গনগনে মুখে রুটি সেঁকছে শিখা। বেলছে, ভাজছে আর তারপর জ্বলন্ত উনুনে ফেলে ফোলাচ্ছে। আগুনের লকলকে শিখায় লাল টকটকে দেখাচ্ছে ওর মুখ। ঘরের এক কোণে বসে দেখছে সুখেন। বুঝতে পারছে। রাগ হয়েছে ওর। আজ তারকেশ্বর থেকে বাড়ি আসার পর ওর সঙ্গে রিন্টিকে দেখেই মাথা গরম হয়ে গেছে ওর। একবারও বুঝতে চাইছে না ওখানে গিয়ে কি অবস্থায় পড়ে মেয়েটাকে আনতে বাধ্য হয়েছে ও। আরে শখ করে কি কেউ এসব ঝামেলা ঘাড়ে নেয়? তাও এই বাজারে? বলেছে সুখেন। কিন্তু শিখার ধারাই ওই রকম। শুধু মাথা গরম করবে। আগাগোড়া কিছু বুঝতে চাইবে না। মাথা ঘুরিয়ে একবার বাইরের দাওয়াটার দিকে চাইল সুখেন। মেয়েটা এসে থেকে এক ভাবে বসে আছে ওখানে। বুকের ভেতর একটা আলগা কষ্ট অনুভব করে সুখেন। ইচ্ছে করে বলতে একটু হাত মুখ ধুয়ে ভেতরে এসে বসতে কিন্তু শিখার যা মেজাজ। আসতেই যা মুখ ছোটালো ! এরপর ওই মেয়ের হয়ে কিছু বললে আবার কি করতে কি করবে কে জানে বাবা ! দূর দূর এই দেশের বাড়ীতে যাওয়াই কাল হল ওর। কিন্তু ওই যে — পিসিটা বেঁচে আছে এখনো। বাপ মা মরার পর ওই বুড়িটাই মানুষ করেছে যে। ডাকলে না গিয়ে পারে না ও। আর গিয়েই এই কাল হল। কি করে জানবে পিসি এরকম একটা অদ্ভুত প্রস্তাব করবে? প্রথমে তো কিছু বুঝতেই পারে নি। সেই কোন ভোরে বেরিয়ে পৌঁছতেই তো বেলা দুপুর। ডাব পাড়িয়ে রাখা ছিল। সেটুকু খেয়ে একটু ঠাণ্ডা হয়ে চান করে এসে ভাত পাতে বসেছে। টুক টুক করে কত কি রান্না করেছে বুড়ি। মানকচু বাটা, বকফুলের বড়া, মোচার ঘণ্ট, চুনো মাছের ঝাল, আমড়ার অম্বল। অনেকদিন পর এত ভালো করে ভাত খেল যেন ও। পিসির হাতের রান্নার স্বাদ আজও তেমনি আছে। শিখাও মন্দ রাঁধে না কিন্তু এত তরিবতি নেই ওর হাতে। আসলে সময়ই বা কই? সকালে দু বাড়ি রান্নার কাজ করে ও। আবার বিকেলে এক বাড়ি। ফলে নিজেদের ঘরের রান্না সংক্ষেপেই সারতে হয়।
খেয়ে দেয়ে সবে চোখটা একটু বুজেছে অমনি গুটিগুটি পায়ে পিসি এসে হাজির। সঙ্গে ওই মেয়ে। এসে ইস্তক সুখেন দেখেছে মেয়েটাকে। রান্নাঘরে পিসির সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করছে। ভেবেছে আশেপাশের ঘরেরই কেউ হবে। পিসি একা মানুষ। এরকম অনেকেই এসে এটা ওটা করে দিয়ে যায়। অবিশ্যি এমনি নয়। পিসির দেওয়া থোয়ার হাতটি ভালো। অনেক না হলেও পিসে মরার আগে কিছু জমিজমা রেখে গেছে। তো সেসব নিজেই লোক লাগিয়ে চাষবাস করায়। সত্তর বছর বয়স হলে কি হয় এখনো দিব্যি খটখটে আছে। বাড়ির চৌহদ্দিতে নিজের হাতে সবজি ফলায়। ভাগে পুকুরও আছে একটা। তাতে মাছটাছ হয়। ছেলেপুলে নেই। চলে যায় ভালোভাবেই। সুখেনের কাছে হাত পাতে না কখনো। উল্টে দেশের বাড়ি থেকে ফেরার সময় নিজেই ব্যাগ বোঝাই করে ভরে দেয় শাক সবজি ফল পাকুড়। আজও তো এনেছে কত কি। তাকিয়ে দেখল শিখা? দেখল শুধু ওই রিন্টিকে। আর দেখেই মাথা ঘুরে গেল ওর। অবিশ্যি পিসির প্রস্তাব শুনে মাথা ঘুরে গেছিল সুখেনের নিজেরও। প্রস্তাব শুনে তো শোওয়া থেকে লাফিয়ে উঠেছে সুখেন। ঘুম টুম মাথায় উঠে গেছে ওর। বলে কী বুড়ি ! এ কি সম্ভব নাকি ? বলা নেই কওয়া নেই এই এত বড় একটা মেয়েকে হঠাৎ করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুললে শিখা তুলকালাম করবে। আর শিখা বলার জন্যই বা কী? ও নিয়ে যাবেই বা কেন? এত বড় সোমত্ত মেয়ের দায়িত্ব কেউ নেয়? পরে কোন ঝামেলায় পড়লে ? না না এ অসম্ভব। কিন্তু পিসি এমনভাবে কাকুতি মিনতি করতে লাগল যে গোটা ঘটনাটা শুনতে বাধ্য হল ও। আর ব্যাপারটাও সত্যিই নেহাত ফেলে দেবার মত নয়। বিপদে পড়েছে মেয়েটা। রীতি মত কঠিন বিপদ। ছোটবেলায় বাবা মা কে হারিয়ে কোন এক সম্পর্কিত জ্যাঠার বাড়িতে পড়েছিল এতদিন। জ্যাঠা জেঠিমা যতদিন ছিল দুমুঠো ভাত আর এর ওর ফেলে দেওয়া কাপড় চোপড়ে চলে গেছে এতদিন। আর পিসি তো পাশে ছিলই। কিন্তু এখন তারা দুজনেই চোখ বুজেছে। তবু জ্যাঠতুতো ভাইদের লাথি ঝাটা সহ্য করে তারপরও পড়েছিল মেয়েটা। কিন্তু এখন আবার নতুন উপদ্রব। ভাইয়েরা ওর বিয়ের উদযোগ করেছে। পিসি প্রথমে শুনে ভেবেছে যাক এতদিন মেয়েটার গতি হবে একটা।
অসাধারণ অসাধারণ অসাধারণ