অথ-সৌবল কথা
…………………….
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
সৌবল এতক্ষণ ধরে মখমল শোভিত মোলায়েম আসনটিতে বসে চরম প্রতিশোধের পন্থাগুলি নিয়ে চিন্তা করছিলেন। রাত্রিকালীন আকাশও বেশ মেঘাচ্ছন্ন। পার্থিববস্তুর বিলাস ও মোহময় ব্যসনের সমস্ত উপকরণের সম্ভার হস্তিনাপুরে এত বেশী পরিমাণে আছে যে উনি নিজেও মাঝে মাঝে এসবে বড় বিস্মিত হয়ে তাদের কাছে স্বেচ্ছায় পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন।
এবারে নিজের স্মিত হাস্যমুখের প্রতিবিম্বটি স্ফটিকের দর্পণে অনেকক্ষণ ধরে দেখতে দেখতে ক্রমশ নিজেকেই নিজের কাছে আজ যেন বড় বেশী প্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছে।
সুদূর গান্ধারদেশের পার্বত্যময় পরিবেশের চেনা অলিন্দ থেকে আর্যাবর্তের এই মূল নিয়ন্ত্রণভূমির একটা মোহ যে এখনও টিকে আছে, তা আজ আর তিনি অস্বীকার করতে পারবেন না।
তবে সৌবল চাইলে তো এখনও গান্ধারের সিংহাসনেই বসে হস্তিনাপুরের তিক্তপ্রাণ ও শঠতার আবেশটিকে উপভোগ করতেই পারতেন! তাহলে কেনই বা তিনি এখানকার কন্টকলাঞ্ছিত আত্মসুখটিকে এখনও অস্বীকার করতে পারছেন না? শুধুই কি এক নাটকের শেষ দৃশ্যটির জন্যে এই প্রতীক্ষা?
…..
রাত্রির তৃতীয় প্রহরের স্তব্ধবাক চরাচরটি ওঁকেও যেন বারবার এই একই বিষয়ে প্রশ্নটি করে অন্তর্দহনে অগ্নিসম্পাত করছে।
কেন? কেন? কেন?
এই নারকীয় ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের আসরে ‘কেন’ তাঁকেও জড়িয়ে পড়তে হল?
কে দেবে এর উত্তর?
একটি গভীর স্বপ্নঘোরের ভিতর থেকে হঠাৎ যেন শুনতে পেলেন বৃদ্ধ পিতা ও আপন ভ্রাতাদের কারাগারে শৃঙ্খলিত হাহাকার। গান্ধার নরেশ সুবল আজ কুরুরাজপ্রতিনিধি ভীষ্মের হাতে সপুত্র বন্দী যে! আর একটু আগেই নির্মম গঙ্গাপুত্র এক নিদারুণ শর্ত ঘোষণা করে একটি পারাবতের জন্য নির্দিষ্ট কিছু গোধূম চূর্ণ প্রতিটি রাজবন্দীর জন্য বরাদ্দ করে দিয়ে গেছেন!এর অন্যথার নাম হল শমনভবনের প্রস্তুতি।
নাঃ! এ অপমান যে অসহ্য…! আর সহ্য হয়না।
গান্ধারের বৃদ্ধ রাজাও হস্তিনাপুরের বন্দীশালায় আর সহ্য করতে পারছেন না এই অপমান।
কি আশ্চর্য একজন জন্মান্ধ রাজপুত্র কেবল বংশমর্যাদা ও সামরিক শক্তির বলে চিরদিন ধরে স্বাদু ও সামাজিক বলাৎকার করবে তাঁর সুকুমারী ভগ্নীর প্রণয়কুসুম ?
নাহ্ ! এ যে অসহ্য! এ যে চরম অন্যায় !
……
সুবল এবারে মলিন কন্ঠে স্বগতোক্তি করে বললেন,
” পুত্রগণ! আমরা যদি নয়জনে যদি স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করি তাহলে…? ”
সৌবল জানেন এই অবস্থায় সেটা আদৌ কোন কঠিন প্রতিজ্ঞা নয়, বরং তার চেয়ে কঠিন কাজ হবে দশম জনের, যে থেকে যাবে জীবিত।
নিকটতম আত্নীয়ের অনাহারজনিত মৃত্যু স্বচক্ষে দেখেও তাকে ওই একমুষ্টি ভিক্ষার আহারে বেঁচে থাকতে হবে।
সেদিন তিনি স্থির করেছিলেন যে প্রত্যেকটি মৃত্যুপথযাত্রীকে তাঁকেই শেষ আশ্বাসটি দিতে হবে— বদলে চাই চরমতম প্রতিশোধ ! এই কুরুরাজ বংশকে নির্বংশ করতেই হবে — এমন একটি নারকীয় পরিকল্পনায় তার জন্য আগামীপ্রজন্ম যেন ভাইয়ে-ভাইয়ে রক্তক্ষয়ী বিবাদেই যেন নির্বংশ হয়!
……
পিতাকে বলেছিলেন যে তিনিই সেই দশম জন হতে স্বীকৃত যে শেষ অবধি জীবিত থাকতে রাজি আছে। এই অগ্নিমন্থনের জন্য সেদিন সেই প্রতিশোধের আগুনে জ্বালিয়ে নিয়েছিল লেলিহান অগ্নিশলাকা।
সৌবল নতমস্তকে বললেন,
“আপনি আশীর্বাদ করুন, মহাভাগ! আপনাদের রক্তের ঋণ যেন আমি পরিশোধ করতে পারি।”
বৃদ্ধ পিতা তখন তাঁর পাঁজর-সর্বস্ব বুকে ওকে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, “তুমিই পারবে ! শোনো, আমার অনাহার-মৃত্যুর পর আমাকে সৎকার কোরো না। বরং আমার বুকের পাঁজরের অস্থি নিয়ে বানিয়ো সুরম্য অক্ষের গুটিকা। বৈরীনির্যাতনের যে বাসনা নিয়ে আমরা সবাই মৃত্যুবরণ করছি সেই দূর্দম বিষাদ আমার বুকের পাঁজরে লুকিয়ে থাকবে। এই দ্যূতক্রীড়াই একদিন তোমার প্রার্থনাটি শুনবে! কুরুকুল ধ্বংসের বীজ সুপ্ত থাকল এই অত্যাসাধারণ শস্ত্রপ্রয়োগের দ্বারাই !”
……
আজ বাসুদেব স্বয়ং ব্যর্থ ও অপমানিত হয়ে ত্যাগ করেছেন কুরু রাজসভা। মূর্খ পিতা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ও অসংবেদী ধার্তরাষ্ট্রগণের সমস্ত অহমিকা কাল একটি অন্যায় ও অসাধু দ্যূতক্রীড়ায় আহ্বান করবে পান্ডবদের।
এই অক্ষক্রীড়াই হবে শেষের মহাসূচনা।
সৌবল পরম তৃপ্তিতে এবার নিজর শয়নকক্ষের দিকে হেঁটে যান। তিনি এখন অনেকটা গ্লানিহীন বোধ করছেন। আকাশেও ক্ষীণ চন্দ্রাবেশ মেঘমুক্তির পরে দেখা দিচ্ছে।
তিনি জেনে গেছেন যে কাল প্রত্যূষের নবারুণ প্রকৃতই তাঁর অঙ্গে ধারণ করবেন রক্তলাঞ্ছনার রক্তিম রাজবেশ।
সৌবল এসবের জন্য আজ থেকেই নিজের মানসিক প্রস্তুতিটিও শুরু করলেন !
—oooXXooo—