতে পল্লব বলল-” এই দেখুন মেসো, টিনের চালে শুকনো পাতা ভর্তি, কিন্তু এ-ই জায়গায় পরিষ্কার। ব্যাটা এই জায়গা দিয়ে ছাতে ওঠে নামে। ঠিক টিনের শেষ প্রান্তে জাম গাছ আছে, ওখান দিয়ে নেমে যায়। দাঁড়া তোদের ওঠাচ্ছি, কালই জাম গাছটা কেটে ফেলব।” এবার আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না, প্রশ্ন করলাম, বুটের আওয়াজ পাচ্ছিলাম যে!
— আরে সাপপোকের ভয় আছেনা।
—- বুট পরে কি জামগাছ দিয়ে ছাতে ওঠা সম্ভব!
— আরে ওরা পারেনা এমন কোন কাজ আছে।
— তা হলে এই উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধটা!
— মশার কামড়ের ভয়ে ওরা পোড়া মোবিল জাতীয় কিছু মেখে আসে। ডেঙ্গু,ম্যালেরিয়ার ভয় আছে না!!
এ দেখি সব প্রশ্নের উত্তর সিলেবাস দেখে মুখস্ত করে রেখেছে। আমি আর প্রশ্ন করে বিব্রত না করে বলি, অনেক হয়েছে চল নিচে যাই।
সিঁড়ি দিয়ে নামছি, টর্চের আলো জ্বলছে নিভছে। হঠাৎ আমার নজরে আসল নিচে বারান্দার অন্ধকারে কে যেন দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। আমি আঁৎকে উঠে পল্লবের হাত চেপে ধরি। পল্লব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনি ছায়া মূর্তিটি ব’লে উঠল-” ভয় পাওয়ার কিছু নেই,আমি দিদি।” ধড়ে প্রাণ এলো, কাছে এসে জানতে চাইলাম আপনি এখানে? দিদি বললেন-” ঘুম আসছিলনা, ছাতে হাঁটার আওয়াজ আমি শুনতে পেয়েছি, তারপর দেখলাম তোমরা ছাতে যাচ্ছ,সেই জন্যে উঠে—-” আমি জিজ্ঞেস করি মিলি কোথায়? দিদি জানালেন-” ও ঘুমাচ্ছে।” ভাগ্যিস ঘুমাচ্ছে, না হলে ওর চিৎকারে সত্যি সত্যি ভুত ভয় পেয়ে পালাত।
বড় শ্যালিকা একমগ চা নিয়ে বসে শুরু করলেন বাড়িতে ঘটে চলা কিছু অস্বাভাবিক কাহিনি —–
” এই সম্পত্তি বাজার মূল্যের থেকে কমদামে কিনলেও তোমার দাদার মোটা টাকা ধারদেনা হয়ে যায়। এদিকে পল্লব তখন সবেমাত্র কাজে কর্মে ঢুকেছে। মাথার উপর বিবাহ যোগ্যা মেয়ে,ক্ষমা। এই চাপ উনি নিতে পারলেন না। সবকিছু ফেলে পরপারে চলে গেলেন। তারপর তো পল্লব ভেসে যাওয়া সংসারটাকে ধীরে ধীরে টেনে তুলল। ক্ষমার বিয়ে দিল, পাকা বাড়ি করল, নিজে বিয়ে করল। ওকে পাকাপাকি ভাবে ঢাকায় থাকতে হয় বলে বাড়িটা যতটা সম্ভব সুরক্ষিত করল। কাল হল সেখানেই, আপন,এবং পর কিছু পরশ্রীকাতর মানুষ পল্লবের এই উন্নতিটা ভাল নজরে দেখেনা। বাড়ির ব্যাপারে উল্টোপাল্টা প্রস্তাব দেয়। আমার আর পল্লবের এক মত,দাম যতই উঠুক বাড়ি বেচব না। যাইহোক এই ভাবেই এত বছর চলছিল। কোনো সমস্যা ছিলো না। বছর দুয়েক এই উটকো ঝামেলা এসে জুটেছে। যত দিন যাচ্ছে ততো উৎপাত বাড়ছে। পল্লব বাড়ি থাকলে তেমন উৎপাত করে না। কিন্তু যখন না থাকে, তখনি–, এই তো মাস খানিক আগের ঘটনা– হঠাৎ মাঝরাতে ‘ঠক্ ঠক্’ শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় উঠে বসি। কিছুক্ষণের জন্যে শব্দটা বন্ধ হল বটে তবে আবার শুরু হল, জানালার বাইরে থেকে টোকা মারার শব্দ ‘ঠক্ ঠক্।’ আমি কোনো কথা বলছিনা বলে, শব্দটা এ জানালা, ও জানালা করতে থাকল। এবার আমি চিৎকার করে বলি, কি চাও তুমি? আমি জানিনা, তুমি হিন্দু, না মুসলিম। আমি বা আমার ছেলে তোমার তো কোনো ক্ষতি করিনি। তা হলে কেন আসো এখানে! এই কথা বলার পর শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল,এবং সেই সাথে একটা বিশ্রী পচা গন্ধে পেট গুলিয়ে উঠল। তারপর বাগানে মচমচ করে শুকনো পাতা মাড়িয়ে পায়ে চলা শব্দ, ধীরে ধীরে দক্ষিণের মাঠের দিকে চলে গেল।”
আমি-তো রীতিমতো স্তম্ভিত। প্রশ্ন করি, আর কখনো কিছু? দিদি ভাগ্যের পরিহাসের উপর একটা বিরক্তির হাঁসি হেঁসে বললেন-” ছোট খাট ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে তবে মধ্যে আর একদিন ঘুম ভাঙল পেট্রলের ঝাঁঝালো গন্ধে। আমি বুঝতে পারি সে এসেছে। লাইট না জ্বালিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকি। হঠাৎ ‘দম দম’ করে বারান্দায় কিছু পড়ার শব্দ হয়। আমি এবার চিৎকার করে বলি, কেন একটা অসহায় মানুষকে রাত-বিরেতে এসে এই ভাবে জ্বালাও! কি চাই তোমার? আমার কাছে হাজার খানিক টাকা আর কয়েকটা শাড়ি আছে, কাঁসার ঘটিবাটি সোনা রুপো যা ছিল কয় মাস আগে তো সব চুরি করে নিয়ে গেছে। কাল সকালে এসে সেটাও নিয়ে যেও। আমার কথা শুনে মনে হয় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, কেমন একটা পাশবিক শব্দ করতে করতে উঠনে পায়চারি করতে থাকল। যদিও বারান্দার কোলাপসিবল এবং দরজা খোলা ততোটা সহজ নয়,তবুও কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। খানিকক্ষণ এমন চলার পর গাছ ভাঙার শব্দ পেলাম। এবার আস্তে আস্তে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল। “
আমি আকুতো ভয় দিদিকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, আর কখনো? দিদি একটু নিরূপায়ের হাঁসি হেঁসে বললন-” কত আর বলব! এখন আমি আর গায়ে মাখিনে, ওসব গা-সয়া হয়ে গেছে। একদিন রাত্রে আমার ঘুম আসছে না বলে টিভি চালিয়ে কোলকাতার সিরিয়াল গুলো বসে বসে দেখছি। মধ্য রাত্রি, হঠাৎ সমস্ত ঘর পাকা আনারসের গন্ধে ভরে উঠল। অথচ তখন আনারসের সময়ই নয়। বুঝলাম সেই আপদ নিশ্চই এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে অটমেটিক ঘরের লাইট,টিভি অফ হয়ে গেল। আমি শুয়ে পড়ি, ঠিক করলাম ওকে পাত্তাই দেব না,আপদটা বাইরে নাচন কোঁদন যা পারে করুক।”
আমার স্ত্রী এতক্ষণ ভয়ার্ত চোখে দিদির সাহসিকতার কাহিনী মন দিয়ে শুনছিল,এবার সে মুখ খুলল-” তুমি কি মানুষ?? এই ভাবে দিনের পর দিন ভোগ করে যাচ্ছো।” দিদি সেই একি রকম হাঁসি মাখা মুখে বললেন-” এখন আর ভয় করে না,সব সয়ে গেছে।”
এরি মধ্যে পল্লব এসে পড়ল। আমি ওর কাছে জানতে চাই বিষয় টা নিয়ে থানা পুলিশ করেছে কিনা। ও বলল-” না মেসো, লাভ তো কিছু হবে না, বরং বাড়ি সম্পর্কে এলাকায় অপপ্রচার হবে।” কথাটা যুক্তিযুক্ত। আমি যেটুকু বুঝতে পারলাম, এরা মায়ে বেটায় বিষয়টাকে অশরীরী মানতে নারাজ,যদিও আগন্তুকের আচরণ শরীরী এবং অশরীরী উভয়ের আচরণকে গুলিয়ে দিচ্ছে। ফলে দুটো বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে লাভ নেই। তবে কি শরীরী কিছু?? যদি হয় তবে কি হতে পারে!! আমার যেটা মনে হয়, এমন সুন্দর বাড়ির উপর অনেকের লোভ আছে এটা প্রমাণিত। পল্লবের এখানে যা প্রভাব জোর করে কিছু করাও সম্ভব নয়। তবে একটা পথ খোলা,সেটা হল ধীরে ধীরে বাড়িটাকে হান্টেড হাউজে পরিনত করা। একবার প্রচার হয়ে গেলে বাড়ির দাম আর জলের দামে কোন প্রভেদ থকবেনা। এবং তেনারা সেই কর্মই করে চলেছেন।
মটর সাইকেলের হর্ণ বেজে উঠল। আমাকে নিয়ে পল্লব চলল মিনি সুন্দরবন দেখাতে।