গর্ভধারিনীর অধিকার
সলিল চক্রবর্ত্তী
(১)
অপর্ণা বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়িতে এসেই বাইরের পোশাক না ছেড়ে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আলাপন কিছুক্ষন স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে এই মুহুর্তে কি করণীয় বুঝতে না পেরে অপর্ণার মাথায় বার দুয়েক হাত বুলিয়ে বাবা মা’র ঘরের দিকে চলে গেল।
**********
দাদাবাবুরা খাওয়া দাওয়া করে বা’র হবেন বলে সুজাতা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের কাজ সারছিল। হঠাৎই এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় সেও হতচকিত। বছর পাঁচেক তো বটেই, আলাপন দাদাবাবুর বিয়ের পরপরই এই বাড়িতে পরিচারিকার কাজে ঢুকেছে। তখন সে-ও অবিবাহিত, বছর খানিক পর পাশের পাড়ায় তার বিয়ে হওয়ায় এ বাড়িতে পরিচারিকার কাজটা আর ছাড়তে হয়নি। অনেক দিন এক জায়গায় কাজ করতে করতে অজান্তেই পরিবারের মানুষ গুলোর উপর কেমন যেন একটা দায়বদ্ধতা জন্মে গেছে। ইচ্ছে করছে বৌদিমনির কাছে কি ব্যাপার জানার, কিন্তু অনধিকার চর্চার কথা ভেবে নিজের কাজে মন দিল।
**********
পরাশর মুখোপাধ্যায় লিভিং রুমে বসে ‘মুখার্জি কনস্ট্রাকশনের’ বাড়িতে আনা ফাইলগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। এমন সময় আলাপন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মতো নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে বাবার পাশে শোফায় এসে বসল। পরাশরবাবু মাথা তুলে ছেলের দিকে চেয়ে বললেন-” কি বললেন ডক্টর হোড়?” আলাপন চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকল, কি বলবে বুঝতে পারছে না। এমন একটা নির্মম সত্য কথা তারও যে বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। আলাপনের মা তৃপ্তিদেবী স্বামীর পোশাক রেডি করতে করতে এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন-” কিরে খোকা চুপ করে আছিস যে বড়, কি বললেন ডাক্তার বাবু?” আলাপন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অসহায় ভাবে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন-” অপর্ণা কখনো ‘মা’ হতে পারবে না।” তৃপ্তিদেবি চমকে ওঠেন, হাত থেকে পরাশর মুখার্জির কোটপ্যান্ট পড়ে যায়। উচ্চস্বরে বলে ওঠেন-” তার মানে!!” আলাপন মাকে না বলা কথাগুলো সব বলে দিল— “হ্যাঁ মা, ওর ইউটেরাসে অনেক গুলো ছোটো ছোটো সিস্ট ধরা পড়েছিল কানাডাতে থাকতে। এছাড়াও ইউটেরাসের মুখ প্রায় বন্ধ করে রেখেছিল বেশ বড়সড় একটা টিউমার। তোমরা চিন্তা করবে বলে আমি সেই সময় তোমাদের সমস্ত ঘটনাটা জানাই নি। কয়েকজন বন্ধুদের সহযোগিতায় কানাডার বেশ কয়েকজন গায়নোকোলজিস্ট,এবং সার্জেন্টের সাথে পরামর্শ করেছিলাম। মোটামুটি সবাই একমত পোষন করেছিলেন যে অপারেশন করে টিউমার বাদ দিতে হবে। তখন এমন সিচুয়েশনে না পারছি তোমাদের জানাতে, না পারছি অপারেশন করাতে। কানাডাতে চিকিৎসা খরচও প্রচুর, প্রয়োজনের বাইরে টাকা চাইলে তোমাদের সন্দহ হবে। বাবা সবটাই জানে, ফিরে এসে বাবাকে সব বলেছিলাম। তুমি দুশ্চিন্তা করবে বলে তোমাকে কিছু জানাইনি। এমনকি অপর্ণার কাছেও সবকিছু ক্লিয়ার করিনি।” এই পর্যন্ত শুনে তৃপ্তিদেবি আবাক হয়ে বললেন-” তা-না হয় হল,কিন্তু এখানে তো অপারেশন করালি, শুনলাম অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। তাহলে এখন কি হল!!” আলাপন মাথায় হাতদিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল তারপর আস্তে আস্তে নিচু স্বরে বলল-” এখানেও তোমাদের কাছে আমি অনেক কিছু গোপন করে গেছি। আমার উপায়ও ছিলনা। ডক্টর বিপ্লব কুমার হোড়ের নির্দেশ মত শুধু তোমাদেরই নয়,অপর্ণাকেও সব জানাইনি। যাইহোক ওটি করতে গিয়ে হল আর এক সমস্যা। ডক্টর হোড় বললেন ওভারিটা বাদ না দিলে মারাত্মক রিস্ক থেকে যাবে। ক্যান্সারের সম্ভাবনা প্রবল,ফলে জীবন নিয়ে টানাটানি। অপারেশন টেবিলে এমন একটা পরিস্থিতিতে আমি সাত পাঁচ ভাবনার সময় পাইনি। শুধু এটুকু ভেবেছি আগে অপর্ণার জীবন, তারপর অন্যকিছু। অপারেশন হয়ে যাওয়ার পরও আমি কাউকে কিছু বলিনি। কথাটা আমি অপর্ণাকে এই মুহূর্তে একদমই বলতে চাইনি। কিন্তু ও নিজে তৎপর হয়ে ডক্টরের থেকে——” তৃপ্তিদেবি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন-” অপর্ণা কোথায়?”
—– ওর ঘরে, কান্নাকাটি করছে।
তৃপ্তিদেবী আলাপনের ঘরের দিকে দ্রুত গতিতে চলে গেলেন। পরাশর বাবু আলাপনের পিঠে হাত রেখে বললেন-” আজকের দিনে, অর্থাৎ উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগে এতটা ভেঙে পড়ার মতো কিছু হয়নি। সমস্যা যেমন আছে তার সমাধানও নিশ্চই আছে। আমার ক্লাসমেট ডক্টর আর কে লাহিড়ী, ও তো নাম করা গায়নোকোলজিস্ট। ইংল্যান্ড থেকে খুব শীঘ্রই দেশে ফিরছে। তুমি চিন্তা করো না, আমি ডক্টর লাহিড়ীর সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করব। তিনি নিশ্চই কোনো একটা পথ বলে দেবেন।”
মুখার্জি কনস্ট্রাকশনের কর্ণধার পরাশর মুখার্জির একমাত্র পুত্র আলাপন মুখার্জি, কানাডা থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে সম্প্রতি দেশে ফিরেছে। এবং বাবার প্রতিষ্ঠানে ব্রিজ ইনস্টলেশন ডিপার্টমেন্ট দায়িত্বে আছেন। পুত্র বধু অপর্ণাও মুখার্জি কনস্ট্রাকশনের উঁচু পদে কর্মরতা। মেকানিক্যাল লাইফ, বেলা আটটায় ঘুম থেকে উঠে চলে রুটিন মাফিক কাজ, সারাদিন বিশ্রামহীন কর্ম শেষে বিছানায় যেতে যেতেই রাত একটা বেজে যায়। কর্মের মধ্য দিয়ে চলছিল এক হাই প্রফাইল ব্যস্ততম জীবণ। এদিকে সাদামাটা গৃহকর্তী তৃপ্তিদেবী অধৈর্য হয়ে উঠলেন। পুত্রবধূর কাছে ঘর আলো করে একটা উত্তরসূরী চাইলেন। শুভষ্য শিঘ্রম, মানুষের মতো মানুষ করতে হবে তো। অপর্ণা যতই আধুনিকা হোক না কেন আসলে তো সে নারী, মায়ের জাত। শাশুড়ির এমনতর আবদারে আনন্দে, লজ্জায় লাল হয়ে যৎপরনাস্তি পুলকিত হয়ে ছিলেন। কিন্তু ভগবান যে সেই হাসি এমন ভাবে ছিনিয়ে নেবেন তা অপর্ণা কল্পনাও করতে পারেনি।
**********
— সুজাতা, রাত এগারোটা বেজে গেছে, তোমার কাজ সারা হল? আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
—- আমার কাজ হয়ে গেছে, এক মিনিট আসছি, তোমার সাথে একটা কথা আছে, ঘুমিওনা যেন।
রমেশ টিভিতে ঢুলুঢুলু চোখে আজকের টক শো দেখতে থাকল। দশটা পাঁচটা ডিউটি, তারপর ওভার টাইম। হাড় ভাঙা খাটুনি,শরীরে শক্তি বলে আর কিছু থাকেনা। রাতে খেয়ে বিছানায় যেতে পারলে শান্তি। রাতে খাওয়ার সময় সুজাতা বলে রেখেছে সে যেন না ঘুমায়।
মুখে বোরোলিন ঘষতে ঘষতে সুজাতা বিছানার কাছে এসে বলল-” রাজনীতির কচকচানি কি যে ছাইপাশ দেখ,ওখানে কে যে ভাল, আজ পর্যন্ত আমি বুঝলাম না। রমেশ ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলল-” সেই জন্যেই তো দেখছি, যুক্তিহীন কথাবার্তা শুনে মাথা বিগড়ে গেলে ঘুম আর আসবে না।” টিভির সুইচ অফ করে বিছানায় উঠে সুজাতা বলল-” আমাদের বিয়ে হয়েছে কত বছর হল তোমার খেয়াল আছে?”
— এই কথা বলার জন্যে তুমি আমাকে এতক্ষণ জাগিয়ে রেখেছ!! যদি-ও সামনে বিবাহ বার্ষিকী তবুও বলছি অনুষ্ঠান করাটা আমাদের কাছে বিলাসিতা।
— আমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে অন্যকে নাক গলাতে দাও কেন?
—- আমার মা যদি আমাদের ঘর আলো করে একটা ফুটফুটে সন্তান আনার কথা বলে, তখন কি আমি কি বলব, ‘আমাদের ব্যাপারে তুমি নাক গলাতে এসোনা।
— হঠাৎ করে নয়,মুখার্জি বাড়ির একটা দুঃখজনক ঘটনা থেকে আমার কথাটা মনে হল। ওদের বাড়ির পরিবেশ পরিস্থতি এবং কথাবার্তায় যা মনে হল, বৌদিমনির কোনো শারীরিক প্রবলেম আছে,যার জন্যে বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছেনা। কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে ফিরে বৌদিমনির কি যেন একটা অপারেশন হল। তারপর ঘনঘন ডাক্তার দেখাতে যায়। আজ ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফিরে একেবারে কান্নাকাটি অবস্থা।
— আসলে সমস্যাটা কার? — মনে হচ্ছে বৌদিমনির। ওদের বাড়ির পরিবেশটা এক নিমেষে কেমন বদলে গেছে। আমার কি-যে খারাপ লাগছিল! অত বড়ো ব্যবসায়ী পরিবার বংশধর না এলে ওদের অবর্তমানে কি হবে ওই সব সম্পত্তি!! একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে রমেশ বলল-” তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদেরও তো এতোদিনে—-। — সেই জন্যে তো বলছি, আমাদেরও ডাক্তার দেখানো উচিত। — ঠিক আছে, অনেক রাত হয়েছে, ঘুম পাচ্ছে পরে সমস্যাটা নিয়ে ভাবা যাবে।
(২)
অপর্ণার চিকিৎসার জাবতীয় পেপার্স গুলো নিয়ে পরাশর মুখার্জি ও আলাপন মুখার্জি এলেন লেকগার্ডেন্সে ডক্টর লাহিড়ীর বাড়িতে। ঘরোয়া পরিবেশে ডক্টর লাহিড়ী, আলাপন ও পরাশর মুখার্জির সাথে আলোচনার মাধ্যমে হাতে পাওয়া এযাবৎকালের সমস্ত পরীক্ষা নীরিক্ষার, অপারেশনের ভিডিও, কানাডার বিশেষজ্ঞ ডক্টরদের পেপার্স গুলো নীরিক্ষন করে বললেন-” ডক্টর বি কে হোড় টেস্টগুলো সব ঠিকঠাকই করিয়েছেন। অপারেশনের প্রয়োজনও ছিল, এবং সেটা ইমিডিয়েট করিয়ে ভালই করেছেন। প্রবলেম তো মেজর,উনি ঠিক কি কি বলেছেন?” আলাপন ঢোক গিলে উত্তর দিলো—” কোনো ভাবেই গর্ভধারণ সম্ভব নয়। —- আর কিছু বলেন নি? — না,হয়ত অপর্ণার সামনে বলতে চাননি, কারন অপর্ণা ততক্ষণে ভেঙে পড়েছে। আমারও মাথাও কাজ করছিল না।
পরাশর মুখার্জি এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন,ডক্টর লাহিড়ীর মুখে ‘আর কিছু’ কথাটা শুনে উদগ্রীব হয়ে বললেন— “তুমি কি অন্য কিছু—-“
ডক্টর লাহিড়ী একটু চিন্তিত ভাবেই বললেন— অপর্ণার ওভাম টেস্টের রিপোর্ট ও নট গুড। যদিও সেটার ভ্যালু, ইন দা মিন টাইম জিরো।”
ডক্টর লাহিড়ীর কথা শুনে আলাপনের মুখ থেকে আর কথা সরছে না।
পরাশর মুখার্জি ফ্যাকাসে মুখ করে বলেলন—“অনেক আশা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি ব্রাদার, একটা পথ বল, মনটাকে শান্ত করি।”
ডক্টর লাহিড়ী কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন— “অনাথ আশ্রম থেকে একটা পুত্র সন্তান দত্তক নেওয়া যেতে পারে।”
পরাশর মুখার্জি, ডক্টর লাহিড়ীর কথা শেষ হওয়ার আগেই না সূচক মাথা নেড়ে বললেন—” না না, সেটা সম্ভব নয়, তাতে ব্লাড রিলেশন থাকেনা। ভিন্ন রক্তের সম্পর্ক, কেমন হবে জানব না শেষে আমার তিল তিল করে গড়া ব্যবসা—-“
ডক্টর লাহিড়ী ইতিবাচক মাথা নেড়ে বললেন- ” ভেরি গুড, সো ব্লাড রিলেশনে কাউকে দত্তক নিতে পার!”
—( কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে) না ব্রাদার, তাও সম্ভব নয়, বর্তমানে প্রতিটা ফ্যামিলিতে একটা করে সন্তান, চাইলে তারাই-বা দেবে কেন?
ডক্টর লাহিড়ী অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে নিরবতা ভঙ্গ করে বলেলন—” আর একটা পথ আছে, তবে সেটা যেমন সমস্যা বহুল,ঠিক ততটাই ব্যয়বহুল। “
পরাশর মুখার্জি ও আলাপনের মুখোমণ্ডল চকচক করে উঠল। পরাশর মুখার্জি উত্তেজিক হয়ে বললেন—“টাকা যত লাগে লাগুক, তুমি ব্রাদার আমাকে উপায়টা বল।” ডক্টর লাহিড়ী ওনাদের ভরসা দিয়ে বললেন ‘সারোগেসি’ মেথড। পরাশর মুখার্জি যতটা উৎসাহিত হয়েছিলেন ঠিক ততটাই নিরাস হয়ে বললেন— “সা-রো-গে-সি মে-থ-ড!!” আলাপন মুখোপাধ্যায় চুপচাপ দুজনের কথাবার্তা শুনছে। ডক্টর লাহিড়ী উৎসাহ যুগিয়ে বললেন-” অত নিরাশ হচ্ছ কেন? বর্তমানে এই পদ্ধতি বহুল প্রচলিত ও প্রশংসিত। অনেক চেষ্টাচরিত্রের পরও যখন সন্তান লাভের আর কোনো পথ থাকে না তখন এই একটি পথ-ই খোলা থাকে। আলাপন মুখোপাধ্যায় যেন একটু ভরসা পেয়ে বললেন-” এখনতো অনেক সেলিব্রিটির কোনো শারীরিক প্রবলেম না থাকলে-ও সারোগেসি পদ্ধতির উপর নির্ভর করছেন।” আলাপনের পজিটিভ ইঙ্গিত পেয়ে ডক্টর লাহিড়ী বললেন-” অফকোর্স, কোনো দম্পতির উভয়ত কিছু না কিছু প্রবলেম থাকতেই পারে, যেমন— এক, অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও বারবার মিসক্যারেজ হওয়া। দুই, এমন কোনো রোগ যা গর্ভধারণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন, গর্ভধারণ করলে শারীরিক জটিলতা সহ যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকি রয়েছে। চার, আই ভি এফ চিকিৎসায় গর্ভধারণ হচ্ছেনা। পাঁচ, অকাল মেনোপজ। ছয়, জরায়ুতে অস্বাভাবিকতা বা অস্ত্রপচারের কারনে বাদ যাওয়া। সর্বোপরি অলাপন যে কথাটি বলল, সাম্প্রতিক কালে অনেক সেলিব্রিটি ফ্যাটি হওয়ার ভয়ে সারোগেসির উপর নির্ভর করে থাকেন। মোদ্দা কথা হল, যখন কোনো নারী গর্ভধারণকালীন বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে চাননা এবং গর্ভধারণকালীন বিভিন্ন কষ্ট ও যন্ত্রণা নিতে আগ্রহীহন না তখন সারোগেট মায়ের মাধ্যমে এবং সারোগেসি পদ্ধতি অবলম্বন করে মা হওয়ার চেষ্টা করেন। সারোগেসি চিকিৎসা পদ্ধতির ফলে অনেক নিঃসন্তান দম্পতি নিজেদের সন্তান পাওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে পারছে।” পরাশর মুখার্জি সব শুনেও বলে ফেললেন-” অন্য মহিলার জঠরে বেড়ে ওঠা ভূমিষ্ঠ সন্তানের উপর মা বাবার কি সেই অপত্যস্নেহ থাকবে?” ডক্টর লাহিড়ী হেঁসে বললেন- ” এ তুমি কেমন কথা বলছ মুখার্জি! রক্ত যে কথা বলে। স্প্যাম তো তোমারি বংশের। ” এবার পরাশর মুখার্জি আস্বস্ত হয়ে বললেন— ” দেখো তুমি যা ভালো বোঝো।”
— না না মুখার্জি, আমি ভাল বুঝলে হবে না। তোমরা দু’জন জানলে,শুনলে,বাড়িতে গিয়ে একসাথে বসে আলোচনার মাধ্যমে সহমত পোষণ করো। তারপর আমি আর তুমি বসব। স্টেপ বাই স্টেপ আমাদের এগুতে হবে। প্রথম পর্যায়ে, তোমাদের সবাইকে একমত হতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে, সবদিক থেকে যতটা সম্ভব উপযুক্ত মহিলা খুঁজতে হবে। তৃতীয় পর্যায়ে, উক্ত মহিলার সাথে লিগাল ল্য মেনে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। সর্বশেষ উপযুক্ত চিকিৎসা বিজ্ঞান পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এখানে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, প্রেগন্যান্সি অবস্থায় আপন জনের মতো সারোগেট মাদারের দিকেও সুতীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। It is a long time and expensive method.
— সবতো বুঝলাম, তুমি কি এখন ইন্ডিয়াতে থাকবে?
—আপাতত, তবে চিন্তা কোরো না, তোমাদের পাশে আছি। আর একটা কথা, তোমরা আলোচনা করে যদি সারোগেসি পদ্ধতিতে সহমত পোষণ করো তবে সারগেট মাদার খুঁজতে একটু যত্নশীল হতে হবে।
আলাপন একটু আবাক হয়ে বলল–” কথাটা ঠিক বুঝলাম না।”
— যদিও কথাগুলো মেডিকেল সাইন্সে ডক্টরদের জানলেই চলে, তোমাদের জানার দরকার পড়ে না। তবুও তোমাদের বেস্ট রেজাল্ট পাওয়ার জন্য বলা। দেখ সাধারনত সন্তান মাতৃ গর্ভে বাড়তে থাকে, ছয় মাস অতিক্রান্ত হলে ভ্রূণের একটা নিজস্বতা আসে, সে নড়াচড়াও করতে পারে। ঠিক তখনই জীন বৈশিষ্ট্য ছাড়াও ভ্রুণ অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে শেখে বাই মাদার। আমরা তখন মায়ের দিকে ম্যাক্সিমাম নজর দিয়ে থাকি। শরীর এবং মনের দিক থেকে মা যেন স্বয়ং সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ থাকে। যেমন- ভাল বই পড়বে, ভাল গান শুনবে, কবিতা আবৃত্তি করবে, মোদ্দা কথা হাসিখুশিতে সময় কাটাবে। শুধু মা নয় গৃহ পরিবেশও ছান্দিক করে তুলতে হবে।
পরাশর মুখার্জি একটু হেঁসে বললেন- “আমার স্ত্রী এ ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।”
— সেটা আমিও জানি, তবে আমার বলার কারণ, অপর্ণা তো আর প্রেগন্যান্ট হচ্ছেনা, হচ্ছে সারগেট মাদার। সো এমন খুঁজতে হবে, সারগেট মা হবে বাঙালি, স্ট্যান্ডার্ড শারীরিক গঠন, দাম্পত্য লাইফ বিলং করছে, একই ক্লাইমেটে বসবাস করছে, কিছুটা বিদ্যাবুদ্ধিও আবশ্যিক। অর্থাৎ ঘরানাটা এক হতে হবে।
— তুমি যা বলছ, তেমন পাব কোথায়?
— খুঁজতে হবে, এজেন্সি আছে, ব্রোকাররা সব অ্যারেঞ্জ করে দেবে, কিন্তু শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে সারোগেট মাদার অ্যারেঞ্জ করার থেকে টাকা নিলেও অন্তরের টানে মা হলে দ্যাটস বেটার।
— ও কে, এখন উঠি, যত শীঘ্র সম্ভব তোমাকে জানাচ্ছি।
(৩)
আজ রবিবার, সকলে বাড়িতে থাকায় পরাশর মুখার্জি পরিবারের তিনজনকে নিয়ে সৃষ্টি হওয়া সমস্যার একটা সমাধানের আশায় আলোচনায় বসলেন। আলাপনের সাথে বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতেই আলোচনা করে নিয়েছেন, বাকি অপর্ণা এবং তৃপ্তিদেবী। পরাশর মুখার্জি সমস্ত সমস্যাটা উত্থাপন করে ডক্টর লাহিড়ীর সাজেশন পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করলেন—“ডক্টর বি কে হোড়ের ট্রিটমেন্ট ইজ ওকে, বাট ফরচুনেটলী আমরা যখন ফরেন ডিগ্রিধারী ডক্টর লাহিড়ীকে পেয়েছি, তখন তাঁকে হাতছাড়া করা মানে সুযোগের সদ্ব্যবহার না করা। সবচেয়ে বড় কথা তিনি কেসটা যখন এক্সেপ্ট করবেন বলেছেন।”
অপর্ণা বুদ্ধিমতী, শিক্ষিতা, তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এবং সমাধানের জন্যে ডাক্তারের সাজেশন গ্রহণযোগ্য মনে হলেও তৃপ্তিদেবির কাছে ব্যাপারটা একদম গ্রহনযোগ্য মনে হল না। তিনি মাথায় হাতদিয়ে লম্বা জিব কেটে বললেন -” কি অলুক্ষণে কথা, আমার বংশধর অন্যের গর্ভে বড়ো হবে!! সে তো তাহলে সেই মহিলার সন্তান হয়ে গেল।”
পরাশর মুখার্জি বললেন-” তুমি ওভাবে ভাবছ কেন? কোনো মায়ের সমস্যার কারনে যদি পয়সার বিনিময়ে স্তন দায়িনী মা ভাড়া করা হয়,তবে সে কি মা হয়ে যায়!”
— স্তন পান,আর জঠরে বড় হওয়া, এক কথা হল। বুঝি না বাপু আধুনিক যুগের ব্যাপার স্যাপার! আর তোমাদের মন মানসিকতা!”
— এই ছাড়া আমাদের হাতে কোন অপশন তো নেই। বরং ডক্টর লাহিড়ীর সাজেশন অনুযায়ী আমাদের একটা ঠিকঠাক মা খুঁজতে হবে।”
তৃপ্তিদেবি একটু বিরক্ত হয়ে বললেন- ” ঠিকঠাক মা খুঁজতে হবে মানে? আমি তো তোমাদের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।”
আলাপন এতোক্ষণ চুপচাপ বাবার কথা শুনছিল। এবার সে মা-কে বলল-” ঠিকঠাক মা বলতে, আমরা যে মহিলার সাথে চুক্তিবদ্ধ হব, অপর্ণার সাথে তার যতবেশি মিল থাকবে তত ভাল।”
— তার মানে?
— দেখো, যে কোনো ফিটেড মাদার অ্যারেঞ্জ করলেই চলবে, তবুও আমরা আরো ভালো কিছু আশা করতেই পারি। সেই জন্যে যে বিষয় গুলো খেয়াল রাখতে হবে। যে মহিলাকে আমরা চুজ করব প্রথমতঃ সে হবে কলকাতার বাঙালি হিন্দু পরিবারের মহিলা, যে হবে অপর্ণার সম বয়সী, গায়ের রং ফর্সা, পোশাক পরিচ্ছদ খাদ্যাভ্যাস এক, অন্ততপক্ষে স্বল্প শিক্ষিত হতে হবে। বাড়ির পরিবেশ যতটা সম্ভব আমাদের মতো হতে হবে।
এই পর্যন্ত শুনে তৃপ্তিদেবি রে-রে করে উঠলেন–” অমন মহিলা কলকাতায় পাবে? আর পেলেও রাজি হবে?”
— সেটাই তো আমাদের খুঁজতে হবে।
**********
রাত্রে খেতে বসে সুজাতা রমেশকে বলল-” জানো তো, আজ বৌদিমনির চুলে হট অয়েল মাখিয়ে দেওয়ার সময় এ কথায় ও কথায় ওদের প্রবলেমটা বৌদিমনি আমাকে বললেন। বৌদিমনিরই প্রবলেম, সেইজন্যে ওদের বাচ্চাকাচ্চা হবেনা।” এটুকু শুনে রমেশ আবাক হয়ে বলল-” কিন্তু আমি ভাবছি, ওই রকম বড়লোক পরিবারের বৌ তোমার মতো কাজের লোকের সাথে তাদের ভেতরকার গোপন কথা গড়গড় করে বলল কেন!” সুজাতা বিস্ময় প্রকাশ করে বলল-” কথাটা আমারও যে মনে হয়নি তা নয়। আমি কিন্তু তেমন কোনো জানার আগ্রহ দেখাইনি। বৌদিমনি নিজের থেকেই আমাকে গড়গড় করে সব বলে দিল।” রমেশ হেঁসে বলল-” শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব মেয়েদেরই ক্যারেকটার এক, মনের মতো মানুষ পেলে মনের কথা খুলে বলে।”
— আরে শুধু এইটুকুই না, আমাদের ব্যাপারেও খোঁজ খবর নিল। আমি আমার কথা সব বলতে, আমাকে জানালো আমাদের ব্যাপারটা ফেলে রাখা ঠিক হচ্ছে না। ওরা যে ডাক্তার দেখায়, ডাক্তার বিপ্লব কুমার হোড়, তাকেই দেখাতে বলল।” রমেশ আঁতকে উঠে বলল-” না না, আমরা হসপিটালে যাব। ওসব বড়লোকের বড়বড় ব্যাপার স্যাপার। ওসব ডাক্তারের ফিস কত জান!!”
— আরে তুমি কি ভেবেছ, আমি জানি না, তোমার কথাই আমি বৌদিমনিকে বলতেই বৌদিমনি একটা কাগজে ডাক্তারের নাম,চেম্বার অ্যাড্রেস, ফোন নাম্বার দিয়ে বলল যে নাম লিখিয়ে টাকাপয়সার ব্যবস্থা সব বৌদিমনি করে দেবে।
রমেশ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল-” কি জানি, দুঃসময়ে মানুষ হয়ত আন্যের সমস্যাটা ঠিকঠাক বুঝতে পারে।”
— এটা ঠিক, ওরা বড়লোক হলেও অহংকারী নয়, অর্থের দম্ভ দেখায় না।”
— আসলে তুমি অনেক দিন ধরে ওই বাড়িতে বিশ্বাসের সাথে কাজ করছ, সেইজন্যে ওরাও তার প্রতিদান দিচ্ছে।
**********
অফিসে নিজের চেম্বারে বসে একমনে পরাশর মুখার্জি ফাইল চেক-আপ করছেন। এমন সময় দারোয়ান এসে খবর দিল দুইজন ভদ্রলোক তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছেন। পরাশর মুখার্জি দু’জনের নাম শুনলেন, বাবু সাঁতরা এবং পলাশ হালদার। তিনি সময় নষ্ট না করে দু’জনকে একসাথে ডাকলেন। রমেশ সাঁতরা,পলাশ হালদার কোলকাতার নাম করা দালাল। লিগ্যাল ইলিগ্যাল সব রকম কাজে পারদর্শী। দুজনেই ফটো সহ বেশ কিছু তথ্য নিয়ে এলেন। পরাশর মুখার্জি ছবি দেখে বায়োডাটাতে চোখ বুলিয়ে মুখে একটা নেতি বাচক শব্দ করে বললেন-” আরে এ-সব কি কালেকশন করেছেন বলুনতো! ফটো দেখে তো একজনকেও বাঙালি বলে মনে হচ্ছে না।”
— না স্যার, বিশ্বাস করুন বাঙালি। তার থেকে বড় কথা প্রয়োজন তো জঠর, মুখ দিয়ে কি হবে?
— (বিরক্ত হয়ে) আপনারা বুঝবেন না, আমি যেমটি বলেছি সেই রকম খোঁজ করুন।
**********
‘ডক্টর বিপ্লব কুমার হোড়, এম বি রোড, নিমতা (কলা বাগান), ফোন নং 9433276073।’ ঠিকানটা পড়ে নিয়ে রমেশ সুজাতাকে বলল-“তুমি রেডি? আর দেরি করা যাবে না। গুগল ম্যাপে যা দেখছি–শিয়ালদহ হয়ে বনগাঁ গামি ট্রেনে বিরাটি ষ্টেশনে নেমে, অটো, টোটোতে চলে যাব, সমস্যা হলে ডাক্তার বাবুর ফোন নাম্বার আছে তো।”
ডক্টর হোড় দুজনের সাথে মিনিট পনের আলোচনা করে এবং বাহ্যিক কিছু লক্ষণের উপর নির্ভর করে বললেন–” দেখুন মিসেস অপর্ণা মুখার্জি আপনাদের ব্যাপারে আমাকে সবকিছুই বলেছেন। আমার খুব অস্বাভাবিক লাগছে যে আপনাদের প্রবলেমটা নিয়ে তিনি নিজে উদ্বিগ্ন, যখন তাঁর নিজের একটা চরম দুঃসময় চলছে। যাইহোক প্রবলেম তো একটা আছেই। আমি সাসপেক্ট করছি প্রবলেম ইজ ক্রিয়েট বাই হাসব্যান্ড সাইড। সো, টেস্ট না করে তো সিওর হওয়া যাবে না। আপনারা উভয়েই নিন্মলিখিত টেস্টগুলো করে আসুন,তাহলে আমরা রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত হতে পারব। “
সুজাতাকে বিধিবদ্ধ দুই তিনটি পরীক্ষা করতে দিলেন। তবে রমেশ কে বললেন -” আপনি দুটো টেস্ট করিয়ে অবশ্যই রিপোর্ট সাবমিট করুন।”
**********
বাবু সাঁতরা এবং পলাশ হালদার কোলকাতা চষে ফেলল কিন্তু মুখার্জি পরিবারের পছন্দের একটা গর্ভ ভাড়াদেওয়া রমনী খুজে এনে দিতে পারল না। কোনো না কোনো একটা দিক সমস্যায় ফেলে দিচ্ছে। বেশি জেনে ফেললে এমনি সমস্যা হয়। ডক্টর লাহিড়ী যদি সারোগেট মাদারের নমুনাগুলি না বলে দিতেন তবে পছন্দে এত সমস্যা হত না। ডিনার টেবিলে বসে চার জনে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না। কথা প্রসঙ্গে অপর্ণা সুজাতার কথা পাড়ল। ওদের সমস্যাটা উত্থাপন করে এটাও জানায় যে অপর্ণা নিজ উদ্যোগে সুজাতাকে স্বামী সহ ডক্টর হোড়ের কাছে পাঠিয়েছেন। এ পর্যন্ত শুনে তৃপ্তিদেবি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে একটা প্রণাম করে বললেন-” ঠকুর যেন কোন শত্রুকেও এমন শাস্তি না দেন। প্রতিটি নারীর কাছে ‘মা’ হওয়া যে নারী জন্মের সার্থকতা। “
রাতে বিছানায় শোয়ার আগের আলাপচারিতায় অপর্ণা সুজাতাদের চার বছরের বৈবাহিক সম্পর্কের কথা সব আলাপনকে বিস্তারিত আলোচনা করল। অপর্ণার বক্তব্য, শাশুড়ীমা সুজাতা সম্পর্কে যে প্রার্থনা করেছেন সেটাতে সহমত পোষণ করেই সে বলতে চায়, সারগেট মা হিসাবে সুজাতাকে তার খুব পছন্দ। কারন ডক্টর লাহিড়ীর নির্দেশমতো সারগেট মাদার চুজ করতে যে যে দিকগুলো লক্ষ রাখার কথা সে সব বেসির ভাগই সুজাতার সাথে মিলে যাচ্ছে। ওদের সন্তান হলেও কোনো সমস্যা থাকবেনা। অপর্ণার ইচ্ছেটা যুক্তি সহকারে শুনে আলাপনেরও মন্দ লাগল না। সে ও ঘুম না আসার আগে অবধি সুজাতার ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে ভাবতে থাকল।
**********
আলাপন এবং অপর্ণার অর্থনৈতিক সহায়তায় ডক্টর হোড়ের তত্ত্বাবধানে রমেশ এবং সুজাতার পরীক্ষা নিরিক্ষা সহ চিকিৎসা চলল প্রায় মাস চারেক ধরে। অবশেষে ডাক্তার হোড় রমেশকে জানিয়ে দিলেন -” স্যরি রমেশ বাবু, আপনাকে যে টেস্ট দুটো করতে দিয়েছিলাম, সেখানে প্রথমে ছিল অ্যাজোস্পার্মিয়া টেস্ট, অর্থৎ শুক্রাণুর উপস্থিতি। এখানে টেস্ট রিপোর্ট সেন্ট পার্সেন্ট নেগেটিভ। সো আপনার বীর্জ শুক্রানু শূন্য। সামান্য অস্তিত্ব পেলে মেডিসিনের সাহায্যে বাড়িয়ে নেওয়া একটা চেষ্টা করা যেত, কিন্তু এখানে সেই সুযোগ নেই। পাশাপাশি সুজাতা ম্যাডামের সন্তান ধারণ ক্ষমতা সেন্ট পার্সেন্ট ও কে। সো, আই এ্যাম ভেরি ভেরি স্যরি। “
সুজাতা আজ কাজে যা-ই নি। অপর্ণা দিদিমণি মা হতে পারবেনা শুনে তার খুব কষ্ট হয়েছিল। আর আজ স্বামীর সমস্যার কারনে সেও মা হতে পারবে না যেনে মনটা ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। সুজাতা অনুভব করতে পারছে মা না হতে পারার কি জ্বালা, যেটা অপর্ণা দিদিমনি বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে। সারাদিন নাওয়া খাওয়া কিছুই করেনি। বালিশে মুখ গুজে কেঁদেই চলেছে। রমেশ পুরুষ মানুষ, আবেগ তার কম হতে পারে, তবে কষ্ট তো একই। পুরুষ মানুষ বহির্মুখী স্বভাবের হয়, সে কাজে হোক, বা অকাজে! ফলে রমেশ নিজেকে অপরাধী ভেবে নিয়ে কাজের অছিলায় পালিয়ে আপাত পরিস্থিতি থেকে বাঁচল বটে, তবে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ভয় অবচেতনে তার শরীরে বাসা বেঁধে ফেলেছে।দুটো পরিবার, একটা ধনী, আর একটা ততোধিক গরীব। সমস্যা একই,ফলে মনকষ্টের প্রভেদ নেই। এই মনকষ্ট থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার দুটি পথ খোলা, এক দাম্পত্য সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা,দুই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া। যেটা রমেশের পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব নয়। রমেশের ভয় সেখানেই। সুজাতা অন্তরজ্বলায় জর্জরিত কার অক্ষমতায় এই সমস্যা সে সব নিয়ে সে ভাবিত নয়। একটা ছোট্ট ফুটফুটে সন্তান তাদের ঘর আলো করে এসে অভাবের সংসারে সুখ না হোক শান্তির প্রাচুর্যে ভরিয়ে তুলবে, এটুকুই তো সে চেয়েছিল। ঈশ্বরের কৃপণতায় সেই সুখ আর সইল না।
রমেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারক, দু’জন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। রমেশ তারকের বাড়িতে গিয়ে নিভৃতে তার সাথে বর্তমান পরিস্থিতিটা আলোচনা করে। মনের মতো কারোর সাথে শেয়ার করতে না পারলে রমেশও যে স্বস্তি পাচ্ছে না। তারক সমস্ত কথাবার্তা শুনে তার বুদ্ধি বিবেচনা অনুযায়ী তাৎক্ষণিক কিছু উপদেশ দেয়, সে বলে-” দ্যাখ রমেশ, তুই যে ভয়টা পাচ্ছিস সেটা স্বাভাবিক। এই ক্ষেত্রে সুজাতা তোকে ছেড়ে চলে যেতেই পারে। ওর তো নিজস্ব একটা চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে। সব থেকে বড় কথা আইন এখন মেয়েদের দিকে।”
— সুজাতা খুব কান্নাকাটি করছে, আমি এখন ঠিক কি ভাবে ওর পাশে থাকব বুঝতে পারছি না।
— তুই যতটা পারিস ওকে সময় দে। সুজাতা যেন একাকিত্ব বোধ না করে। সব সময় হাসিখুশিতে রাখবি। ও যে সব কথা বলবে বা কাজ করবে ভুল হলে বা তোর পছন্দ না হলেও তালে তাল দিবি। সুয়োগ পেলেই মুভি দেখতে যাবি, বেড়াতে যাবি। মোদ্দা কথা ওর মনে তোর সম্পর্কে যেন কোনো নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা না জন্মায়।
রমেশের পৈতৃক ভিটে বসিরহাটের গোয়ালপোতা গ্রামে। রমেশ ঠিক করল, দু’চার দিনের ছুটি পেলে সুজাতাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে। অনেক দিন সেখানে যাওয়া হয় না। সামনে রাস পূর্ণিমা, বসিরহাট বি এস এফ এর মাঠে মহা সমারোহে বিরাট রাসের মেলা বসে। যেতে পারলে রথ দেখা কলা বেচা দুই-ই হয় আর কি।
বসিরহাটের পরিবেশ সুজাতাকে অনেকটাই হতাশা মুক্ত করল। পুকুরের মাছ ধরা, গাছের ডাব পাড়া, রান্নাবান্না, হই হুল্লোড়, এ যেন এক উড্ডীয়মান জীবন। পাশেই বসেছে বিশাল মেলা। কি নেই সেখানে, হরেক রকম নাগাড় দোল, সার্কাস, ম্যাজিক, রকমারি ফাস্টফুড, রঙ্গিন জল, ইত্যাদি ইত্যাদি। রমেশ সদ্যো বিবাহিত দম্পতির মত সুজাতার হাত ধরে মেলার ভীড়ে ঘুরছে, পাছে সুজাতা না হারিয়ে যায়।
— সুজাতা নাগরদোলা চাপবে?
—- না বাবা,নাগরদোলা চাপলে আমার মাথা ঘোরে,বমিবমি পায়।
— তা হলে চলো ম্যাজিক দেখি।
— না না, একশ টাকা টিকিট কেটে ম্যাজিক দেখার দরকার নেই।
— আরে কিছু তো একটা দেখবে! ঠিক আছে চলো পঁচিশ টাকা টিকিটে সার্কাস দেখি।
— চল, আগে ফুচকা খাই তারপর।
— যেমন বলবে, সেটাই হোক।
দুজনে মিলে বেশ উৎফুল্লতার সাথে একটার পর একটা ফুচকা খেতে খেতে সুজাতা বলল-” যতই বল,কোলকাতার ফুচকার তুলনা হয়না, এই ফুচকা তার ধারে কাছে যায় না।” ওদের কথপোকথন আর মেলার কলরবের মধ্যে সুজাতা একটা ঘোষণা শুনতে পেল–‘ আসুন,আসুন জ্যোতিষ বিশারদ নারায়ন শাস্ত্রীর কাছে এসে নিজের ভাগ্য জেনে যান। বেকার ছেলের চাকরি হচ্ছেনা? অবিবাহিত মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা? বাড়ি হচ্ছেনা? জমির মামলা চলছে? সন্তান সন্ততি হচ্ছেনা? প্রতিকার সহ ভাগ্য বিচার। চলে আসুন,চলে আসুন, মাত্র দু’শো টাকায় সমাধান।’ সুজাতার সন্তান হওয়ার ঘোষনা শুনে ফুচকা যেন গলায় আটকে গেল। ফুচকাওয়ালার পয়সা মিটিয়ে রমেশকে টানতে টানতে শব্দের উৎস সন্ধানে চলল।
ত্রিপলের ছোট খাটো একটা ঘর, সামনে পর্দা লাগানো। পর্দার বাইরে টেবিল পেতে একজন বিল বই নিয়ে বসে আছে। আর একজন ঘোষকের কাজে ব্যাস্ত। মেলায় ঢুকে রমেশ সুজাতার হাত শক্ত করে ধরে ছিল, যাতে সে হারিয়ে না যায়। বর্তমানে সুজাতাই রমেশের হাত শক্ত করে ধরে টেবিলের সামনে এসে দাড়াল। সুজাতা রমেশকে দেখে মনস্তাত্ত্বিক বিশারদের মত টেবিলের পাশে দাঁড়ানো ঘোষক বলল-“আসুন দিদি আসুন, আনেক দিন বিয়ে হয়েছে বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছেনা? কোন চিন্তা করবেন না। একবার যখন নারায়ন শাস্ত্রীর দ্বারে এসে পড়েছেন আর চিন্তা নেই, শুধু দু’শো টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ওনার চরন স্পর্শ করুন। সমাধান অবসম্ভাবী, প্রতিকার না দিলে একশো টাকা ফেরত।”
সুজাতা সময় নষ্ট না করে একটা টিকিট কেটে ভেতরে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকল। রমেশ বুঝতে পারছে, এখানে কৃত্রিম ভাবে ভীড় সৃষ্টি করা হচ্ছে। হা করে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটা কৃত্রিমতার প্রতিক্রিয়া। সুজাতার ইচ্ছে,অর্থাৎ চুপচাপ থাকাই ভাল। অবশেষে ঘোষনা হল-‘ সুজাতা মণ্ডল ভেতরে যান।’ রমেশ স্বগতোক্তি করল-“সর্বসাকুল্যে আমরা ছাড়া কেউ নেই, ভাব দেখাচ্ছে যেন কত ভীড়।” পর্দা সরিয়ে ভীতরে ঢুকে রমেশ দেখল, তন্ত্র সাধকের মত সেজেগুজে বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক, সামনে মা তারার বড় একটা ফটো, তাতে সিঁদুর লেপটিয়ে জবা ফুলের মালা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। রমেশের মতে এসব ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই না। মানুষের দুর্বলতার উপর প্রভাব বিস্তার করে টু পাইস কামানো আর কি। যাইহোক জ্যোতিষী মহাশয় সুজাতার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভাবে বললেন-” আয় মা, তোর মনের ভিতরে আনেক কষ্ট পাথর চাপা দেওয়া আছে। এসেই যখন পড়েছিস আর চিন্তা নেই।” সুজাতা জ্যোতিষীর কথায় বিশ্বসে গদগদ হয়ে প্রণাম করতে উদ্যত হল।
— না না মা, তারা মা’য়ের সামনে আমাকে প্রণাম নয়,ওনাকে কর,আমি কেউ না,নিমিত্ত মাত্র। তারা মাকে প্রণাম করে জ্যোতিষীর সামনে বসতেই,
— কতদিন বিয়ে হয়েছে?
— বছর পাঁচেক।
— হুঁ, বল তোর সমস্যা কি? কি জানতে চাস?
— বাবা আমার এখনো—-
— বাচ্চাকাচ্চা হয়নি তাইতো, দেখি তোর বাম হাতটা। খানিকক্ষণ হাতটা ধরে বিভিন্নভাবে নিরীক্ষণ করে মুচকি হেঁসে বললেন- ” আমি যে তোর কোল আলো করে পুত্র সন্তান আসবে দেখতে পাচ্ছি।” সুজাতা পুত্র সন্তান হবে শুনে আনন্দে কেঁদে ফেলে। এবার জ্যোতিষ মহাশয় গম্ভীর স্বরে বললেন-” কিন্তু মা, একটা বাধা আছে। অসুবিধা নেই, সামান্য একটা প্রতিকার করলেই হবে।” সুজাতার ত্বর সইছে না, উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করে -” কি বাবা?”
— তোকে একটা কবচ ধারণ করতে হবে।
— নিশ্চই,কি ভাবে কি করব বলুন?
জ্যোতিষী মহাশয় সুজাতার আগ্রহ বুঝে ভাবলেন, সুযোগের সৎ ব্যবহার এখনি করতে হবে। কারন সুজাতার স্বামীর চোখ মুখের ভাব ভাল ঠেকছে না। চোখ বন্ধ করে একটা হিসাব নিকাশ করে বললেন- “এক হাজার টাকা লাগবে।” সুজাতা রমেশকে হাজার টাকা দিতে বলল। অন্য সময় হলে রমেশ সুজাতাকে একহাত নিতো, কিন্তু এখানে কোন কথা না বলে স্ত্রৈণের মতো টাকাটা বার করে দিল। সুজাতা জ্যোতিষী মহাশয়ের হাতে টাকাটা দিতেই তিনি পাঁচশো টাকার নোট দুটো তারা মায়ের ফটোতে ঠেকিয়ে ট্যাকে গুঁজে নিলেন। তারপর একটা লাল শালুতে অল্প শুকনো ফুল আর কিছু জড়িবুটি সুজাতার হাতে দিয়ে বললেন- ” তামার মাদুলি করে শনি, মঙ্গলবারে মা তারার পায়ে ছুঁইয়ে ডান হাতে ধারণ করবি।”
সুজাতা গদগদ হয়ে বলল-” আর কিছু বাবা?”
— না, কার্য সিদ্ধ হলে হঠাৎগঞ্জে আমার মন্দিরে গিয়ে প্রাণ ভরে মা’কে পুজো দিয়ে আসবি। এখন যা, বাইরে অনেক লোক অপেক্ষা করছে।
বাইরে বার হতে-হতে রমেশের মুখ থেকে অস্ফুটে বেবিয় গেল-” কাজ যেই মিটে গেল,অমনি ঘাড় ধাক্কা, আগে ভাবখানা দেখাচ্ছিল যেন রক্তের সম্পর্ক।” সুজাতা কৃত্রিম অভিমান করে বলল-” অমন করে বোলোনা, আমাদের মনের চাওয়া বুঝে কেমন পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন বলো।” সুজাতার গর্ভে সন্তান আসবে জেনে তার যতটা আনন্দ হচ্ছে, ঠিক ততোটাই মন ভেঙে যাচ্ছে রমেশের। তাহলে সুজাতা সম্পর্কে রমেশ যে ভয় পাচ্ছিল সেটা সত্যি হতে যাচ্ছে না তো?
(৪)
বাবু সাঁতরা এবং পলাশ হালদার দুই দালাল টাকার হিসাব ঠিকঠাক নিয়ে নিলেও পছন্দসই একটা সারোগেট মায়ের খোঁজ খবর দিতে পারলেন না। ক্ষুব্ধ হয়ে পরাশর মুখার্জি তাদের প্রাপ্য মিটিয়ে বিদায় দিলেন। ভাবলেন দায়িত্ব এবার নিজের কাঁধেই নেবেন। অনেক চিন্তা ভাবনা করে নামি পত্রিকায় বিশেষ গুণাবলি উল্লেখ করে একটা বিজ্ঞাপন দিলেন। সেটাও বৃথা গেল। যা সব ফটো সহ যোগাযোগ আসতে থাকল তা কহতব্য নয়। পরাশর মুখার্জি হাল ছেড়ে দিয়ে ডিনারের সময় সকলের কাছে হতাশা প্রকাশ করলেন। তৃপ্তিদেবি একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন-” তুমি কি বৌমা খুঁজতে যাচ্ছ! যে সবকিছুই অপর্ণার মতো হবে। যা পেয়েছ তার মধ্যে থেকে দেখে শুনে একজনকে সিলেক্ট করো।”
পরিবারের তিনজন যখন কোনো বিষয়ে আলোচনা করে, সাধারণত অপর্ণা সেখানে উপযাচক হয়ে কোনো মন্তব্য করে না। আজ আর সে চুপ করে থেকে মনের ইচ্ছাটাকে গোপন রাখল না। সে একটা অদম্য উৎসাহ নিয়ে বলল-” আচ্ছা আমরা সুজাতাকে চুজ করতে পারিনা?? “
প্রশ্নটা টেবিলের মধ্যে পড়তেই সকলে কিছুক্ষণের জন্যে নিশ্চুপ হয়ে পরস্পর পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকল। ক্ষণিকের নিরবতা ভঙ্গ করে পরাশর মুখার্জি একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন-” দাঁড়াও দাঁড়াও প্রস্তাবটা ফেলে দেবার মতো না। ও তো পাঁচ ছয় বৎসর আমাদের বাড়িতে কাজ করছে, আমাদের আদবকায়দায় অনেকটাই এ্যাডজাস্টটেড। ডক্টর লাহিড়ীর সারোগেট মাদার চুজ করতে বলে দেওয়া গুনাবলির অনেক কিছুই সুজাতার সাথে মিলে যাচ্ছে।”
তৃপ্তিদেবি যেন একটু খুশি হয়েই বললেন-” সব তো ঠিকই আছে,আগে দেখ সুজাতা রাজি হয় কিনা,তারপর ওর স্বামী,ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সজন, তাদেরও মতামত আছে।”
অপর্ণা বাড়ির বড়দের ইতিবাচক ইচ্ছার কথা জেনে গিয়ে বলল-” তোমরা ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও, আমি ওর সাথে কথা বলে দেখি।”
**********
“সুজাতা রান্না ঘরের কাজ সারা হয়ে গেলে বোলো, তোমার আর আমার ব্রেকফাস্ট আমার বেড রুমেই সারব।” অপর্ণা রান্না ঘরে উঁকি মেরে সুজাতাকে কথাটা বলে চলে যাওয়ার পর সুজাতা রিতিমতো চিন্তায় পড়ে গেল, ঘাবড়ে গেল তার থেকে বেশি। প্রথমত বৌদিমনির সাথে ব্রেকফাস্ট! তা-ও আবার ডাইনিং এ নয়, একেবারে বেডরুমে!! আবাক হল এই ভেবে এত বছরে বেড রুমে বসে ব্রেকফাস্ট তো দূরের কথা, জল খেতে দেখেছে কিনা সন্দেহ। যাইহোক কাজ কর্ম সেরে দুই প্লেট খাবার নিয়ে সুজাতা অপর্ণার ঘরে ঢুকল।
ব্রেকফাস্ট করতে করতে অপর্ণা সুজাতার কাছে জানতে চায় যে ডক্টর বিপ্লব কুমার হোড়ের কাছে তারা কি এ্যাডভাইজ পেয়েছে। সুজাতা অপর্ণার প্রশ্নের উত্তর দেরার আগে মুখের গ্রাস মুখেই রেখে ছলছল নেত্রে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে। অপর্ণা কিছু একটা অনুমান করে সুজাতাকে জিজ্ঞেস করে-” কি হল সুজাতা,তুমি অমন থমকে গেলে কেন?” সুজাতা মুখের গ্রাসটা কোনো রকমে গিলে নিয়ে অপর্ণাকে তাদের ব্যাপারে ডাক্তার হোড় পরীক্ষা নিরিক্ষা করে যা যা বলে ছিলেন সবই সবিস্তারে বলল। অপর্ণাও সমব্যথিনী, দুঃখটা ভাগ করেই জিজ্ঞেস করল যে ডাক্তার হোড় কোনো শাজেশন দিয়েছেন কিনা? সুজাতা হতাশার সুরে বলল-” বলেছেন, অনাথ আশ্রম থেকে এ-ক-টা শি-শু–“
অপর্ণা বর্তমানে নিজের সমস্যা সমাধানে অনেকটাই স্বাভাবিক। সুজাতাকে কাছে টেনে নিজের বড় দিদির মতো বলল-” বুঝলে সুজাতা, তোমার ভাগ্য আর আমার ভাগ্য ঈশ্বর এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছেন। তোমাদের ক্ষেত্রে রমেশের প্রবলেম, আর আমাদের ক্ষেত্রে আমার প্রবলেম।” তার নিজের সমস্যায় সে এতটাই বিহ্বল যে বৌদিমনির কষ্টটা হয়ত ততোটা অনুভব করতে পারছে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অপর্ণাই কথা শুরু করে-” তোমরা কি কিছু ভাবনা চিন্তা করেছ।”
— না বৌদিমনি, তবে ডাক্তার হোড়ের কথা গুলো আমাদের সকলের পছন্দ হয়েছে।
— কি বলেছেন ডক্টর হোড়?
— উনি বললেন-” আপনাদের সন্তানসন্ততি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে আজকের দিনে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। কোনো চাইল্ড এ্যাসায়েন্সমেন থেকে একটা শিশু দত্তক নিলে আপনাদের সন্তানহীনতার কষ্ট অনেকটাই লাঘব হবে, পাশাপাশি একটা অনাথ শিশু তার জীবনের একটা বৈধ স্বীকৃতি পাবে। এটা সমাজের একটা দায়বদ্ধতা পালন করা হবে।” ডাক্তার হোড়ের প্রস্তাব সুজাতাদের ভাল লেগেছে শুনে অপর্ণাও মনের কথাটা আস্তে আস্তে প্রকাশ করবে ঠিক করল। অপর্ণা শিক্ষিত মেয়ে সুকৌশলে সুজাতাকে বলল-” সব ঠিকই আছে,তবে একটা কিন্তু থেকে যায়, যেটা আমাদেরও চিন্তাভাবনায় স্থীর সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না।”
— সেটা কি বৌদিমনি?
— অনাথ আশ্রম থেকে শিশু দত্তক নিলে তার সাথে মা বাবার কোনো রক্তের সম্পর্ক থাকে না। তাছাড়া বাঙালি না অবাঙালি, হিন্দু না মুসলিম কিছুই বোঝার উপায় নেই। কতৃপক্ষ কিছু বলবেও না। সমস্যা অনেক।”
— তা হলে উপায়!!
— সে-ই বিষটা নিয়ে আমাদের কাছে ব্যপারটা আলোচনার পর্যায়ে আছে।
— আপনাদের ব্যাপার স্যাপার আলাদা,তার সাথে কি আমাদের চিন্তা ভাবনা মেলে!!
— আচ্ছা ধরো যদি কোনো চিন্তা ভাবনা করে এক সাথে এগোনো যায়।
— বৌদিমনি আমি আপনার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।
— সব কথা শুনে বোঝার চেষ্টা করলেই বুঝবে।
— আপনার কথাগুলো এখনো আমার কাছে কেমন তালগোল পাকিয়ে আছে।
— আরে আমি তো তোমাকে এখনো কিছু বলি-ই নি।
সুজাতা নুতন কোনো আশার আলো দেখতে পেয়ে বলল- “বলুন না বৌদিমনি।”
— তুমি কি কখনো সারগেট মাদারের নাম শুনেছ??
— শুনেছি কি ম্যাডাম,আমি সারগেট মাদারের উপর দু-দুটো হিন্দি,একটা বাংলা মুভি দেখেছি।
— ও তাহলে তুমি তো অনেক কিছুই জানো।
— না না আমি তো জাস্ট মুভি দেখেছি, ওসব তো সাজানো গোছানো। বাস্তব তো আলাদাই হয়।
অপর্ণা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মনেমনে ভাবল, যে কথাটা সুজাতাকে সে বলবে, এবং সেটা সম্ভব হলে মুভির মতোই হবে। অপর্ণা কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। এটাতো আর বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের মেজর মেন্ট নয়,বা ইকোনোমিক্সের ফর্মূলা নয়। এটা মনের উপর প্রভাব বিস্তার করা। কাউন্সিলিং এ সামান্য ভুল হলেই ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা। বড় স্পর্শকাতর বিষয়। সুজাতাও বৌদিমনির কাছে বিষয়টা জানতে আগ্রহী।
অপর্ণা বলল-” দেখ সুজাতা, ফরচুনেটলি যদি তোমার সন্তান হতো, বা আমারও—।” এইটুকু শুনে সুজাতা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল,যেন ভেতর থেকে একটা চাপা কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল। অপর্ণা তাকে আস্বস্ত করে বলল-” আমি নিজেকে দিয়ে তোমার কষ্টটা অনুভব করতে পারছি। সেই জন্যে একটা সুষ্ঠ সিদ্ধান্তে আসতে চাইছি। যেটা বলছিলাম,তোমার সন্তান থাকলেও তোমাকে আমার সন্তান দেখাশোনা করতে হত। কারন আমি আমার অফিসের কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। তোমার মনে এই মুহূর্তে প্রশ্ন জাগছে, তুমি কেন আমরা তো অন্য কোনো ট্রেন্ড গভর্নেন্স রাখতে পারতাম। ঠিকই, পারতাম কিন্তু রাখতাম না, এই জন্যে, তুমি যেটা পারতে অন্যে সেটা পারত না। কারন আমাদের বাড়িতে তুমি দীর্ঘ দিন থাকার ফলে অন্যের থেকে তুমি যে ভীষণ যত্নশীল হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।” সুজাতা অপর্ণার মুখ থেকে ‘তার উপর মন থেকে ভরসা করার’ কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে বলল-” আমি আপনাদের বাড়িতে কাজ করি ঠিকই তবে নিজেকে কাজের মহিলা মনে করে আপনাদের পর ভাবি না।”
— একদম ঠিক বলেছ, আমাদের পরিবারও তোমার উপর সম্পূর্ণ ভরসা করে। তুমি যেন আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছ। তোমার বিশ্বস্ততার উপর ভরসা করে তোমাকে আমি একটা প্রস্তাব দেই, ভেব দেখ—“
— কি প্রস্তাব বৌদিমনি??
— তুমি তোমার গর্ভে আমাদের সন্তান ধারণ কর।
সুজাতা লজ্জা পেয়ে বলল-” এ-স-ব-ব কি বলছেন বৌদিমনি, দাদাবাবুকে আমি কত সন্মান করি!!”
অপর্ণা হো হো করে হেসে বলে -“আরে নানা তুমি বুঝতে পারছ না। এখানে আলাপন তোমার সামনেই আসবে না। তুমি বা তোমরা রাজি হলে, একটা এগ্রিমেন্ট হবে। তারপর ছোট্ট একটা ওটি, ব্যাস তুমি প্রেগন্যান্ট। তারপর দিন গোনবার পালা। একটা সময় ভূমিষ্ঠ হবে আমাদের সন্তান। যার উপর তোমার অধিকারও কম নয়! বেবিকে জন্ম দিলেই তোমার কাজ শেষ নয়, তাকে বড় করতে হবে, মানুষের মত মানুষ করতে হবে। সব দায়িত্ব তোমার, বড় হয়ে সে যেন তোমাকে দেখিয়ে বলতে পারে তুমি তার পালিতা মা। আমরা তেমাকে সব রকম সহযোগিতা করব।”
অপর্ণার মুখে সন্তান ধারণ, তাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর কথাগুলো শুনে সুজাতার মনে মাতৃসত্তা জাগরিত হল। এক লহমায় একটা শিশুকে কল্পনা করে সুজাতা কল্পনার জাল বুনতে শুরু করল। বাকরূদ্ধ হয়ে আনমনে ভাবতে ভাবতে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল। সম্বিত ফিরল অপর্ণার ডাকে–
— কি ভাবছ সুজাতা,বাড়িতে গিয়ে রমেশের সাথে আলোচনা কর। তোমরা আমাদের পাশে থাকলে তোমাদেরও মঙ্গল, ভেবে দেখ।
**********
রাতে শোয়ার আগে অপর্ণা আলাপনকে সুজাতার সাথে কথাবার্তা যতটুকু হয়েছে সেটা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করল। আলাপন শুনে খুশি হয়েই বলল- “তুমি লেগে থাকো,হাল ছেড়না। আমিও অনেক ভেবেছি সুজাতা ইজ আ আইডিয়াল মাদার চয়েজ। ব্যাপারটা নিয়ে আমরা সময় নষ্ট করব না। করন রাজি হলেও কিছু আইনগত পেপার্স তৈরি করতে হবে। তারপর মেডিকেল চেক-আপ, অবশেষে ডক্টরের এ্যাডভাইজ্ড মতো এগুতে হবে।
**********
এদিকে সুজাতা ভাবল প্রথমে তার নিজের মাকে আপর্ণার প্রস্তাবটা বুঝিয়ে বলবে। আবার ভাবল, মা সেকেলে মহিলা যদি বুঝতে না চান। তারথেকে ভাল প্রথমে রমেশকে বুঝিয়ে বললে হয়ত ব্যাপারটা সে বুঝতে পারবে, রমেশ নিজের সমস্যাজনিত কারনে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই জানার পর কেমন যেন মনমরা হয়ে আছে। হয়ত ভাবছে সুজাতা যদি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এদিকে অপর্ণার প্রস্তাবটা সুজাতার নিজেরই খুব পছন্দ হয়েছে। তার মনে হচ্ছে যেন, ‘রূপকথার রাজকুমার জন্মনেবে গোয়ালিনীর গর্ভে।’ রমেশ সহমত পোষন করলে, দুটো পরিবারের যৌথ প্রচেষ্টায় একটা দুঃসাধ্য সাধন হবে।
সুজাতা লক্ষ করছে ডাক্তার হোড়ের চেম্বার থেকে তাদের মেডিকেল রিপোর্ট শুনে আসার পর থেকে সমরেশ সবসময় কিছু যেন ভাবতে থাকে। তার সাথে কোনো ব্যাপারেই দ্বিমত পোষন করে না। সুজাতার মনের উপর তার নজরদারি অনেক বেড়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া, পোশাক পরিচ্ছদ, চালচলনে দিয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। এর কারণ যে সুজাতা অনুমান করতে পারছেনা তা নয়। তবে সেটা মনে থাকাই ভালো। যাইহোক রাত্রে খাওয়ার সময় সুজাতা অপর্ণার দেওয়া প্রস্তাবটা সমরেশের কাছে সবিস্তারে পেশ করল। সমরেশ সবটা শুনে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব মনেমনে সুজাতার উপর ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন করল-” তোমার কি ইচ্ছা?? ” সুজাতা সমরেশের মুখের অভিব্যক্তি দেখে মোটামুটি অনুমান করল,সমরেশ নিমরাজি হলেও হতে পারে। তখন সে বুদ্ধি করে বলল-” তোমার ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে আমার ইচ্ছা।” সমরেশ খাওয়া শেষ করে মুখ ধুতেধুতে ভাবে- সুজাতার সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার যে ভয়টা কিছুদিন ধরে তাকে পেয়ে বসেছে, একমাত্র এই প্রস্তাবে রাজি হলে অন্তত সেই ভয়টা আর থাকবেনা। অন্যের সন্তান লালন পালন করলে নিজেও মাতৃত্বের স্বাদ পাবে। সুজাতা মানসিক শান্তি পেলে তারাও ভাল থাকবে। সমরেশ নিজের যুক্তিটা গোপন রেখে সুজাতাকে প্রশ্ন করল-” আমার শারীরিক সমস্যার কথাটা তুমি কাকে কাকে বলেছ?”
— মাত্র দু’জন কে। বৌদিমনিকে না বললেই নয়, কারণ বৌদিমনি খরচ খরচা করে চিকিৎসা করিয়েছেন। আর বলেছি আমার মাকে। “
— উনি শুনে কি বললেন??
— মা কথাটা শুনে পাঁচ কান করতে বারণ করেছেন। মার বক্তব্য আরো দুই একজন ডাক্তার দেখানো উচিত। তারপর সত্যিই যদি কোনো সমস্যা থাকে লোকে এমনিই বুঝে যাবে।
— শোনো, তুমি যে সারগেট মাদার হতে চাইছ সেটা এখনি আমাদের বাড়ির কারোর সাথে বলোনা, এমন কি তোমার মাকেও না। কারণ সবাই ব্যাপারটাকে ভালভাবে দেখবে না।
— ঠিক বলেছ, পরে জানলে আর সমস্যা হবেনা।