রবিবার বিকালে ছুটি থাকায় বসে বসে রবি বাসরীয়টা পড়ছিলাম। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি এক অপরিচিত অশীতিপর বৃদ্ধ, মায়া ভরা মুখে দাড়িয়ে। অচেনা বলে আগমনের কারনটা জানতে চাওয়ার আগেই তিনি বললেন- ” আমি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, তুমি আমাকে চিনবেনা, আমি তোমার লেখার একজন গুনোমুগ্ধ পাঠক।” আত্মপ্রসাদ পেলে কার না ভাল লাগে, আবার সেটা যদি কেউ বাড়িতে বয়ে এসে দেয়। একটু খুশি হয়েই ভেতরে আসতে বললাম।
মুখোমুখি শোফায় বসে ভাবছি ওনার সাথে কি ভাবে কথা শুরু করব। আমার কিছু বলার আগে উনি বলা শুরু করলেন-“তুমি বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট বলে ‘তুমি’ সম্বোধন করলাম, কিছু মনে কোরোনা।” আমি ভরসা দিয়ে ওনার বক্তব্য বিষয় জানতে চাইলাম। উনি বললেন -” তোমার কাছে আমি একটা আর্জি নিয়ে এসেছি। — অবশ্যই, বলুন। — সেটা বলবার আগে আমার পরিচয় দিয়ে নেই। আমি এক সময় প্রুফ রিডার ছিলাম। বাজারে কম্পিউটার এসে যাওয়ায় আমার কাজটি চলে যায়। নিজেকে বর্তমান পরিস্থিতির উপযুক্ত করে নিতে উদ্যোগী হয়েওছিলাম,কিন্তু ততদিনে আমি নার্ভের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। আমার হাতের আঙুল গুলো দ্রুত কাঁপতে থাকল। ফলে কম্পিউটারের মাউস অপারেট করা আমার পক্ষে সম্ভব হলনা। যাইহোক তখন থেকেই কর্মহীন হ’য়ে গেলাম। এবার বলি, তোমার কাছে যে জন্য আসা। আমি যখন প্রুফ রিডারের কাজ করতাম তখন অনেক বিখ্যাত লেখকদের প্রুফ চেক করেছি। বড়বড় লেখকদের গল্প পড়তে পড়তে আমার মাথায় একটা গল্পের ভাবনা জন্মেছিল। কাল হল আমার হাতের আঙুল কাঁপা। আমি আর সেটা গল্পের আঙ্গিকে আনতে পারিনি। আমার ইচ্ছা তুমি তার সম্পূর্ণ রূপ দাও। আমি ইতস্তত করে জানাই যে, আমি কি তাঁর ইচ্ছার সম্পূর্ণ রূপ দিতে পারব!! তিনি জোর দিয়ে বললেন-” অবশ্যই পারবে, তুমি যে লেখার দ্বিতীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছ।” লেখার দ্বিতীয় পর্যায়ে কথাটা শুনে একটু অবাক হয়ে কথাটার অর্থ জানতে চাইলাম। তিনি একটু মৃদু হেঁসে বললেন-” দেখ সব মানুষের মধ্যেই কমবেশি কল্পনা শক্তি আছে,তবে সবাই লেখক হতে পারেনা। প্রতি দশলক্ষ কল্পনা প্রবণ মানুষের এক শতাংশ অর্থাৎ দশ হাজার মানুষ তার কল্পনাকে লিখে প্রকাশ করতে পারে। সেই এক শতাংশের এক শতাংশ অর্থাৎ একশ মানুষ হয় লেখক। সর্বোপরি ওই এক শতাংশের এক শতাংশ অর্থাৎ একজন হয় খ্যাতিমান লেখক। হিসাবটা আমার বেশ ভাল লাগল। বুঝলাম ওনার বিচারে আমি লেখনি শৃঙ্খলের কোন পর্যায়ে আছি। এরি মধ্যে আমার অর্ধাঙ্গিনী দুই কাপ ধূমায়িত কফি এনে টেবিলে রাখতেই, ভদ্রলোক সহাস্যমুখে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন- ” নিশ্চয়ই বৌমা?” আমার স্ত্রী ওনাকে প্রণাম করতেই আশীর্বাদের হাত তুলে বললেন-” দীর্ঘায়ু হও মা,আমি বলছি তোমার স্বামী অনেক দূর এগোবে।” অর্ধাঙ্গিনীর প্রস্থানের পর কফির কাপটা ঠোঁটে ঠেকিয়ে বললেন—” আঠারো শতকের মধ্যবর্তী কাল থেকে ঊনিশ শতকের প্রথম দিকের একটা সময়। সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ সরকার নির্ঝঞ্ঝাটে খাজনা আদায়ের লখ্যে জমিদারি বন্দোবস্তের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। জমিদারের হাতে দেওয়া হত যোগ্যতাহীন ক্ষমতা। বৃটিশ গভর্মেন্টের খাজনা আদায় হলেই জমিদারের সাত খুন মাপ, বৃটিশ সাম্রাজ্যে ছিল তাদের কথাই শেষ কথা। ফলে জমিদারেরা হয়ে উঠেছিল অহংকারী, স্বেচ্ছাচারী, অত্যাচারী, শোষণ করা শাসক। পাশাপাশি সেই সময় সমগ্র ভারতবর্ষ ছিল জাতপাতের করাল গ্রাসে জর্জরিত। সমগ্র ভারত তথা বাংলার ব্রাহ্মণ সমাজে জাতপাতের তমসা তখনো এতটাই প্রকট ছিল যে, হিন্দু ধর্মের মানুষের সাধারন জীবনযাপনে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয়েছিল। ব্রহ্মণরা ছিল এ সবের পুরোধা। কুলীন ব্রাহ্মণরা তো পান থেকে চুন খসতে দিত না। নিজেদের কৌলিন্য রক্ষার্থে তাঁরা পরিবারের সর্বনাশ করতেও পিছপা হতেন না। সে শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত কুলিন হোক বা অশিক্ষিত গরীব কুলিন। সেই সময়ের পটভূমিতে আমার এই গল্প—-
(১)
জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরীর এক মাত্র কন্যা বিন্দুবাসিনির বিয়ে। স্থির হয়েছে পার্শ্ববর্তী জমিদার আনন্দভূষণ রায়ের এক মাত্র পুত্র দেবভূষণ রায়ের সথে। দুই জমিদারিতে উৎসবের সমারোহ। চারদিকে সাজোসাজো রব। বিবাহ উপলক্ষে দুই জমিদারির গরীব প্রজাদের সব চাইতে বড় প্রত্যাশা দিন কয়েক কব্জি ডুবিয়ে ভোজন। দুর্গাপূজায় জমিদারেরা নরনারায়ণ সেবা করান বটে, তবে এ ভোজের মাত্রাই আলাদা রকম হবে। প্রজারা সব শুভদিনের আপেক্ষায় দিন গুনছে।
অবশেষে অপেক্ষার দিন শেষ। জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরীর প্রাসাদে আত্মীয় অভ্যাগতদের ভিড়ে গমগম করছে। ভোর হতেই নহবতে সানাইয়ের সুর চারদিক মুখরিত করে তুলল। এ-কি আর সাধারণ প্রজার বাড়ির বিয়ে! এ হল, জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরীর এক মাত্র কন্যা বিন্দুবাসিনির বিয়ে, যেখানে নিমন্ত্রিতদের তালিকায় আছেন ইংরেজ সাহেবরা। তাদের জন্যে আবার দেদার ফুর্তির আয়োজনও করা হয়েছে। বাইজী নাচ, ঠুংরি টপ্পা, সুরাপান, কি নেই এখানে। জদিও গরীব প্রজাদের তাতে কোন প্রকার মাথাব্যথা নেই। রন্ধনশালার নির্গত সুগন্ধে তারা মাতোয়ারা, কখন শুরু হবে পেট ভরে ভোজন। ব্রজনারায়ন চৌধুরীর জমিদারিতে কয়দিন উনুন জ্বলবে না। গোধূলিলগ্নে বিয়ে, মধ্যাহ্নের মধ্যবর্তী সময়, হঠাৎ করে সব যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। নহবতের সানাইয়ের সুরের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জমিদার বাড়ির ভিতর পিন পড়লে শোনা যায় এমন নিঃস্তব্ধতা। সকলে অবাক বিশ্ময়ে জানতে চাইছে, হঠাৎ কি এমন ঘটল। পাত্রপক্ষ অর্থাৎ জমিদার আনন্দভূষণ রায়ের বাড়ি থেকে লোকজন আশীর্বাদক তেল হলুদ নিয়ে আসার কথা। তাঁরা এলেন, তবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নয়, নিঃশব্দে। পাত্র পক্ষের পাঁচজন প্রতিনিধি জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরীর সামনে এসে যে সংবাদ পরিবেশন করলেন তাতে জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন তাঁকে না ধরে ফেললে হয়তো তখনি তিনি সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হতেন। সংবাদ যে অনভিপ্রেত। এমন অকাল বিপর্যয় যে দুই পরিবারের উপর বজ্রাঘাত করবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। জমিদার আনন্দভূষণ রায়ের একমাত্র পুত্র, পাত্র দেবভূষণ রায় কলেরায় পাঁচ ছ’দিন যমে মানুষে টানাটানির পর আজই মধ্যাহ্নে —-। একটু ধাতস্থ হয়ে ব্রজনারায়ন চৌধুরী ভাবলেন তাঁকে ভেঙে পড়লে চলবে না। তিনি যদি এমতাবস্থায় হাল না ধরেন তাহলে একমাত্র কন্যার কি উপায় হবে! কন্যা লগ্নভ্রষ্টা!!! ভাবতেই পারছেন না। মনে দৃঢ়তা এনে প্রথমে পাত্রপক্ষের অতিথিদের বিদায় জানান। তারপর গৃহের মহিলাদের ভেঙে পড়তে নিষেধ করেন। রায়নার জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরী এত সহজে ভেঙে পড়ার মানুষ নন। কুলিন ব্রাহ্মণ কন্যা লগ্নভ্রষ্টা হওয়া যে মহাপাপ। জমিদারিতে অরাজকতা আসবে। উপস্থিত কয়েকজন গুরুস্থানীয় ব্যাক্তিকে নিয়ে তিনি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে বসলেন।
বিন্দুবাসিনি পাত্রপক্ষের গৃহ হতে তেল হলুদ আসার অপেক্ষায় ছিলেন। সেই জায়গায় এল এক মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। চিত্তে সঞ্চিত তার বহু দিনের স্বপ্নগুলো কাঁচের ঘরের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ছুটে গৃহে প্রবেশ করে সে খিলান দিয়ে দিল। বৃদ্ধা ঠাকুমা সকলকে সতর্ক করে বললেন-” ওকে একটু একা থাকতে দাও।” ইংরেজির মতো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও মূলত বিন্দুবাসিনি বাঙালি কুলিন ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে, রক্তে তো সেই পরম্পরার স্রোত বইছে। সমাজ, অসহায় পিতা এবং তার ভবিতব্যের কথা ভেবে বালিশে মুখ গুজে সে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
রাম সিং আর মাধো সিং পাঁচ জন পেয়াদা নিয়ে চিরুনি তল্লাশি শুরু করল। জমিদারি এবং তার বাইরে সমস্ত ব্রাহ্মণ বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিল। তাছাড়াও পথে কুড়ির থেকে পঁচিশ বৎসরের যুবক দেখলেই কাছে গিয়ে সুধায়- “নাম কি? গোত্র কি?” ঘণ্টা তিনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা বামুনের ছেলে পাওয়া গেল না, তা আবার কুলিন বামুন! সন্ধ্যা হয় হয়, এমতাবস্তায় রাম সিং, মাধো সিং দলবল নিয়ে ফিরে যাবে কিনা ভাবছে, হঠাৎ নজরে পড়ল রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একজন তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতে তারা দেখল বছর কুড়ির এক যুবক, গায়ে মলিন পোশাক, পেটানো শরীর হলে কি হবে কালো ময়লায় ভর্তি, গায়ের ফর্সা রঙ কালো ছোপছোপের ভিতর দিয়ে উঁকি মারছে। যুবকে ঘিরে ধরে রাম সিং শুধালো -” নাম কি?” হঠাৎ করে পথিমধ্যে ঘিরে ধরায় যুবক একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে-” ফণীভূষণ চক্রবর্ত্তী।” — গোত্র? — শাণ্ডিল্য। — (শরীরের দিকে তাকিয়ে) কি কাজ করা হয়? — কয়লা খাদানে কাজ করি। মাধো সিং বলল-” কাজের ব্যাপারে আমাদের প্রশ্ন করার হুকুম নেই।” রাম সিং বলল-” চলো আমাদের সাথে। যুবক অবাক হয়ে বলল- “কোথায় যাব?” — গেলেই জানতে পারবে। যুবক পেয়াদা দেখে বুঝতে পারল জমিদারের লোক, কিন্তু কি অপরাধে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটাই সে বুঝতে পারছে না। বাবা যক্ষা রুগী, মা গৃহবধূ, বাড়ি থেকে বের হননা। জমি জমাও নেই। অর্থ রোজগারের নিমিত্তে সূর্য উদয় থেকে অস্ত অবধি অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। বাইরের জগৎ থকে তাদের পরিবার সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তাহলে তার অপরাধ!!!
যুবককে জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরীর সম্মুখে হাজির করা হল। তিনি একটু তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যুবকের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে রাম সিং, মাধো সিং এর সাথে মৃদুস্বরে কিছু কথা বলে একটু স্বস্তির হাসি হেসে বললেন-” যাও একে স্নান করিয়ে, নুতন পোশাক পরিয়ে আনো, হাতে সময় খুব কম।” যুবক ফণীভূষণ চক্রবর্ত্তী গরীব, কিন্তু পাগল তো নয়। দেখতে পাচ্ছে জমিদার বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। কিন্তু তাকে নিয়ে এই আচরণের কারন না জানানোয় সে রীতি মতো অবাক হয়ে জমিদার বাবুকে সরাসরি তাকে ধরে নিয়ে আসার কারন জিজ্ঞেস করলেন। জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরী এই মুহূর্তে অনেকটাই নিশ্চিন্ত, যে ঘটনাটা ঘটতে চলেছে সেটা এবার যুবককে জানানো উচিত বলে তিনি মনে করেন। তিনি যুবককে বললেন-” যাও আগে স্নান সেরে নুতন পোশাক পরে এসো তারপর সব কথা বলছি।” যুবক ফণীভূষণ চক্রবর্ত্তী কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করে-” আমাকে নিয়ে কি করতে চান সেটা আমাকে আগে বলুন!” জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরীর মুখের উপর এই ভাবে কথা বলার সাহস তাঁর জমিদারিতে কারোর নেই। তবুও নিজেকে তিনি যারপরনাই সংযত করে কুলপুরোহিতকে সবিস্তারে বলবার নির্দেশ দিলেন। কুলপুরোহিত এগিয়ে এসে বললেন-” দেখ বাবা,আজ জমিদারবাবুর কন্যা বিন্দুবাসিনির বিবাহ, কিন্তু ঈশ্বরের নির্মম অলঙ্ঘ্য নির্দেশে বিন্দুবাসিনির হবু স্বামী আজ মধ্যাহ্নে কলেরায় ইহলোক ছেড়ে চলে গেছেন। এক্ষণে বিবাহের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম প্রস্তুত, ফলত মা বিন্দুবাসিনী যে লগ্নভ্রষ্টা হবে। তুমি কুলীন ব্রাহ্মণ, অথএব তুমিই পার বিন্দুবাসিনিকে এই পরিস্থিতি থেকে অব্যাহতি দিতে।” ফণীভূষণ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল-” কিন্তু আমি যে গরীব মানুষ, তেমন কোনো কাজকর্ম করিনা, দুস্থ পরিবার।” এবার ব্রজনারায়ন চৌধুরী সদম্ভে বললেন-” ওই বিষয়টা তোমাকে ভাবতে হবে না। ওটা আমি বুঝে নেব।” ফণীভূষণ চক্রবর্ত্তী আরো অবাক হয়ে বললেন-” কিন্তু আমার পিতামাতা?? তাঁদের তো——” ব্রজনারায়ন চৌধুরী একটু বিরক্ত হয়ে যুবককে থামিয়ে বললেন -” বললাম তো, তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না। সময় মতো আমি জানিয়ে দেব। এই, (পাইকদের উদ্দেশ্য করে) তোমরা যাও ওকে স্নান করিয়ে নুতন পোশাক পরিয়ে নিয়ে এসো।”
পুনরায় বেজে উঠল নহবতের সানাই, জ্বলে উঠল বেলোয়ারী ঝাড়বাতি গুলো। যেন ক্ষণিকের জন্যে সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রজাদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যেতে লাগল। ক্লান্ত দিনের সূর্য ডুবে আনন্দমুখর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। চারদিক আতসবাজির রোশনাইতে ভরে উঠল। বিন্দুবাসিনী চাঁদের ন্যায় অপরূপা কনে সাজে সজ্জিতা হ’য়ে দো’তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিংহ দুয়ারের দিকে পলকহীন নেত্রে চেয়ে রইল। অবশেষে আসল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সফেদ হাতির ডাক যেন সব কিছুকে খানখান করে এগিয়ে আসতে থাকল। তিন তিনটে সফেদ হাতি, প্রথমটায় তাঁর জীবন সঙ্গী উপবিষ্ট। পরের হাতি দুটোয় বর পক্ষের কয়েকজন। হবু বর হাতি থেকে নেমে দাঁড়াল। জমিদার বাড়ির অগুনতি সধবারা বরণ ডালা নিয়ে শঙ্খ এবং উলুধ্বনি সহযোগে এগিয়ে আসতে থাকল। বাহারি পোশাকে সজ্জিত দু’জন ষোড়শী বরের দুই পাশে দাঁড়িয়ে গোলাপের পাপড়ি ও গোলাপ জল ছড়িয়ে চামর দোলাতে লাগল। মুগ্ধ হয়ে বিন্দুবাসিনী দু’চোখ ভরে দেখতে থাকল। ঈশ্বরের অপার কৃপায় তার এমন রাজসিক বিবাহ সম্পন্ন হতে চলেছে।
ঠক্ ঠক্ ঠক্ শব্দে বিন্দুবাসিনী অপূর্ণ নিদ্রা ভঙ্গ হল, চমকে বিছানায় উঠে বসলেন। দরজার অপর প্রান্ত থেকে মহিলা কন্ঠের ডাক-” বিন্দু দরজা খোলো মা, তোমার বাবা কি তোমার সর্বনাশ দেখতে পারেন! তিনি সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছেন। এখন তুমি প্রস্তুত হলেই বিবাহ কার্য শুরু হবে।” বিন্দুবাসিনী চোখ কচলে পালঙ্ক থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে দরজার খিলান খুলল।
বিবাহে বসার আগে বিন্দুবাসিনী আড়াল থেকে ফণীভূষণকে দেখে নিয়ে তার প্রধান পরিচারিকার কাছে তার সম্পর্কে জানতে চাইল। এবং ফণীভূষণের মতো কুলিন ব্রাহ্মণের পারিবারিক পরিচয় জানার পর তার উৎফুল্ল মনটা এক নিমেষেই মুষড়ে পড়ল। এর থেকে তো লগ্নভ্রষ্টা রমনী হয়েই বেঁচে থাকা ভাল ছিল। এই প্রাসাদ্যোপম অট্টালিকা ছেড়ে সে যাবে ওই কুলিন বামুনের খড়ের চালায়! দুই বেলা হাত পুড়িয়ে কাঠের জ্বালে রান্না! নিন্ম মানের খাদ্য বস্ত্রে অতি কষ্টে দিন যাপন!! মনটা বিষন্নতায় ভরে উঠল, কিন্তু বাবার সম্মুখে মনের কথা বলবার সাহস কই তার!!
‘সাতমন তেল পুড়ল,রাধাও নাচল’,আসলে কি হল ??? নাচ,গান,খানা,পিনা সব হল। নিষ্ঠাভাবে মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সাতপাকে বেঁধে বিয়ে হল।চারহাত একত্রিত হল, দুটো মন কি একত্রিত হল??? বলবে সময়।
বিন্দুবাসিনির অনিচ্ছার কারণে বাসর জাগা হল বটে, তবে সমবয়সী বন্ধুবান্ধব আত্মীয় সজন নিয়ে নয়,স্রেফ বর কনে। একতলায় প্রশস্ত একটা কক্ষ, যার মাঝখানে আছে সিঁড়ি ওয়ালা একটা মেহগনি কাঠের পালঙ্ক। সেই পালঙ্কে অবিন্যস্ত কুন্তলে, রক্তিম ললাটে, ছিন্নভিন্ন পুষ্পক সজ্জায় তেজস্বিনী বিন্দুবাসিনী চুপ করে বসে রইল। আসবাবপত্রে সুসজ্জিত সেই কক্ষের আর একটি প্রান্তে জড় পদার্থের মতো ফণীভূষণ চক্রবর্ত্তী উত্তাপ হীন অবস্তায় একটা কেদারায় বসে রইল। কারোর মুখে কোনো কথা নেই, দুজনেই নিরব থেকে যেন ভবিষ্যতের বোঝাপড়াটা করে নিতে চাইছে। সাক্ষী থাকল ঘরের দেওয়ালে টানানো জমিদারদের মৃগয়া করে আনা হরিণের মাথা গুলো। ফণীভূষণ বুঝতে পেরেছে যে বিন্দুবাসিনী তাকে মন থেকে গ্রহন করেননি। করবেনই বা কেন! কোথায় জমিদারের একমাত্র শিক্ষিতা সোহাগি কন্যা বিন্দুবাসিনী আর কোথায় কয়লা খাদানের হতদরিদ্র শ্রমিক ফণীভূষণ। কিন্তু এই বিবাহ তো তার অমতেই দেওয়া হয়েছে। জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরীর জামাতা হয়ে তার মন সামান্যতমও পুলকিত নয়,যতটা চিন্তিত তার অসুস্থ বাবা মাকে নিয়ে। এই মধ্য রাত্রিতে তাঁরা হয়ত পুত্র ঘরে না ফেরার জন্য দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় চোখের পাতা এক না করে তার আসায় পথ চেয়ে বসে আছেন। বিন্দুবাসিনী দুই হাটুর মধ্যে মুখ গুজে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ভাবতে থাকে, বাবা তাকে মেরে বাঁচিয়ে রাখল। কৌলিন্য রক্ষার্থে এক কুলির সাথে তার বিয়ে দিলো। (আড় চোখে ফণীভূষণের দিকে এক পলক চেয়ে দেখে ভাবল), ফণীভূষণ এমন ভাবে চুপচাপ বসে আছে যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেনা। পাজির পা ঝাড়া,বাবা বলল আর সুবোধ বালকের মতো বিয়ে করে নিল। মুখে ভয়ের ভাব এনে মনে সম্পত্তির লোভ। ফণীভূষণ চুপ করে কেদারায় বসে থাকায় বিন্দুবাসিনির রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। মিনিট দশেক দুজনে চুপচাপ থাকার পর বিন্দুবাসিনী তির্যক মন্তব্য করে বসল-” কেন আপনি এই বিয়েতে রাজি হলেন?” — আমার আর কি’বা করার ছিলো। যতটা সম্ভব আপনার বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। — অর্থাৎ প্রতিবাদের ভেক ধরে কার্যোদ্ধার। — আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আজ আমি প্রথম বাবা মাকে না জানিয়ে কোন ব্যাক্তিগত কাজ করতে বাধ্য হলাম। এই কার্য সম্পাদনে আমার অন্তরাত্মা সাড়া দেয়নি। — বৈভবের মোহে আপনি কি একেবারেই আকৃষ্ট হননি?? — না, আমি রাজি না হলে আপনার পিতা আমাকে বন্দী করেই এই বিবাহ দিতেন। আমাকে ছাড়তেন না। আমি বাড়ি না ফিরলে আমার যক্ষাগ্রস্থ পিতা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু মুখে পতিত হবেন। অসহায় মা সেটাই চাক্ষুষ করে নিজে অনাহারে, স্বামী-পুত্র শোকে নিজের জীবনকে বলিদান দেবেন। ষোড়শী বিন্দুবাসিনী মস্তিষ্ক তখনও কোনোভাবে শীতল হয়নি। ফণীভূষণের সমস্ত বক্তব্য-ই তার কাছে সুযোগের সদ্ব্যবহার মনে হল। এবং সেই মুহুর্তের ভাবনা যেটা মনটাকে তোলপাড় করে দিচ্ছে তা বলে ফেলল—” বেশ,সমস্ত কিছুই যদি আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয় তো আপনি নিশ্চই মুক্তির পথ খুঁজছেন?” — যদি খুঁজি, তবে সেই কঠিন, কঠোর, সর্বনাশী পথটা আমাকে কে বলে দেব?? — যদি আমি বলে দেই? — (রীতিমতো অবাক হয়ে) আ-প-নি!! — প্রজাপতি ঋষির কাছে ক্ষমা চেয়ে বলছি, এমন বিবাহ সুখ আমি অন্তর থকেই ত্যাগ করতে চাই। — বলুন আপনার কি ইচ্ছা? — আপনার ঠিক পিছনে যে দরজাটা আছে ওটা খুললে বাড়ির পিছনের পথ পড়বে। নিশুতিরাতে সকলে নিদ্রামগ্ন, এই সময় চলে গেলে কয়েকটি নিশাচর প্রাণী ছাড়া কেউ টেরও পাবেনা। এতক্ষণের কথোপকথনে ফণীভূষণ বিন্দুবাসিনির মনের কথাটা পরিষ্কার বুঝে ফেলেছে। ফলে নিজের ভবিতব্যের কথা না ভেবে বিন্দুবাসিনির উদ্দেশ্যে বলল-” আপনি আমার সম্পর্কে যে ধারনা পোষণ করেছেন সেটা আপনার একেবারেই নিজস্ব ভাবনা। তবে প্রজাপতি ঋষির সম্মুখে অগ্নি সাক্ষী রেখে মন্ত্রপাঠের মধ্যদিয়ে আমরা বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছি। এটাকে তো আর কোনো ভাবে অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমানে আপনি আমার অর্ধাঙ্গিনী, অধিকারে নয় কর্তব্যের দৃষ্টিকোন থেকে বলছি – আপনি ভাল থাকুন। সমস্ত ঘটনার জন্যে আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।” কথাগুলো বলে ফণীভূষণ চক্রবর্ত্তী পেছনের দরজার খিলান খুলে অতি সন্তর্পণে বেরিয়ে গেলেন।
মনসামঙ্গল কাব্যে বাসর ঘরে বেহুলা নিদ্রা জাগরনের মধ্যদিয়ে লখিন্দরের অভিশপ্ত জীবন রক্ষা করার আপ্রান চেষ্টা করেছিলেন। আর এখানে বিন্দুবাসিনী স্বেচ্ছায় ফণীভূষণকে বাসর ঘর থেকে বহিষ্কার করে বাবার কৌলিন্য মানসিকতা প্রতিশোধ নিলেন। অভিমান আর কর্তব্যের লড়াইয়ে জিত হল অভিমানের।
যক্ষারোগগ্রস্ত চারু চক্রবর্ত্তী শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করেও স্ত্রী বিভাদেবীর কাছে বারবার খোঁজ নিচ্ছেন পুত্র ফণীভূষণ বাড়িতে ফিরেছে কিনা। অসুস্থ চারু চক্রবর্ত্তীকে বিভাদেবী এটা ওটা বলে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। — (কাশতে কাশতে) তুমি বলছ রাত বেশি হয়নি, অথচ চন্দ্র যে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। — তুমি ঘুমাও, ওটা তোমার চোখের ভুল। — না,গিন্নি না,চোখের ভুল হতে পারে, মন তো ভুল করবে না। ফণীর ফেরার সময় যে অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। কোনো বিপদাপদ হলনা তো!!! — কি বিপদ হবে,অলক্ষুণে কথা বলোনা তো। মুখে তিনি অসুস্থ চারু চক্রবর্ত্তীকে সান্তনা দিচ্ছেন বটে, মনতো তার-ও একই কথা বলছে। সেই ভোরে সূর্য উঠতে না উঠতে এক মুঠো পান্তা খেয়ে বেরিয়েছে। সারাদিন কয়লা খাদানে হাড়ভাঙা খাটুনি। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, এত রাত হল। কোথায় গেল ছেলেটা!! স্বদেশী আন্দোলনে ঢুকে পড়ল না তো!!
হঠাৎ চাপা স্বরে -” মা,মা, দরজা খোল।” — ওই বোধহয় ফণী এল। বিভাদেবী দরজা খুলতেই চমকে উঠলেন। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। শরীরে গরদের ধুতি পাঞ্জাবী। কপালে চন্দনের সাজ।শরীর থেকে আতরের সুমধুর গন্ধ বেরিয়ে চারদিক ম-ম করছে। আবাক হয়ে বিভাদেবী জিজ্ঞেস করলেন- ” কিরে কোথায় গিয়েছিলি? কে দিল তোকে এত দামি পোশাক? তাছাড়া কেনই বা দিল।” ফণীভূষণ মা’কে চুপ করতে বলে ঘরে ঢুকে দরজা দিল। তারপর বাবা মাকে সবিস্তারে সমস্ত ঘটনাটা বলল। চারু চক্রবর্ত্তী ভয় পেয়ে চমকে উঠে বললেন-” তুমি করেছ কি? তুমি তো বিষধর সাপের ল্যজে পা দিয়ে ফেলেছ।” ফণীভূষণও ক্ষোভে বিস্ফারিত হয়ে বলল-” কি করবে ওই ব্রজনারায়ন চৌধুরী, দেশে কি আইন আদালত নেই? — আছে,তবে সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এই মুহূর্তে আমাদের কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। তা-না হলে সকালেই জমিদারের লেঠেল বাহিনী এসে আমাদের উপর অত্যাচার শুরু করবে। মনে রেখ, তুমি কেন পালিয়ে চলে এসেছ সেটা মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হল, তুমি ব্রজনারায়ন চৌধুরীরকে না জানিয়ে পালিয়ে চলে এসেছ। এটা তাঁর কাছে চরম আত্মসম্মানের ব্যাপার। নুন্যতম সময় অপচয় না করে অতি তৎপরতার সাথে নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে এক কাপড়ে রাতের অন্ধকারে তিনজন কাক পক্ষীকেও টের না পেতে দিয়ে স্বেচ্ছায় গ্রামছাড়া হল।
ফণীভূষণ ঘর থেকে যে বেরিয়ে যাবে,সেটা বিন্দুবাসিনী বুঝে উঠতে পারেনি। এমতাবস্থায় তার মনে প্রশ্ন জাগল, ঝোঁকের বসে কাজটা করে সে কি ঠিক করল?? এমন একটা অসহনীয় ঘটনায় অভিমান করে সে যদি কয়েকটি কটু বাক্য প্রয়োগ করে, তাই বলে ——। বিন্দুবাসিনী অনুধাবন করল, সে ফণীভূষণ সম্পর্কে যা-যা ভেবেছিল সবই মিথ্যা ছিল। সে গরীব হতে পারে কিন্তু নির্লোভী আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন মানুষ। বিন্দুবাসিনির কচি হৃদয় এক অজানা আতঙ্কে ধুকপুক করতে থাকল। এক্ষণে তার মনে হল, সে বোধহয় বড় ভুল করে ফেলেছে। ফলে রাতের বাকি সময় বিন্দুবাসিনী দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না।
সকাল হতে না হতেই জমিদার বাড়িতে কন্যা শ্বশুরালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি কার্য শুরু হয়ে গেল। বাবার ভয়ে বিন্দুবাসিনী তার মায়ের কাছে গত রাতের ঘটনা হুবহু বর্ননা করল। যতই ঘটনাটি গোপন রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন, দাবানলের মতো তা হুহু করে ছড়িয়ে পড়ল। জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরী রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সমস্ত লেঠেল,পেয়াদা বাহিনীকে একত্রিত করে হুকুমজারি করলেন -” পাঁচ ঘন্টার মধ্যে ফণীভূষণকে হাজির করতে হবে। আমার এলাকা,এমন কি অন্য জমিদারের এলাকাতে গিয়ে চিরুনি তল্লাশি চালাবে।” লেঠেল এবং পেয়াদা বাহিনী বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে বার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় জমিদার গিন্নী এসে লেঠেলদের উদ্যোগে বাধা দিয়ে জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরীরকে সমস্ত ঘটনা বলে জানিয়ে দিলেন, ফণীভূষণ আসলে দোষী নয়। ঘটনা যা ঘটেছে তা হল বিন্দুবাসিনির মতিভ্রম। ব্রজনারায়ন চৌধুরী সমস্ত ঘটনা অবগত হয়ে একটু শান্ত হলেন বটে, তবে হাল ছাড়লেন না। লেঠেলদের চারদিকে খোঁজ খবর করে ফণীভূষণের পরিবারকে স্বসম্মানে তাঁর সম্মুখে হাজির করার হুকুম দিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সমস্ত দিনটাই তন্নতন্ন করে খোঁজাখুঁজির পর হতাশ হয়ে পেয়াদারা সকলেই শূন্য হাতে ফিরে আসল।
(২)
বারো বছর পর —- খোকা কাল অষ্টমী, বেশ কয়েক বছর হল মা দুগ্গার মুখদর্শন করতে পারিনি। সে-ই কবে তোমার বাবা বেঁচে থাকতে শেষ বার কানাই মন্ডলের গরুর গাড়ি করে তোমার বাবাকে নিয়ে জমিদার বাড়ির দুগ্গা প্রতিমা দর্শন করে এসেছিলাম। — বেশ তো চলুন, কালই আপনাকে মাদুর্গা দর্শন করিয়ে আনি। — পাঁচির মা’র কাছে শুনলাম, এবার নুতন জমিদার মহা ধুমধাম করে মা দশভুজার আরাধনা করছেন। — ঠিকই শুনেছেন, আগের জমিদার দেনার দায়ে সময় মতো ইংরেজ সরকারকে খাজনা না দিতে পারায় জমিদারি ভিন গাঁয়ের জমিদারের হাতে চলে গেছে। যার জন্য গত দুবছর নমোনমো করে পুজো হয়েছে। এই খবর শুনে নুতন জমিদার তাঁর জমিদারির সমস্ত প্রজাদের নিমন্ত্রণ করে দুর্গা পুজোয় সামিল হতে বলেছেন। — তা হলে দেখো না বাবা, কানাই মন্ডলের গরুর গাড়িটা পাওয়া যায় কি-না! বৃদ্ধা মাকে প্রতিমা দর্শন করানো যে তীর্থ ভ্রমণ করানোর পুণ্যের সমান সেটা বুঝে ফণীভূষণ কানাই মন্ডলের বাড়ি গরুর গাড়ি ঠিক করতে যেতে উদ্যত হল। বিভাদেবী পুত্রের মন মানসিকতা বুঝে বললেন-” খোকা ও পাড়ার পারুলের মা বলছিল পারুলের কথা।” — কি কথা? — বড় ভাল মেয়ে,বয়স কম, স্বাস্থ্যবতী, নামেই বিধবা, পারুল স্বামির ঘরই করেই-নি। আট বছরে বিয়ে হল, তারপর বাপের বাড়ি থেকে পড়াশোনা করত। চোদ্দো পনেরো বছর বয়স হলে শ্বশুর বাড়ি যাবে। সেই সুখ অভাগীর কপালে সইল না, তার আগেই স্বামীটা মোলো। — জানি তো, পোড়া দেশে এর থেকে ভাল আর কি হবে!! ‘পেটে নেই ভাত, মেতে আছে নিয়ে জাতপাত।’ — বলছি কি, অভাগীটাকে আমরা কি একটা সংসার করার সুযোগ দিতে পারি না!! আমার বয়স হয়েছে, কবে আছি কবে নেই। আমার অবর্তমানে তুমি কি ভাবে থাকবে!! — দেখ মা, আমি বিবাহিত, জীবনের সবচেয়ে খারাপ স্মৃতিটাকে আমি আর স্মরণ করতে চাই না। সব থেকে বড় কথা, আমরা সমাজের প্রান্তিক মানুষ, ‘দিন আনি দিন খাই’, সমাজের রক্ষাকর্তা নই। বাদ দাও ওসব কথা। আমি কানাই কাকার বাড়িতে চললাম।
জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে লোকে লোকারণ্য। জনসমুদ্রে মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকু নেই। অনেক দূরে গরুর গাড়ি দাঁড় করিয়ে মাকে শক্ত করে ধরে ফণীভূষণ শম্বুক গতিতে প্রতিমার কাছে এলেন। তাঁদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল, কারণ ঠিক তখনি অষ্টমী পূজার পুষ্পাঞ্জলি শুরু হল। ফণীভূষণ প্রাণ ভরে দ্বিভুজা মা’কে নিয়ে দশভুজা মাকে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করলেন। পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর মা দুর্গার কাছে ফণীভূষণ প্রার্থনা করে বলল-” মাগো তুমি তো জানো, মা ছাড়া এ জগতে আমার আর কেউ নেই। শুধু মা’কে সুস্থ রেখ, যেন প্রতি বছর এসে তোমার চরণে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করতে পারি।” পুষ্পাঞ্জলি শেষ হতে না হতেই হাজার ঢাকের আওয়াজ চারদিক মুখরিত করে তুলল। তারি মধ্যে বিহারি পেয়াদারা হেঁড়ে গলায় হাঁকতে থাকল-” সকল প্রজাদের জানানো হচ্ছে, আপনারা নাচঘর প্রাঙ্গণে গিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসে পড়ুন, এখনি ভোগ বিতরণ শুরু হবে।” ফণীভূষণ মায়ের হাত ধরে নাচমহলের দিকে ধীরেধীরে এগিয়ে গেল। বিভাদেবী ভীড়ের মধ্যে হাটতে কষ্ট হলেও একটা ঐশ্বরিক তৃপ্তি অনুভব করে বললেন-” বুঝলে খোকা, মায়ের ইচ্ছে না থাকলে কিছুই পাওয়া যায় না। ভাবতো মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া, মায়ের প্রসাদ খাওয়া, এসব তাঁর ইচ্ছে ছাড়া কি সম্ভব!! ( একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে) তবে ঈশ্বর অভাব আর অজ্ঞাত বাসে জীবনটাকে শেষ করে দিলেন। জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরীর ভয়ে ভিটে মাটি ছেড়ে আজ বারোটা বছর পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কোথায় বৌমা নাতি নাতনিদের নিয়ে মনের সুখে থাকার কথা, সব কি থেকে কি হয়ে গেল। (একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে) শুধু একটা সান্তনা প্রবাদ বাক্যের উপর বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছি, ‘ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন’। — মা আপনি চুপ করুন না! এখানে এসে আপনার এই সব কথাই মনে পড়ছে?? — জানিনা বাবা,তবে মনঃকষ্ট তো স্থান বোঝেনা, কাল বোঝে। — ওসব কথা মনে আনবেন না, আমিতো আপনার সন্তান, আপনার পাশেই আছি। — আমি আর কতদিন বাবা! কিন্তু তোমার জীবণটা?? আমি যে মরেও শান্তি পাবনা। — থাকনা মা এসব কথা, আজ না হয় একটু আনন্দে থাকো। শয়ে শয়ে প্রজারা সারিবদ্ধ ভাবে প্রসাদ খেতে বসছে, ফণীভূষণ চক্রবর্ত্তী মাকে নিয়ে সেই ভিড়ের মধ্যে গিয়ে পাশাপাশি বসলেন। প্রসাদ দেওয়া তখন-ও শুরু হয়ইনি, সকলের সাথে বৃদ্ধা মা’কে নিয়ে ফণীভূষণও অপেক্ষা করতে থাকে। অঞ্জলি দেওয়ার জন্য নির্জলা উপবাসে সে-ই কোন সকালে বেরিয়েছে। খিদেয় পেটের নাড়ি চোঁ-চাঁ করছে। এরি মধ্যে বল্লম হাতে দু’জন পাগড়ীওয়ালা ষণ্ডামার্কা পেয়াদা ফণীভূষণদের কাছে এসে বলল-” আপনারা আমার সাথে আসুন।” খেতে বসে এমন একটা অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সম্মুখীন তাদের যে হতে হবে ফণী়ভূষণ সেটা কল্পনাও করতে পারেনি। আসলে ‘ঘর পোড়া গরু, রাঙা মেঘ দেখলে ডরায়’। মাতা পুত্রে ক্ষণিকের জন্যে পলকহীন অবস্থায় একে অপরের দিকে চেয়ে রইলেন। জমিদারের পেয়াদা একবার তাকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে জীবনটাই বরবাদ করে দিয়েছে। নিঃশ্বাসিত জীবনটা নিয়ে এই জমিদার আবার কি খেলা খেলবে কে জানে!! ফণীভূষণ মনে সাহস সঞ্চয় করে পেয়াদার কাছে জানতে চায়, “কোথায় যাবো? কি জন্যই বা যাবো, আমাদের অপরাধ, জানতে পারলে—–” পাগড়ীওয়ালা ষণ্ডামার্কা পেয়াদা জানালো—” হামি জানে না,কুছু বলবার হুকুম নেহি।” জমিদারের খেয়ালের কাছে প্রজাদের স্বাধীনতা বড় অসহায়। অগত্যা প্রসাদ খাওয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করে অভুক্ত জঠরে ফণীভূষণ মায়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে জমিদারের পেয়াদাকে অনুসরণ করল। মা দুর্গার কাছে নিজেদের সমর্পণ করে দিলো। নাচমহল থেকে দু’জনকে নিয়ে আসা হল মূল ফটকের সামনে। খিড়কিদুয়ার হতে ভেতর প্রবেশ করে ফণীভূষণদের মাথা ঘুরে যায় আর কি। বাড়ি তো নয়, যেন রাজ প্রাসাদ। ফণীভূষণ ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। তাদের জন্য কি প্রহসন যে অপেক্ষা করে আছে কে জানে!! বৃদ্ধা কিছু একটা অনুমান করে ফণীভূষণকে সন্তর্পণে বললেন-” চিন্তা কোরো না বাবা, মা চণ্ডী মাথার উপর আছেন। তিনিই রক্ষা করবেন।” এরি মধ্যে এক ভদ্রমহিলা বিভাদেবীর কাছে এসে তাঁদের ডেকে একেবারে অন্দরমহলে নিয়ে গেলেন। ভীষন আন্তরিকতার সহিত সাদর অভ্যর্থনা করে মাতা পুত্রকে বসতে দেওয়া হল। কেউ কোন কথা বলছে না। এমতাবস্থায় খানিকক্ষণের মধ্যে আস্তে আস্তে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নির্বাক দর্শকের মতো মায়ে বেটায় মাথায় প্রশ্নের বোঝা নিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। ফণীভূষণের জঠর জ্বালা উধাও হয়ে কুচিন্তা মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলল। বিভাদেবী এমনতর আচরণের যুক্তি খুঁজে পেলন না। একজন গরীব ব্রাহ্মনীকে পুত্র সহ অষ্টমী পূজার দিনে অন্দরমহলে ডেকে জমিদার কি করতে চান!! কিছুক্ষণ পর সমস্ত প্রশ্নের অবসান ঘটিয়ে জমিদার ঘরে প্রবেশ করলেন। ফণীভূষণ চক্রবর্ত্তী জমিদারকে দেখে চমকে উঠে দাড়াল। এ-তো জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরী!!! বিভাদেবী উঠে দাড়িয়ে প্রণাম জানাতেই, জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরী বললেন-” ঠিক আছে আপনি বসুন। (ফণীভূষণের দিকে তাকিয়ে) তুমি ফণীভূষণ চক্রবর্ত্তী? ” ভয়ে ফণীভূষণের জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গেল। এ যেন ‘টকের ভয়ে পালিয়ে এসে তেঁতুল তলায় বাস’। হা ঈশ্বর শেষ পর্যন্ত এই ছিল কপালে!! জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরী ফণীভূষণের মুখমন্ডলের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে বাকি থাকলনা যে সে ভয় পেয়েছে। তিনি ফণীভূষণকে আস্বস্ত করে বললেন -” ফণীভূষণ তুমি বিচলিত হয়ো না। বার বছর আগের সেই রাতের ঘটনা আমি বিস্তারিত শুনেছিলাম। দোষ তোমার ছিল না। ছিল ভুল, আজ এমন দিনে ঠিক,ভুলের বিচার করতে তোমাদের এখানে ডাকিনি, এবং সেটা করার সময়ও এখন নয়। বরং ভুল যা হয়েছিল সেইটা শোধরাবার সময় এসেছে।” বৃদ্ধার কাছে ব্যাপারটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। জমিদার গিন্নী বিন্দুবাসিনিকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন, সঙ্গে কুলপুরোহিত। পরনে মখমলের হরিদ্রাভ শাড়ি, সম্পূর্ণ অঙ্গ স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিতা, কাজল কালো কুন্তলে সিঁথির সিঁন্দুরের রেখা ললাট স্পর্শ করেছে। ললাটের মধ্যস্থলে সিঁন্দুরের টিপ রূপকে শতগুন বর্ধিত করে যেন নব বধু সাজে সজ্জিতা হয়ে বিভাদেবীকে গড় হয়ে প্রণাম করল তারপর বাড়ির সকল গুরুজনদের। বিভাদেবী আর্শীবাদ করে বললেন-“জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক না থাকলে এমন ভাবে মিলন হয় না মা। একেই বলে ‘সাত পাকে বাধা’ মন্ত্রের জোর। যে বেদ মন্ত্রের মানে না জেনেও শুধু উচ্চারণ করে দুটি ভিন্ন মনের মানুষকে চার হাত এক করে দেওয়া হয়, সেই ভিন্ন হৃদয়ের মিলন যে বিধাতা সমস্ত জীবনের জন্যে লিখে দেন। সেটা যে ছিন্ন হয়েও হয় না।” বিন্দুবাসিনির সাথে ফণীভূষনের এক পলক নির্বাক দৃষ্টি বিনিময় হল, যার মধ্যে বলতে না পারা কথাগুলো যেন এক পলকেই উভয়ে উভয়কে বলে ফেলল। ‘মনের আয়না মুখ’, প্রবাদটা যে চির সত্য বিন্দুবাসিনির মুখোমন্ডল দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সে অতীতে করা ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থী। ব্যাপারটা পাশে বসে থাকা কুলপুরোহিতের নজর এড়াল না। তিনি বিন্দুবাসিনী এবং ফণীভূষণের উদ্দেশ্যে বললেন-” যদেতৎ হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম,তদস্তু হৃদয়ং তব।। এই মন্ত্র উচ্চারণ করে তোমরা ভিন্ন হৃদয়ের দুটি মানুষ চার হাত এক করে বিবাহ বন্ধনে আবধ্য হয়েছিলে। ওই মন্ত্রের বিশেষত্ব হল, উক্ত মন্ত্রশক্তি বলে দুটি ভিন্ন আত্মার মানুষ একাত্ম হয়ে যাওয়া, আমৃত্যু সেই সম্পর্ক অটুট থাকে। মনে হল,আর ছেড়ে চলে গেলাম সেটা হতে পারে না। মন্ত্রের এক অলৌকিক শক্তি আবার মিলন ঘটিয়ে দেয়।
ঢাকের বাদ্যি আর শঙ্খ উলুধ্বনি সহযোগে জমিদার বাড়ি মুখরিত হ’য়ে উঠল। এ যেন দুর্গা মায়ের বাপের বাড়ি আসা,আর বিন্দুবাসিনির শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ। জমিদার ব্রজনারায়ন চৌধুরী কালক্ষয় না করে দুটি পরিবারের মধ্যে দুর্গোৎসবের সাথে সাথে মিলনোৎসবের বিপুল আয়োজন করলেন। তাঁর জমিদারির গরীব প্রজাদের সাতদিন ধরে কব্জি ডুবিয়ে ভোজন করিয়ে তৃপ্ত করলেন।