অথচ রোজ পাকদণ্ডী বেয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হত এমন তো নয়। টিলা ভেঙে যাতায়াত করতে হত বটে , কিন্তু জীবনের অনেকটা পথই তো সমতলের রাস্তা বেয়ে চলা। তবু , রাস্তার কথা উঠলেই , সুদূর শৈশবে , ত্রিপুরার উত্তরে, মাহিন্দ্রা জীপের সওয়ার হয়ে , পাহাড়ি পথ বেয়ে বারো মুড়া আর আঠারো মুড়ার পাক অতিক্রমের কথাটাই প্রথমে মনে আসবে কেন ? সেকি জীবনের রাস্তার অনেকটাই চড়াই উতরাই বলে ? রাজপথের আত্মকথা লিখতে বসিনি বটে , তবে মধ্য পঞ্চাশ পেরোনো জীবনে রাস্তা শব্দটি ঘিরে কত স্মৃতি , কত চিত্রকল্প ! পিচ ঢালা রাস্তা বেয়ে মিনিট কুড়ি হাঁটার পর, দুপাশে সবুজ ধানের রাশির মধ্যে আল পথ ধরে স্কুলের টিলার দিকে হেঁটে চলা , পিথাগোরাসের উপপাদ্যের প্রথম ব্যবহারিক প্রয়োগ। আমার ঠিক চার বছরের বড় দিদির সঙ্গে রোজকার স্কুলযাত্রার কথা বার্তা রেকর্ড করা নেই , থাকলে অপু দুর্গার সংলাপ মনে হতে পারত। সেই আলপথ পেরিয়ে , গরু চড়ান রাখাল বালকদের পাশ কাটিয়ে টিলা বেয়ে ওঠা , যেখানে সবুজ ঘাসের উপর ছাত্র ছাত্রীদের রোজকার পদচারণায় পিষ্ট ঘাসের উপর আঁকাবাঁকা রাস্তা তৈরি হওয়া ? এরকমই আরও আরও টিলার গা বেয়ে , অথবা মাঠের উপর মানুষের পায়েরছাপ বুকে নিয়ে কত না রাস্তা তৈরী হয়ে যায় , এদিক থেকে সেদিক, এগ্রাম থেকে সে গ্রাম। ষোল বছর বয়সে কলকাতা চলে আসা যেন গলি থেকে রাজপথে এসে পড়া । শহর , খানিকটা শহরতলীর রাস্তা মানেই ট্রাফিক হর্ন , জ্যাম , বর্ষাকালের কালো কাদা তা নয়। রাজধানীর রাজপথে , বিশেষত গড়িয়াহাট নামের সব পেয়েছির দেশে মাখন সুন্দরীদের আনাগোনা , দিনে রাতে সবসময় হাজার বাতির রোশনাই। এই সুন্দরীরা , যারা সকলেই নীরা , হকার যুবকের সঙ্গে সিটি গোল্ডের চুড়ি কিংবা হেমে সেলাই করা পেটিকোটের দরদাম করলে নিজেকে খুব হতাশ মনে হত। নীরারা তো পরী , পৃথিবীর সব কিছু বিনা দর কষাকষিতে ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে যাওয়ার কথা ! খুব আশ্চর্যের কথা , কলকাতা রাজপথ বললেই আমার বাপির কথা মনে হয় – বাপি , ট্রাফিক কনস্টেবল। নয়ের দশকে , চাকরি জীবনের প্রথম দিকে , বাপির ডিউটি পড়ত বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের কাছটিতে। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল থাক না থাক, হাত পা সঞ্চালন করে অতি সক্রিয়তায় সে ব্যস্ত রাজপথের ট্রাফিক শাসন করত – মিনিবাসের জানালা দিয়ে এক আধটি আওয়াজ বেরিয়ে আসত , বাপি , বাপি ! এই বাপি ডাকটি রাজপথের ভিড়ে ঠাসা বসে মহিলার সম্ভ্রম রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে পারা আরেক বাপির কথা মনে করিয়ে দেয় -সার্জেন্ট বাপি সেন। এককালে মধ্যরাত কলকাতা শাসন করত চারজন যুবক। মধ্যরাতে ফুটপাথ বদল করার মত বোহেমিয়ান কোনদিন ছিলাম না , তবে ভোরবেলা আর গভীর রাতের শহরের চেহারা একেবারেই আলাদা , সে চর্মচক্ষে ধরা পড়েছে আমারও। তবে হালের কলকাতার ত্রিফলার সাজ আমার কাছে খানিকটা উগ্র প্রসাধন বলেই মনে হয় -সকলের তা মনে হতেও পারে। কলকাতার রাজপথের যেমন একটা হালকা ছবি আঁকলাম , সেরকম প্রতিটি গ্রামের , প্রতিটি শহরের একটি চরিত্র থাকে, থাকে সময় বিজড়িত ইতিহাস। তাই বেনারসের রাস্তা বলতেই চোখে ভাসে গলি খুঁজি , আসে ধর্মের ষাঁড় , এখানে ওখানে গজিয়ে ওঠা মন্দির। দিল্লির রাজপথের অনেকটাই দুধারে গাছে ঢাকা , কেতাবী মতে এই রকমের রাস্তাকে বোধহয় এভিনিউ বলে। মুম্বাইয়ের রাস্তার দুধারে শির উন্নত বহুতল – আবার ঝা চকচকে হায়াদ্রাবাদের জোড়া শহর সেকেন্দ্রাবাদের রাস্তায় লোকের ভিড় , চুড়ির টুংটাং , আতরের গন্ধ , আরো কত কী। আবার ফ্ল্যাশব্যাক, আবার ছোটবেলা। রাজপথ শুনশান , কার্ফু জারি। মাঝে মাঝে টহল দিচ্ছে সি আর পি বা পুলিশের দল। ছয় সাত বছরের আমি , ছোড়দির সঙ্গে , বড়রাস্তায় এক পা দু পা রেখেই পিছিয়ে দিটাং, মানুষের জিনে কি নিষেধ টপকানোর অদম্য ইচ্ছে বলেই ? গ্রাম মফস্বলে শহরের রোজকার জীবন ছেড়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে তে উঠে পড়লে আলাদা ছবি। শহর থেকে শহরান্তরে , বন্দর থেকে বন্দরে ছোটে সে রাস্তা। তরুণ বয়স্ক কপোত কপোতী , ছুটিতে বেরিয়ে পড়া ছোট পরিবার সুখী পরিবার , চোখে সানগ্লাস , হাতে স্টিলের বালা পরা উশৃঙ্খল যুবকের দল সকলের মনে অনাবিল আনন্দ , বল্গাহীন উল্লাস। মধ্যবিত্ত জীবন যাপনের যাবতীয় উপকরণ আমাজন ফ্লিপকার্টের দৌলতে এই হাইওয়ে দিয়েই ছুটে চলে দুর্বার গতিতে। শুধু ভীরু চোখে শিশুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে দরিদ্র গ্রাম্য বধূটি , ভীম গতিতে চলতে থাকা গাড়ির মাঝ দিয়ে রাস্তা পেরোবে কী করে ! সরকারী কাজে দিনে রাতে বিরোতে ঘুরতে হয়েছে ভারতের এদেশ ওদেশ অনেক প্রদেশের গ্রামের রাস্তায়। জায়গাগুলো, ট্যুরিস্ট স্পট যেমন পাত্রপক্ষের সামনে বিবাহযোগ্য কন্যার মত সেজে থাকে , তেমন নয়। দূরে দূরে গ্রাম , কখনো গ্রামের হাট, সব চোখে পড়ে , চোখে পড়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও ম্যাগি নুডলস কী কোক পেপসির বিজ্ঞাপন। হতদরিদ্র গ্রামগুলির মাঝ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই চোখে পড়ে বিরাট এক হাভেলি , হয়ত বা স্থানীয় বাহুবলী নেতা বাহাদুরের অথবা দোর্দন্ড প্রতাপ আমলার সপ্তাহান্তের প্রমোদ ভবন। একটু উন্নত প্রদেশ গুলিতে অবশ্য দুদিকেই পাকা বাড়ি , ইলেকট্রিক লাইট , ডিশ এন্টেনার রমরমা। আবার , পূর্ববর্ণিত হাইওয়ে ধরে যেতে যেতে পর পর দেখা মেলে সস্তার ধাবাগুলির , সেখানে গরম চায়ের পেয়ালা , ময়দা কি আটার পরোটার সঙ্গে হাড় সমেত মাংসখন্ড , আর সংলগ্ন পর্দা ঢাকা কুঠুরিতে নারী মাংসের নিষ্পেষণ ,’ খরচ করে চৌদ্দ সিকে’ ! পৃথিবীর আদিম পেশার রমরমা শুধু হাইওয়ের ধরে নয়। ইনভার্সিটি বেলায় দেখা আছে হাড়কাটা গলির দুধারে দেহ পসারিনীদের ভিড় – শিয়ালদা স্টেশনের দিকে যাওয়ার শর্ট কাট রাস্তা ছিল সেটি। দারিদ্র পীড়িত , বুভুক্ষার দেশ ভারতে এ দৃশ্য অবাঞ্ছিত হলেও অপ্রত্যাশিত নয়।, এ ব্যাপার শুনেছি সেক্স ট্যু রিজমের স্বর্গরাজ্য দক্ষিণ পুর্ব এশিয়া সম্বন্ধেও। কিন্তু যুঁজান ও সাংহাই , মহাচীনের জোড়া শহরের বিশেষ অংশে রাস্তার দুধারে দেহপোজীবিদের উপস্থিতি আমাকে চমকে দিয়েছে। গভীর রাত্রে গাড়ি নিয়ে গ্রাম টহলের অভিজ্ঞতা আছে আমার। আজকাল খুব অভিনব একটা জিনিস দেখা যায় – নিঝুম হয়ে পড়া গ্রামের মাঠে , ক্ষেতে বা কালভার্টের ধারে স দূরে দূরে দেখা যায় গোল হয়ে বসা আলোর বিন্দু। কাছে যেতে বোঝা যায় গোল হয়ে বসে একদল কিশোর বা তরুণের দল, সকলের হাতেই স্মার্ট ফোন , গভীর মনোনিবেশে তারা হয়ত নেয় সভ্যতার কিংবা অসভ্যতার সহজ পাঠ। লিখতে বসলে , চেতনার গভীরে জড়িয়ে থাকা আফ্রিকার কথা এসেই যায়। আমাদের দেশের রাস্তায় বাঁক বেশি , লোকালয়ের দাবি মেনে রাস্তা ইতি উ তি ঘুরে যায় নির্জনতার দেশে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরী হয় সোজা , দিগন্ত বিস্তৃত সোজা সে পথ। একটানা সে পথের দুধার বাওবাব গাছ , মাঝে মাঝে নিখুঁত পরিকল্পনায় যাত্রীদের খোলা আকাশের নিচে বিশ্রাম আহারের বন্দোবস্ত যখন একটা নিরাপত্তার ঘেরাটোপে নিয়ে আসে , তখনি শোনা যায় ,কেপটাউনের কাছে গাড়ি ছিনতাইয়ের দল হয়ত পিছু নিতে পারে , নৃশংস বুলেটে প্রাণ ঝাঁজরা করে হাতিয়ে নিতে পারে তারা গাড়ি। তখন বুক যতখানি কেঁপে ওঠে , রাস্তা বেয়ে চলার সময় পথ দুর্ঘটনার অভিজ্ঞান গুলো দেখেও বোধহয় এতটা ভয় হয় না। ভয় হয় না , লোবাটসের কাছে কৃষ্ণ সুন্দরীর গাড়ি থামিয়ে লিফ্ট নেওয়ার কথা শুনেও , বাড়ির অমতে জীবনসঙ্গীকে নিজের করতে না পেয়ে , সে নাকি আত্মহত্যা করে আর রাতে বিরোতে সুখী দম্পতিদের দেখলেই লিফ্ট নিয়ে সে নাকি আরোহীদের দুর্ঘটনার মুখে ঠেলে দেয়I তবে পাহাড় আর জঙ্গলের রাস্তায় ঘোরার রোম্যান্টিসিজম আলাদা। মনে পড়ে কোনো এক যুগলের নর্থ সিকিম আর দার্জিলিং কালিম্পঙের রাস্তা চষে বেরোনোর কথা – বিকল মিউজিক সিস্টেমের বদান্যতায় সঙ্গীর একের পর এক গান শুনতে শুনতে পাহাড় আর জঙ্গল বেয়ে চলা , এমন সে চলা , যাতে কোলের উপর যে কোন সময় ভুল নেমে আসতে পারতো , কিন্তু আসে নি, শুধু সম্ভাবনাটা জিই য়ে রেখেছে , আজীবন ? রোমাঞ্চ ভরা ভয় এই একই রোম্যান্টিকতার জুড়িদার। মনে পড়ছে , তুলি ব্লক নামক অনামী ফরেস্টে জন্দল সন্দর্শনে ফোর বাই ফোর গাড়িখানা কী অনায়াসে গাছের ডালের উপর দিয়েই রাস্তা বানিয়ে চলে যায় , দেশের জঙ্গলে এই অভিজ্ঞতা নেই ; বন বিভাগের গন্ডী কাটা রতা দিয়েই ট্যুরিস্ট দের গাড়ি গিয়ে থাকে। এ অভিজ্ঞতা নতুন, আরো নতুন গাড়ি ঘিরে ফেলা হায়নার মুখে ড্রাইভারের এক্সিলেটরে চাপ দেওয়া , আর তারসঙ্গে আমাদের হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানি। রাস্তা যোগায় আনন্দ, রাস্তায় পদে পদে ফেরে ভয়। রাস্তার কিছু স্মৃতি ভুলতে পারলে ভাল হত। ক্লাস ফাইভে এ পড়ার সময় বিসর্জনের মিছিলের সময় দেখা রাস্তায় চাপ চাপ রক্ত , কিংবা হ্যাবরণীর রাজপথে গাড়ির ধাক্কায় মত্ত এক তরুণের মাথা ধড় থেকে ছিন্ন হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য , যা বাড়িতে আজও বলতে পারি নি, আজও দুঃখ আর বিষাদ জাগিয়ে দেয়। একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ আর অনুভূতি ছেড়ে এবার রাস্তা নিয়ে একটু সাধারণ চর্চা করি। রাস্তা শব্দটি যতটাই আটপৌড়ে মনে হয় , পথ কথাটি কেমন যেন দার্শনিক দ্যোতনা নিয়ে আসে। আবার , রাস্তা বা রোড বললেই ক্রসরোডের প্রশ্ন এসে যায় , বহু পঠিত , বহু উচ্চারিত হলেও এসে পড়ে রবার্ট ফ্রস্টের সেই কবিতা –
Two roads diverged in a yellow wood, And sorry I could not travel both And be one traveler, long I stood And looked down one as far as I could To where it bent in the undergrowth; Then took the other, as just as fair, And having perhaps the better claim, Because it was grassy and wanted wear; Though as for that the passing there Had worn them really about the same, And both that morning equally lay In leaves no step had trodden black. Oh, I kept the first for another day! Yet knowing how way leads on to way, I doubted if I should ever come back. I shall be telling this with a sigh Somewhere ages and ages hence: Two roads diverged in a wood, and I— I took the one less traveled by, And that has made all the difference.
রাস্তার প্রসঙ্গে চলে আসে মানবতার কথা , ওঠে অমানবতারও। টালমাটাল পায়ে কলকাতার যীশু যদি বা মহা নগরীকে শিক্ষা দে মানবতার , এক অতিমারীতে অপ্রস্তুত এক সভ্যদেশে রাজপথে, গলিপথে জমে পড়া লাশ -অমানবতার লজ্জার এক ঐতিহাসিক দলিল হাজির করে , গলি বা রাজপথে নারী শরীরের উপর চড়াও হওয়া হায়নারা তেমনি সাক্ষ্য রাখে নৃশংসতার । পক্ষান্তরে , যদি বলা হয় , অল টি দ্য রোড্স্ লিড তো হোম , রামকৃষ্ণদেবের যত মত তত পথের কথা মাথায় আসতে পারে , আসতে পারে স্বপ্নালু বিপ্লবীর , বিপ্লবের পথের কথা , তার সঙ্গে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে অর্থনীতিবিদ কেইনিসের কথা , ইন হয় লং রান, উই আর অল ডেড!