এই গল্পের নায়িকা মালবিকা।জনাই এর কাছে একটা স্কুলের দিদিমণি। যার কাছে জীবন মানে লড়াই। একটা পথ যখন পার হতে হয় তখন কত ঝড় ঝঞ্ঝা আসে মানুষের জীবনে। মালবিকার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটে নি। আর একটা ব্যাপার থাকে। সেটা হল রূপ। মানুষ মুখে বলে বটে গুণ আগে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় রূপের পিছনে সবাই ছোটে। এর সঙ্গে যদি পৈতৃক মোটা টাকা বা সম্পত্তির মালিক হয়ে যায় কেউ তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু আমাদের গল্পের নায়িকা মালবিকার তথাকথিত চটকদারি সৌন্দর্য ছিল না। গড়পড়তা শ্যামলা রঙ, শান্ত আর স্নিগ্ধ একটা অবয়ব। আর পৈতৃক সম্পত্তির কথা বলতে গেলে একটা ভিটে ছিল সম্বল। অনেক কষ্ট করে এটুকু দাঁড় করিয়েছিল তার গরীব বাপ। তাও নীচু ছাদ।
মালবিকার তখন কত ই বা বয়স। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। আর ছোটো ভাই তখন সবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে। একান্নবর্তী সংসার থেকে পৃথক করে দেওয়া হল বাবাকে। অন্য কাকারা বললে “তোমার সংসার বড়ো। খেতে চারটে প্রমাণ পেট। যে টাকা দাও তাতে এ বাজারে চলে না। “ বাবা একটা কথাও কইলে না। রাস্তার পাশে পৈতৃক জমি ভাগে পেল কিছুটা। তৈরি বাড়ি ভাগ করে নিলে অন্য কাকারা। মালবিকা এতদিন বাপ কাকার মধ্যে কোনও পার্থক্য বোঝে নি। কিন্তু একদিন সে নিজেই শুনতে পেল কাকাদের বাক্যালাপ। “তাড়াতাড়ি বিদায় করো পাপগুলোকে। নইলে ওই কেলে পিলসুজের মতো মেয়েটার বিয়ে দেবে আমাদের ঘাড় ভেঙে”। খুব দুঃখ হয়েছিল মালবিকার। বাবা শিখিয়েছিল “মালু রে। বাপ যা,কাকাও তাই। আমার রক্ত বইছে ওদের ও শরীরে। ওদের অমান্যি করিস নি কখনও “।
মালবিকার জ্ঞান হয়েছে এখন। এই বাড়িতে বড়ো কুসংস্কার। তার মন চাইছিল যেমন করে হোক বাবা যেন একটা বাড়ি করতে পারে। আর রাস্তার ধারে চলে গেলে এদের নজর থেকে কিছুটা দূরে যাওয়া যাবে। যে লোক গুলো তার আপনার মনে হতো এখন মনে হয় এরা অনেক দূরের বাসিন্দা। কাকাদের মেয়েরা বেশ রূপসী। টানা টানা চোখ। সে তুলনায় মালবিকা একেবারেই তুচ্ছ। সবথেকে আশ্চর্য এই বাড়িতে তাকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হোতো। কিন্তু তবুও মালবিকার খ্যাতি ছিল তার স্কুলে। পাড়া প্রতিবেশীরা মালু বলতে অজ্ঞান। এই তো সেদিন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাড়িতে এসে বলে গেছেন “মালবিকা মা একটা হীরে। দেখো। আর পাঁচজনের মতো সকাল সকাল বিয়ে দিও না। আমার বিশ্বাস। এ মেয়েটার মধ্যে আগুন আছে। তেজ আছে।” তাই শুনে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছিল কাকীমারা। বলছিল “অ্যা! একেবারে বিদ্যাসাগর হবে যেন”।
অবশেষে মায়ের বিয়ের হার বিক্রি করে ঢালাই দিয়েছিল বাবা। মা অজানা আশঙ্কাতে আকুল হয়ে পড়ছিল। অন্য মেয়েদের সাথে নিজের মেয়েটার তুলনা মাকে কাবু করে দিত যেন।
নতুন বাড়িতে যখন মালবিকারা উঠে এলো তখন তাতে প্লাস্টার নেই। জানালায় পাল্লা নেই। চটের থলে আটকে দিলে বাবা। চারদিক শুনশান। এখনও এখানে বাড়ি হয়নি কারো। শুধুই বাড়ির সামনে আছে একটা গুল আর কয়লার দোকান। সামনে দিয়ে বাস যাচ্ছে। এই প্রতিবেশে এসে মালবিকা যেন মুক্তির স্বাদ পেলো। বাড়িতে একটা পাতকুয়া। সেখান থেকেই জল তুলে বাসন মাজতো মালবিকা। একটু দূরে রাস্তার কল থেকে ঘড়ায় করে আনতো জল। ভাই এর সাথে খুনসুটি আর সাঁঝের বেলায় বইপত্র সাজিয়ে পড়তে বসা।