বেণীখুড়ো মরা মাছের মত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, “বোঝো! প্রেমিকের বাদশা একেবারে। প্রেমের নাম শুনেই আহা আহা করতে লেগেছে। পুরোটা শোন, না কি? সে বড় দর্দনাক দাস্তাঁ। “
সৃঞ্জয় আর অঙ্কুর বোঁওও করে স্টিলের কেটলিটা নিয়ে কান্তির চাএর দোকানের দিকে ছুটলো। গোগোল দেবতার সামনে নৈবেদ্য অর্পণের ভঙ্গিতে বিড়ির একটি কুমারী প্যাকেট খুড়োর সামনে রাখলো।
গোগোল নিজের চুলের মুঠিটা খিমচে ধরলো। সৌভিক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গোগোলের পিঠে হাত দিয়ে নরম গলায় বললো, “আরে ভাবিস না, তোরও রেজাল্ট ভালোই আসবে …এখন চেপে যা, নইলে গপ্পোটা হাতছাড়া হবে। “
-তোদের মত এত বোঁওওও করে বাইক হাঁকিয়ে কলেজ যেতুমনা আমরা। ট্রেনে চেপে দু স্টেশন ডাউনে গিয়ে, তারপর প্যায়দলতে প্যায়দলতে সোজা কলেজ। হিস্ট্রি পাসের ক্লাসটি কম্বাইনড ক্লাস হতো ইংরিজি, বাংলা আর পল সায়েন্সের ছেলেমেয়ে মিলিয়ে।
সেদিন বোধহয় বাস্তিল পতনের কারণ পড়াচ্ছিলেন নীতিশবাবু। আমি লাস্ট বেঞ্চের একটাতে চোখ বুঁজে বসে আছি। কলম দিয়ে কান চুলকোতে চুলকোতে আরামে ঘুম চলে এসেছে। এমন সময় খেয়াল করলুম ডানদিকের রো থেকে একটি মেয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
গলাখাঁকারি দিল অঙ্কুর।
-সৌভিকদা, একটা বিড়ি দেবে গো?
-উঁঃ, যেন কোবতে করছে শালা! সামনেই তো পড়ে আছে, নিয়ে খাও না।
গোগোল আর সৃঞ্জয় অবাক হয়ে দেখলো, খিটখিটে খুড়োর আজ কোনও হেলদোল নাই। দু চোখের দৃষ্টি দর্জির ফোঁড়ের ছুঁচের মতো গাছপালা ভেদ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
-সেদিন ফাগুন মাস /তোমার ইয়ে…তারপর কি যেন রে গুগলি?
-খুড়ো, এক মাস পিছিয়ে পড়েছ, ওটা চৈত্র হবে। তারপর সর্বনাশ টাশের একটা কি যেন কেস আছে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক। তুই পোড়খাওয়া লোক, ভালো বুঝিস।হায়, আমি তখন কমসিন কলি …
-কিঃ! কলি?
-আরে ওই হলো। কমশাণ কলা…একই ব্যাপার। শোন। বুকের ভেতর অ্যাইসা লাভডুব শুরু হলো রে। সবে তখন জামার হাতা টাইট হয়েছে। কাঁধের মাসল টাসল ফুলে উঠছে গদ্দানের দিকে। মেয়েটা টাঁই করে চোখ টিপে দিল।
-বলো কি! এ তো, প্রেম নয় গো।
-হুঁঃ, সব বুঝজান্তা ভাব দেখাসনি তো। ইয়ে না হলে কোনও মেয়ে চোখ মারে?
-আরে, বুঝতে পারছ না…
-চোপ হারামজাদা, বিয়াল্লিশ বছর আগে তুই ছিলি, না আমি ছিলুম?
-তুমি…
-তবে শোন।
ক্লাশ শেষ হলো। কৃষ্ণচূড়ায় লাল। হাওয়া নরম গরম। শ্যাম্পু করা চুল খুলে সে এলো। অলিভ সবুজ চুড়িদার। আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,”আমার বেণী বেঁধে দেবে গো? “
তোরা তো জানিস তখন ইলেকট্রিসিটি ছিল না আমাদের। বাড়িগুলোও ছোট ছোট। কমললতার টিপের মত দেখতে চাঁদ উঠেছে। আমি মেঝেতে শুয়ে শুয়ে ফিসফিস করে বলছি, …বলেই চলেছি, “আমার বেণী বেঁধে দেবে গো? “শেষরাত্তিরের দিকে মাথা অসহ্য গরম হয়ে গেল। দু তিন হাজার পুশ আপ, পুল আপস্ মেরে বাকি রাতটা কাটিয়ে দিলুম। সক্কাল ছটায় হুড়হুড় করে ঠাণ্ডা জলে স্নান সেরে নিলুম।
মা বললো, “হ্যাঁ রে, এই সাতসকালে স্নান কচ্চিস কেন? “আমি গম্ভীর মুখে জবাব দিলুম, “কলেজে লেট হয়ে যাবে। পড়াশোনায় ভারি ক্ষতি হচ্ছে। “
মায়ের তখনও রান্নার বিস্তর দেরি। আমি না খেয়েই কলেজ চলে গেলুম। সাতটা দশে কলেজের গেটে পৌঁছে দেখি মর্নিং সেসন চলছে। তখন এত গেট, গেটওয়ানের বালাই ছিল না। সটান ভিতরে ঢুকে কৃষ্ণচূড়ার নীচে বসলুম। চাট্টি ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট চিবুতে চিবুতে চাদ্দিক দেখছি। তিনতলার ছাদের ওপর বোধহয় বেহারদেশের দারোয়ানের বউ গুলের উনুন ধরিয়েছে। গলগল করে সাদা ধোঁয়া ছড়িয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার পাতায়, ফুলে। মর্নিং সেসনের ছেলেমেয়েরা ভারি অবাক হয়ে দেখছে আমায়। কোন একটা ঘর থেকে মাস্টারমশাইয়ের পড়ানোর শব্দ ভেসে আসছে,
এ ঘড়ি, ও রিস্টওয়াচ, সে দেয়ালঘড়ি বেয়ে এগারোটা বাজলো। পিলপিল করে ডে সেসনের ছেলেমেয়েরা ঢুকছে। আমার কেমন যেন ভয় করে উঠলো।
আজ যদি সে না আসে?
নামও তো জানা হয়নি তার। কাকে জিজ্ঞাসা করবো কি জানি। অবশ্য নাম জানা থাকলেও কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারতুম কিনা সন্দেহ।
সাড়ে এগারোটা নাগাদ তিনি এলেন। গাঢ় লাল শাড়ি পরে এসেছেন আজ। চারটি পাতলা কাচের চুড়ি। লাল পাথরের দুল। সটান কৃষ্ণচূড়ার নীচে, আমার পাশটিতে এসে বসলেন। আমার জলের বোতলটি থেকে এক ঢোক জল খেয়ে বললেন, “চলো তবে। “
আমি চমকে গেলাম। এ তো মেঘ না চাইতেই জল। তবুও আমতা আমতা করে বললুম, “কোথায় যাবো? “
–কোথায় আর ছাই জায়গা আছে এ পোড়া শহরে? চলো জলমন্দিরে বসে হরিণ টরিণ দেখি।
সৃঞ্জয় লাফিয়ে উঠলো,
-খুড়ো, বিয়াল্লিশ বছর আগে তো জলমন্দির ছিল না! গুল দিচ্ছ?
-আরে ওই হলো। জলমন্দির, কলতলা, শলাগৃহ, একই ব্যাপার। আর গুলই তো বাপ, গুল ছাড়া কি? মোহরের ব্যবস্থা যদি করতে পারিস, তবে গুলমোহর হয়ে ফুটবে।নয় তো ওই দারোয়ানের বউয়ের গুলের মতো পুড়ে ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাবে।
সৃঞ্জয় হোঁচট খেয়ে থেমে গেল। সৌভিক, গোগোলরা তো আগেই চুপ। এ খুড়ো তো তাদের সেই চেনা খুড়ো নয়।
খুড়ো বিড়ি ধরালো একটা।
-জলমন্দিরের জল ছুঁয়ে শ্বেতপাথরের ঘাটে। খোলা চুলের ফাঁক দিয়ে লাল কানের দুল দেখা যাচ্ছে তাঁর। চুপ করে বসে আছি আমরা। দু একটা জলপিপি উড়ে বেড়াচ্ছে জলের ওপর। হরিণছানার দল লোহার বেড়ার ওপাশ থেকে আমাদের দেখছে।
তিনি অনেক পরে আমার দিকে ঘুরে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর বললেন, “আমার বেণী বেঁধে দেবে গো? ”
আমি ভারি আশ্চর্য হলাম। এই নিয়ে কথাটা দুবার শুনলাম। এমন তো প্রেমের মহাফেজখানার কোনও পুঁথিপত্তরে শুনিনি কোনোদিনও। আমি একটু ইতস্তত করে বললুম, “আমি তো বেণী বাঁধতে পারিনা। “
-যেমন পারো, তেমনটিই দাও।
বলে, তিনি ঘুরে বসলেন। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে তাঁর চুলে হাত দিলাম। দুদিক থেকে দুটি চুলের গোছা টেনে একে অপরের কাছ আনতেই, মাথা থেকে পুরো চুলের গোছাটাই উঠে এলো!
আমি শ্যাম্পু করা একগাছা পরচুলা হাতে নিয়ে বসে রইলুম বজ্রাহতের মতো। তিনি আমার দিকে তাকালেন।তখনই খেয়াল করলুম ভ্রুদুটিও শুধু কাজলটানা। সেখানে চুলের লেশমাত্র নেই।
কানের লাল পাথরদুটি টলটল করছে তাঁর চোখের জলের মতই। আমার হাতদুটি ধরে ফেললেন তিনি। বুকটা ফুলে উঠলো। অবরুদ্ধ স্বরে বললেন, “আমার বেণী বেঁ…”
আমি চুলের গোছাটি তাঁর কোলের ওপর ফেলে দিয়ে চলে এলাম। একবারও ফিরে তাকাইনি। আর দেখিনি তাঁকে কোনোদিনও। কলেজে দেখিনি। পথে দেখিনি। হয়তো এ পৃথিবীতেই আর দেখিনি আর। কিন্তু, বিশ্বাস কর তোরা, রোজ খুঁজতুম তাঁকে। কৃষ্ণচূড়ার নীচে, কম্বাইন্ড ক্লাসে। এখনও কৃষ্ণচূড়া লাল সাজলে আমার দুটি লাল পাথরের দুলের কথা ভারি মনে পড়ে।”
আজ খুড়ো কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি চলে গেল। বাকিরাও চুপ।
শুধু অঙ্কুর কেন যেন সত্তর টাকা দিয়ে কেনা লাল গোলাপটা ফেলে দিয়ে গম্ভীর মুখে আরেকটা বিড়ি ধরালো।