সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। ঘন হয়ে আসছে মেঘ। মায়ের ভীষণ দুশ্চিন্তা। বাবা বাড়ি ফেরে নি। দুটো ছেলে মেয়ে নিয়ে এই একপ্রান্তে থাকা। তার উপর তুমুল ঝড় বৃষ্টি শুরু হবে। জানালা গুলোর আগল নেই। হু হু করে ঢুকবে জল। ঘরের মেঝে জল থৈ থৈ করবে। ভয়ে মালবিকার মা সিঁটিয়ে আছে যেন। টিকটিক করে কি সাধে। কতবার বলেছিল “ওগো। চাল বাড়ন্ত। আগে চাল ঢোকাও।” তা শুনলে তো। আপনমনে গজগজ করতে লাগল মাধবী। মালবিকা বললে “অত ভাবনার কী আছে। আমি দরকারী সব জিনিস দেয়ালের পাশে উঁচু তক্তাতে তুলে দিয়েছি। ওখানে জল যায় না। ভাই আর আমার বই খাতাও রেখেছি। তুমি চিন্তা করো না”।
ঝড় উঠল। তোলপাড় করল সবকিছু। ঘরের জানালার কপাট না থাকলে এমন তো হবেই। যতবার কুপি জ্বালাতে যায় ততবার হাওয়ার দাপটে নিভে যায়। ম্যাচবাতিটাও কেমন সেঁদিয়ে গেছে। এর মধ্যেই ছোট্ট ভাইটা গুনগুন করে কাঁদে। “আমার খিদে পেয়েছে। অ মা। খেতে দাও”।
মা রাগে খিচিয়ে ওঠে। “অন্ধকার রাতে তোমাদের আর আছে কি? বলি দুপুরে একথালা ভাত খেয়ে আবার খিদে? তোমাদের খিদে কেন এতো শুনি”।
তেরো বছরেই মালবিকা যেন কত বোঝে। তার মনে হয় এই ঝড় বারবার ওদের জীবন তছনছ করতে আসবে। তবুও লড়াই করে বাঁচবে ওরা। ভাইকে প্রবোধ দেয় “একটু চুপ কর ভাই। ঝড় থেমে গেলেই আমরা চিঁড়ে খাবো।”
মা অবাক হয়। বললে “চিঁড়ে কোথায় পাবি”?
মালবিকা বললে “তোমার কিছুই মনে থাকে না আজকাল। গতমাসে কুটিঝারা ধানগুলো রাধি পিসিকে দিলাম। এক কৌটো চিঁড়ে দিয়ে গেছে। খুব ভাল চিঁড়ে। ঘরে কোটা”।
অন্ধকার। তাই মালবিকা দেখতে পেল না এই কথায় মায়ের মুখে সে কী স্নিগ্ধ হাসি। ঝড় থেমে গেল। বাবা এসেছে। আবার কুপি জ্বলেছে। ব্যাগে চাল এনেছে বাবা। ধুতিটা ভিজে গেছে। বললে “উফফফ। কী ব্যাঙ ডাকানি বৃষ্টি! ঘরের মেঝের জল ছেঁচতে লেগেছে বাবা। মেয়েকে ডেকে বললে “আমার অফিসের ধুতিটা একটু কেচে দিবি মা। এক জায়গায় কাদা লেগে গেছে”।
মালবিকা তাড়াতাড়ি বাবার আদেশ পালন করে। মনে মনে ভাবে বাবার এই একটাই ভালো ধুতি। আমাদের জন্য মানুষ টা সংসার সমুদ্রে কান্ডারী হয়েছে। অত্যন্ত করুণায় বাবার জন্য মালবিকার কান্না আসে। মনে মনে ভাবে একদিন নিশ্চয়ই আসবে। সেদিন বাবাকে আলমারি ভর্তি পোশাক দেবে মালু।
বাবা ঘরটাকে আবার আগের মতো সুন্দর করে ফেলেছে। উনানের জল পরিস্কার করে কাঠের উনুন জ্বালিয়েছে মা। কৌটোর চিঁড়ে সর্ষের তেল আর শুকনো লঙ্কা দিয়ে ভাজতে বসেছে মা। তারপর চা হল। অসীম তৃপ্তিতে সবাই খাচ্ছে। হঠাৎই মালবিকার নজরে এল বাড়ির উঠানে সার দিয়ে চলছে কৈ মাছ। একছুটে চলে গেল সে। মা চিৎকার করে। অন্ধকারে কী করিস। সাপ থাকতে পারে।
একসাথে এত মাছ দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় মালবিকা। ছোট্ট ভাই ওর সাথে সঙ্গ দেয়। পনেরটা মাছ। পেটে এক পেট করে ডিম। একটু আগে যে সংসার টা ভাবছিল ঝড় এসে তাসের ঘরের মতো সবকিছুই দুমড়ে মুচড়ে যাবে এখন সেখানে যেন নতুন উদ্দীপনা। এখন গোটাবাড়িতে ফুটন্ত ভাতের গন্ধ। তার সাথে কৈ মাছ রান্না হবে। রাজকীয় খাওয়া। যাদের কেউ নেই, কিছুই নেই, তাদের উপর প্রকৃতি মা এমনি করেই তাঁর কল্যাণ হস্ত বাড়িয়ে দেন।