নৈহাটি জংশন
বাসুদেব চন্দ
উদম সিং এবং বলবন্ত সিং দুই বন্ধু। পাঞ্জাবি হলেও ভারি সুন্দর বাংলা বলেন। দুজনেই ভারতীয় রেলওয়েতে চাকরি করেন।
মাস ছয়েক হল ট্রান্সফার নিয়ে ওঁরা কলকাতায় এলেন। মিষ্টি স্বভাবের এই দুই বন্ধু তাঁদের প্রতিবেশী এবং অফিস কলিগদের কাছে খুব পছন্দের মানুষ! কিন্তু দোষ ঐ একটাই, দেরি করে পৌঁছনো! যাকে বলে অকুপেশনাল ডিজিজ। তবে লোকাল ট্রেনে ছিলেন বলে খুব একটা দেরি হতো না।
আশ্চর্যজনকভাবে তিন মাস অন্তর অন্তর নির্দিষ্ট একটি দিনে নৈহাটি জংশনে নির্ধারিত সময় পার করেও চার-পাঁচ মিনিট দেরিতে ট্রেন ছাড়তেন! যে যাঁর গাড়ি থেকে মাথা বের করে খুব মনোযোগ দিয়ে কাউকে যেন খুঁজতেন! প্যাসেঞ্জাররা রেগে গিয়ে গালমন্দ করলেও ওঁরা তেমন গায়ে মাখতেন না! কখনও মাথার পাগরিটা ঠিক করে বসিয়ে নেওয়ার ভান করতেন, কখনও বা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে কোমরের বেল্টটা টাইট করে প্যান্টটা ওপরের দিকে তুলতে ব্যস্ত থাকতেন।
এভাবে অহেতুক দেরি করার কারণে ওপর থেকে বেশ কয়েকবার ওয়ার্নিংও জুটেছে! কিন্তু তাতেও “কুছ পরোয়া নেহি” ভাব! কারণটা কোনোদিনই কাউকে খুলে বলেননি। তবে এটা নিয়ে বেশিদূর জলও গড়ায়নি। কারণ ঐ সামান্য দেরিটুকু ওঁরা বাকি রাস্তায় অনায়াসেই মেকআপ করে দিতেন।
এভাবেই মহা আনন্দে চাকরি জীবন কাটাতে কাটাতে একদিন রিটায়ারমেণ্টের ঘণ্টাটি ঢং করে উঠল। সেদিন শুধু ওঁদেরই নয়, অফিসের সবারই মন খুব খারাপ হয়ে গেল! এত ভালো সহকর্মী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার!
আর দেখা হবে না, কারণ ওঁরা দেশে ফিরে যাচ্ছেন! যাইহোক, দেখেশুনে দিনক্ষণ ঠিক হল ফেয়ারওয়েল দেওয়ার জন্য। বন্ধুরা প্রসঙ্গ তুলতেই উদম সিং বললেন-
“আমাদের জন্য তোমরা কোনও উপহার কিনো না ভাই, ঐ দিন একটি উপহার আমরা নিজেরাই চেয়ে নেব”।
বন্ধুরা বললেন-
“সে নাহয় হবে খোন, কিন্তু শেষ দিনে অন্তত বলে যাও, নৈহাটি-জংশনে কোন গার্লফ্রেন্ডের জন্য তোমরা অপেক্ষা করে থাকতে? তাঁদেরও নিশ্চয় বাড়িতে নিয়ে যাবে! যাওয়ার আগে আমাদের সঙ্গে পরিচয়টুকু তো করিয়ে দাও ভাই”!
বলবন্ত সিং বললেন- “ঠিকই বলেছো; গার্লফ্রেন্ডের কথা নিশ্চই তোমাদের বলব, তবে আজ নয়, ঐ দিন”।
ওঁরা যতই বলুক; বন্ধুরা শুনবে কেন, ঠিক হল অবসরকালে চাওয়া না চাওয়া সব উপহারই ওঁদের দেওয়া হবে!
সত্যিই তাই হল- আয়োজনে কোনও ত্রুটি রইল না। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলে একেক করে দীর্ঘ কর্মজীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলো উল্লেখ করলেন। উদম সিং এবং বলবন্ত সিংও আবেগানন্দে আপ্লুত হয়ে পড়লেন! সকলের চোখে জল, হাতে রুমাল ! একজন চোখ মুছে বললেন- “আরে ইয়ার রুলানেসে কাম নেহি চ্যলেগা , ওয়াদা তো নিভানাই প্যড়ে গা”!
উদম সিং নিজে এক ঢোক জল খেয়ে নিয়ে সবার দিকে জলের পাত্রটি এগিয়ে দিলেন।
বলবন্ত সিং উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে নৈহাটি-জংশনের কথা বলতে শুরু করলেন।
একদিন ঘড়ি ধরে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলবন্ত সিং লক্ষ করলেন, একজন বয়স্কা মহিলা উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা উদম সিং এর ডাউন-গাড়ির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে কাঁপা কাঁপা পায়ে ওঁর গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন! সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে দিলেন, এবং মহিলা কামড়ায় উঠে এলে তবেই গাড়ি ছাড়লেন!
মাস তিনেক বাদে আবারও সেই একই ঘটনা ঘটল! শুধু তাই নয় , তিন মাস অন্তর অন্তর প্রথম রোব্বারেই এই ঘটনাটি ঘটছে! ওঁরা নিশ্চিত হবার জন্য একদিন এক হকারের কাছ থেকে পুরো ঘটনাটি জানলেন।
ভদ্র মহিলার স্বামী হৃদয় ঘোষ। ছোট খাটো একটি ব্যবসা করতেন। জমি বাড়ি সব বেচেবুচে দিয়ে দুই ছেলেকে ডাক্তারি পাশ করিয়েছেন। দুজনেই হার্ট স্পেশালিষ্ট। একজন কলকাতায় আর একজন ব্যাণ্ডেলেও কোনও এক হাসপাতালে আছেন। ভাগাভাগি করে মা বাবাকে নিজেদের কাছে রাখেন। এই বুড়ো বুড়ি তিনমাস অন্তর অন্তর এখানে একে অপরকে কাছে পান মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য! তাই বিপদের ঝুঁকি নিয়েও ঠাকুমা স্বামীর সঙ্গে দেখা করে খবর নেন! নিজের হাতে তৈরি করা হজমের বড়ি দেন! আঁচল দিয়ে স্বামীর চোখের কোণের ময়লা পরিষ্কার করতে করতে বলেন-
“সব সময় হরিনাম জপ করবা, তয় আর কষ্ট পাবা না”!
দাদু কিছু বলে না; ঠাকুমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে! দাদুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে! ঠাকুমার হাতটা চেপে ধরে থাকে, ছাড়তে চায় না কিছুতেই ! ঠাকুমা বুঝিয়ে-সুজিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিজের গাড়িতে এসে বসে”!
ঠাকুমা বলে-
“বউমা’রা আমারে ভালবাসে, কারণ আমি কষ্ট হইলেও নাতি-নাতনিগো দেখাশুনা করতে পারি, বউমা’গো হাতে হাতে কামকাজ করতে পারি। কিন্তু তোমার দাদুতো কিসুই পারে না, উল্টা হ্যারে করতে হয়। তাই কোনও বউই তেনারে রাখতে চায় না!
আমার হইসে জ্বালা!
গোপালরে সব সময়ই কই , ওনারে যেন আমার আগে লইয়া নেয়! এ’ভাবে বাইচ্চা থাহনের কোনও মানেই হয় না! কষ্ট দেতে হয়, গোপাল আমারে দিক, পুরুষ মানুষ কী আর কষ্ট সইতে পারে”!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হকার ছেলেটি বলে- “মা’গুলি এরকমই হয়”!
*******
তারপর থেকেই ওঁরা নৈহাটি জংশনে এসে ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে ঐ হতভাগ্য বুড়ো-বুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকেন! শেষের দিকে প্রায় সকলেই এই ঘটনাটি জেনে গেছিলেন বলে আর কিছু বলতেন না!
*******
অনুষ্ঠানের শেষে ওঁরা হাতজোড় করে বলেন- “এটা যেন বরাবরের জন্য পালন করা হয়- তাহলেই ওঁদের সেরা উপহার পাওয়া হবে”!
সেদিন কেউ কোনও কথা দিতে পারেননি! লজ্জায়, ঘৃণায় সকলের মাথাই নীচু হয়েছিল, চোখে ছিল জল!
*******
হে হৃদয়,
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তুমি ৯:৩২ এর ডাউন লোকাল আর উনি ৯:৩৭ এর আপ লোকালের যাত্রী ! মাঝের সবকিছু আবর্জনা আর বিসর্জন !
*******