পাগল কথাটি রূপক অর্থে প্রায়শ ব্যবহার হয়, যেমন খেলার পাগল, গানের পাগল। প্রেমে পাগল প্রভৃতি I বিয়ে পাগলা কথাটাও অশ্রুত নয় মতে, যতদূর মনে পড়ে, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ নামে একটাপ্রহসনও ছিল।অনেকসময় একটু বেশী পুঁথিঘেঁষা বা একাডেমিক মানুষদেরও শ্রদ্ধামিশ্রিত তাচ্ছিল্যে ‘পাগল ‘ অভিধা দেয়া হয় I কেউ কেউ আবার উদ্ভট খেয়ালি বা একসেন্ট্রিক থাকেন -তাদেরও সহকর্মী বা পরিবার পরিজন ‘পাগল ‘ মার্কা একটা ছাপ দিয়ে রাখে I কিন্তু স্মৃতির সরণীতে আমার আলোচ্য তাঁরা কেউ নন , এমনকি বদ্ধ উন্মাদ বলে যারা পরিচিত , তারাও নন I আমি যাদের কথা বলতে চাই, যারা একটু খানদানি প্রকৃতির , আগে প্রতি পাড়ায় বা অঞ্চলে এদের দেখা মিলতো I এরা মোটেই হিংস্র নন , বরং পাড়ার সকলের স্নেহ বা ক্ষেত্রবিশেষে সম্ভ্রম আদায় করে থাকতেন I এদের সম্বন্ধে অনেক গল্প চালু হয়, হয়তো বা মিথ ও I এরকম প্রথম যে পাগলের সঙ্গে আমার আলাপ , তার নাম বিজয় I উল্লেখ্য , পাগলদের নাম কিন্তু বেশ সহজ সরলই হয় I আমি নিশ্চিত, পাঠক পাঠিকারা সরিৎসেখর বা চন্দ্রভাস অথবা কৌস্তভ এমন নামে কোনো পাগলের সঙ্গে পরিচিত হন নি কখনো ! বিজয় পাগলের গল্প শুনি বাবার কাছে I তাঁর চাকরি জীবনের প্রথম দিকে ( পঞ্চাশ দশকে ) বাবা ওভারসিয়ার হিসেবে ত্রিপুরার কোনো প্রত্যন্ত মফস্সলে পোস্টেড্ I ব্লক বা পি ডব্লুডি তে বাহন ছিল সবেধন নীলমনি একটি জীপ্ – খুব দুর্গম কোথাও গেলে সওয়া্রী হতে হতো হাতির পিঠে I বিজয় পাগলের আস্তানা ছিল অফিসের কাছে -সারাদিন আপনমনে বকবক করতো আর সাহেব সুবোদের ফাই ফরমাস খাটতো I কোনো এক বিকেলে বোধকরি বাবা ‘তার’ পেলেন – মহকুমা শহরে মিটিং পরের দিন – হাজিরা দিতেই হবে I কোনো কারণে হয়তো আবহাওয়া খারাপ হবার জন্যই – রা সবাই ছুটি নিয়ে চলে গেছে বাড়ি I জীপবাবাজিও অন্য কোনো অফিসারের দখলে , ফিলড ডিউটিতে – সেদিন ফেরার কোনো আশু সম্ভাবনা নেই- সুতরাং এগারো নম্বরি ভরসা -অর্থাৎ পদব্রজে I অফিস ফাইল নাহয় কোনো ব্যাগ বা ব্রিফকেসে নেয়া গেলো, কিন্তু তল্পিতল্পা ? রাত কাটাতে হবে তো হোটেলে ! বাবা শরণাপন্ন হলেন বিজয় পাগলের I অনেক ভুজুং ভাজুং দেবার পরে সে রাজী হলো তল্পি বাহক হতে I ( অনুমান করছি, সুটকেস নয় , তখন ‘হোল্ড-অল ‘ বলে চামড়ার একটি বস্তু ব্যবহারের চল ছিল- বিছানা পত্র ও জামাকাপড় বোধহয় সেটাতে বাঁধা ছিল I )সেই আমলে মফস্বলের হোটেলে বোধকরি বাঁশের মাচা দিয়ে খাটের কাঠামো করা থাকতো, আর সঙ্গে থাকতো কুটকুটে কম্বল I ঢাকা কলকাতায় নাগরিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা বাবার পক্ষে হোল্ড-অল সঙ্গে রাখাই স্বাভাবিক। যাই হোক, লম্বা দূরত্বের সেই রাস্তায় বিজয়ের হরেক রকম বাণী শুনতে শুনতে বাবার পথচলা I কিন্তু অর্ধেকের বেশী অতিক্রম করে, গোমতী নদীর ধারে এসেই বিজয় বেঁকে বসলো -সে আর যাবে না !বুঝুন অবস্থা ! তারপর নাকি অনেক পরে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে রাজি করিয়ে বাবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন -বাঁচলো ওঁর চাকরিও ! এই বিজয়কে আমি চাক্ষুস দেখি বোধয় ৭২ কি ৭৩ সালে I আমি তখন টু -থ্রি তে পড়ি I বিজয়ের বয়স বেড়েছে , কিছুটা গাম্ভীর্যও – তবে মুখের উপর কাগজের চোঙা বানিয়ে সে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ও পূর্ব এশিয়ায় মুক্তি সূর্য ইন্দিরা গান্ধী বা বঙ্গবন্ধুর সম্বন্ধে অনেক কিছু বলতো I ততদিনে তার আস্তানাও বদল হয়েছে – ব্লক পি ডব্লুডির ইট কাঠ পীচের পরিবেশ ছেড়ে গার্লস হয় স্কুলের দিদিমণিদের সঙ্গে তখন তার আবদার ও আনুগত্য I মাঝে মাঝে অবশ্য অভিমান করে বলতো , ” হাই স্কুলের দিদিমনিরা রোজ রসগোল্লা খায়, আমারে ন’ দেয় “! বিজয় এবং এই গোত্রীয় পাগলদের ইংরেজী ভাষার প্রতি একটু দুর্বলতা থাকে – কেন কে জানে ! অনেক সময় তাদের ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে অনেকরকম মিথ ও তৈরী হয় -হয়তো ভাষাটির প্রতি বাঙালীর ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধার কারণেই I বিজয়পর্ব শেষ করে চলে আসি শঙ্করের কথায়। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ আমার জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে, অর্থাৎ কলকাতায়। শঙ্কর দক্ষিণ কলকাতার দক্ষিণপ্রান্তে – তার পাগলামি বোধয় খানিটা মরসুমি, সিজনাল I এমনিতে সে বাজারে দোকানদারদের চা বিস্কুট দেয় , গল্প গুজব করে I তবে তাকে পাগলামিতে পেলে সে গান গায়ে, নৃত্য করে , আর তার সঙ্গে অন্য সব খানদানিপাগলের মতো, ইংরেজিতে কথাও বলে দু’ চারটি ! পাগলদের অনেক সময় পন্ডিত বলেও খ্যাতি হয় -অর্থাৎ খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল -বেশী পড়ে মাথা বিগড়ে গেছে ! দুজন পন্ডিতপ্রায় পাগলের সঙ্গে অবশ্য আমার মোলাকাত হয়েছে I প্রথমটির স্থান ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরী -আমি থার্ড ইয়ারের ছাত্র I লাইব্রেরিতে বসে বই বাছাই করছিলাম অথবা পড়ছিলাম – উস্কোখুস্কো চুল ও অবিন্যস্ত পোশাকে আমার পাশে বসে লোকটি আঁক কাটছিলো কিছু ছবি ও সিম্বল – আমার মনে হয়েছিল অর্থহীন I প্রশ্ন করায় ‘বায়োলজিক্যাল ম্যাথমেটিক্স ‘বা এইধরণের কোনো গূঢ় বিষয়ে গবেষণার কথা জানিয়েছিল সে I কলেজে পরদিন একটু ফলাও করে গল্পটি করতেই আমার এক সুরসিকা সহপাঠিনী টিপ্পনি কেটে ছিল, ” ওই লোকটিও বাড়ি গিয়ে নিশ্চই বলেছে, এক পাগলের দেখা পেলাম বি সি এলে !” বেশ কবছর পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের প্রকৃতই এক একসেন্ট্রিক বন্ধু যখন বলেছিলো, চিড়িয়ার মোড়ে ট্রাফিক সিগনালের সামনে এক পাগল ওকে জড়িয়ে ধরে কিছতেই রাস্তা পার হতে দেয় না – তখন রতনের পারস্পরিক নৈকট্যের তুলনা দিয়ে আমিও অনুরূপ মন্তব্য করেছিলাম , তার প্রেক্ষাপটে হয়তো সেই সহপাঠিনীর খোঁচাটাই থেকে থাকবে I দ্বিতীয় ঘটনাটিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় – আমি তখন প্রাইভেট টিউশন করি I আমার ছাত্রীর বাড়িতে এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসে হাজির- কোনও এক সংস্থার বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন । ছাত্রীর মা তাকে কেন ড্রইংরুমে বসতে দিয়েছিলেন জানি না I জ্ঞানগর্ভ অনেক কথাই বলছিলেন উনি -যদিও অসংলগ্ন I ওঁর মুখেই ‘curicullum vitae’ কথাটি শুনি -এর আগে আমার দৌড় ছিল ‘বায়ো ডাটা ‘ অব্দি ! এর পরেও কিছু পাগলকে দেখেছি , কখনো ছিন্নবস্ত্রে, কখনো কিছুটা পরিপাটি অবস্থায় – তবে মোটামুটি সবাই ইংরেজি কথন অথবা গলা ছেড়ে গানে বিশ্বাসী -কেন কে জানে ! আরেকটি বিষয় হলো , পাগলদের নিয়ে যেমন একটা রোমান্টিসিজম আছে -পাগলীদের নিয়ে কিন্তু নেই I পাগলীদের ছাঁচে ফেলা (Stereotype ) ইমেজ হলো, অপরিষ্কার,বিড় বিড় বকা একটি নারী , মাথায় যার উকুনের বাস বা সহবাস I এটা আমার সাধারণ পর্যবেক্ষণ – এর সমর্থনে কোনো পরিসখ্যান দিতে পারবো না I আশা করি কেউ আমার বিরুদ্ধে ‘লিঙ্গ একদর্শীতা ‘ বা ‘জেন্ডার বায়াসের ‘ অভিযোগ আনবেন না I যাই হোক, আমাদের পাড়ায় বহুদিন ধরে এক পাগলী যাতায়াত করে I খুব বাঙময়ী সে নয় -তার মুখে একটিই বুলি শোনা যায়- বাড়ি যা, বাড়ি যা ! দার্শনিকতা আরোপ করতে চাইলে হয়তো এখানে বলা যায় – আমরা তো সবাই সেই পাড়িই দেই- কোনও এক অজানা বাড়ির দিকে !