আত্মীয় বিয়োগ
বাসুদেব চন্দ
মাঠঘাটের প্রতি টান ছোটবেলা থেকেই। খেলাধুলা ছাড়া অন্য নেশাও ছিল। লেখা পড়াটা ছিল শুধুই কর্তব্য, বলা ভালো, মা-বাবার সঙ্গে একটা শর্ত ছিল মাত্র। নির্দিষ্ট সময়টা কোনোরকমে পার করে দিয়েই দৌড় লাগাতার মাঠের দিকে। সকালে ছিপ নিয়ে, বিকেলে ফুটবল।
তখন আমার বয়স কত হবে, দশ-এগারোর মতো। থাকতাম বিধানপল্লী, ঊষা কোম্পানির খেলার মাঠ লাগোয়া একটা জায়গায়।
একদিন সকালে ধানখেতে’র পাশের একটা ডোবাতে মাছ ধরছি, পুঁটি ল্যাটা বেলে এই সব আরকি। নজরে পড়ল ধান খেতে একজন বুড়িমা কাজ করছে আর আমায় দেখছে। আমি আমার ছিপের ফাতনার দিকে নজর ঘোরালাম। একটু পরেই হঠাৎ কানে এল, “কি গো খোকা, মাছ পেলে”? আমি বললাম, “দুটো পেয়েছি গো, একটা ল্যাটা আর একটা বেলে। তুমি নেবে”? ফোকলা দাঁতে একগাল হেসে বলল, “না রে সোনা”।
বুড়ির দিকে মন গেল। গায়ে অপরিষ্কার একটা কাপড়, কিন্তু বেশ গুছিয়ে পরা, কাজের মেয়েরা যেরকমটা পরে। হাতে একটা কাস্তে অথবা খুরপি জাতীয় কিছু একটা হবে। মুখে হাসি লেগেই আছে। দেখতে বেশ লাগছিল!
আমি বললাম, “তুমি কেন মাঠে কাজ করো, কষ্ট হয় না”? বলল “কাজ না করলে খাব কী। আমি, আমার ছেলে সবাই কাজ করি”।
প্রথম আলাপেই খোলামেলা বেশকিছু কথা হল। আসলে ঢেকেঢুকে রাখার মতো দু’জনেরই কিছু ছিল না। যাই হোক, বুঝলাম ওরা খুব গরিব। আমার আর মাছ ধরতে ভাল লাগছিল না, বললাম, “আমি যাই গো”, দৌড় লাগিয়েও থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ঠাকুমা, কাল আসবে তো”? “আসব”। খেয়াল করলাম, বুড়িমা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যত দূর দেখা যায়। আমিও……
পরের দিন সকালে পড়তে বসেই মা’কে বললাম, “আজ কিন্তু তিনটে রুটি খাব” । মা বলল – “ঠিক আছে, তুই এখন মন দিয়ে পড়”।
মা’কে শুনিয়ে শুনিয়ে চিৎকার করে পড়তে লাগলাম……..। কিন্তু মন কি আর পড়ায় আছে! সে তো তখন ঘড়ির দিকে । যাই হোক, কোনোরকমে সময়টুকু পার করে একটু খেয়ে নিয়েই ছুট লাগালাম মাঠের দিকে।
“ঠাকুমা” বলে ডাক দিতেই বুড়িমা এগিয়ে এসে বলল, “আমিও তো ভাবছিলুম তুমি কখন আসবে”! আমি বললাম “তোমার জন্য একটা রুটি আর তরকারি এনেছি,খাবে তো”? খুশিতে ওর, দুচোখে জল এল, আমায় আদর করে বলল, “তুমি এনেছো আর আমি খাব না”!
বাড়ি ফিরলাম, মা’কে ওর কথা বললাম, রোজ দুটো রুটি বরাদ্দ হল ওর জন্য। মা’ও এই সুযোগে, ঠিক করে পড়াশোনা করার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিল। এভাবে বেশ কয়েকদিন চলতে লাগল। ঝড় জল বৃষ্টি যাই হোক না কেন, আমাদের দেখা হত রোজই। এটাকে কী বলব, নতুন খেলা, না দায়িত্ব, না কি ভালোবাসা! মোটের ওপর দারুণ লাগত আমার। ওরও নিশ্চই!
বেশ উপভোগ করতাম ওর রুটি খাওয়া। শুধু মাড়ি দিয়ে কীভাবে চিবোত। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম, ও-ও হাসিমুখে খেয়ে যেত, শেষে এক ঘোটি জল, মুখে না লাগিয়ে হা করে খেয়ে নিত, জল কিন্তু একটুও বাইরে পড়ত না । অবাক হয়ে দেখতাম! আমাকেও খাওয়াত, ওর বাড়ির আম, কলা, বেল এইসব। ওর সঙ্গে যে দুয়েকজন কাজ করত, আমাদের সম্পর্ক নিয়ে তারা বেশ মজা করত। বলত, “এই যে খোকা, বুড়িকে যখন এতই পছন্দ, বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে গেলেই তো পারো”। বুড়িও বলত, “হিংসে হচ্চে বুঝি, তোরা নজর দিসনে কো বাপু”। আমি তো লজ্জায় ধাঁ ছুট বাড়ির দিকে!
রাত হলে ভাবতাম সকাল কখন হবে, আর সকাল হলে ভাবতাম দেখা কখন হবে। তখন বুঝতাম না; এখন বুঝি, এটাকে বলে মায়া। ওরা আমাকে মজা করে যা-ই বলুক না কেন, কথাটা আমার মনে ধরেছিল। ঠিক করলাম, ঠাকুমাকে একদিন নিয়ে এসে মা’কে দেখাব। মা’কে বললাম, মা বলল- “কেন, এতে হচ্ছে না বুঝি, আবার বাড়িতে আনতে হবে?” শেষে আমার মুখ চেয়ে রাজি হল।
রাত পোহাতেই ছুটলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বুড়িমা’কে গিয়ে বললাম। শুনে বুড়ি খিল খিল করে হেসে উঠল, “ওরে, খোকা কী বলে শোন, আমায় কালই নিয়ে যাবে মা’কে দেখাতে। পছন্দ হলেই ছেলের বউ করে নেবে”! ওরাও হো হো করে হেসে উঠল, সবাই মিলে খানিক উলুর ধ্বনিও দিল! আমার লজ্জা হচ্ছিল আবার আনন্দও হচ্ছিল বেশ।বললাম, “ইয়ারকি কোরো না, কাল একটা ভাল কাপড় পরে আসবে কিন্তু। আমি ঠিক এই সময় তোমায় নিতে আসব”। বুড়িও রাজি হল।
পরের দিন পৌঁছলাম। ওর খাবারটাও সঙ্গে ছিল। কিন্তু সেদিন ধান খেতের সামনে দাঁড়াতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করতে লাগল ! ধানগাছগুলোও আগের মতো হাসিখুশি ছিল না, কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়া।
বুড়িকে দেখছি না তো! মাত্র একজন কাজ করছে , মাথা নীচু করে। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, “ও দিদি, ঠাকুমাকে দেখছি না কেন গো” ? ও কোনও উত্তর দিল না, আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে কাজ করতে লাগল, না কাজ করার মতো করে। এবার ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মাথা নিচু করেই উত্তর দিল! শুনে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম খানিক্ষণ। তারপর ছুটে খেতের বাইরে বেরিয়ে দৌড় লাগালাম বাড়ির দিকে, আবার ফিরে গেলাম। রাগে-দুঃখে ওর খাবারটা ছুঁড়ে ফেললাম খেতের ঠিক মাঝখানে। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে এলাম!
মা’ও আমাদের অপেক্ষায় ছিল। সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আজ আর ইশকুলে যেতে হবে না। রান্না হয়ে গেছে, খেয়ে শুয়ে পড়!
সেদিন মা’ও কষ্ট পেয়েছিল, আড়ালে কেঁদেছিল, কারণ অনেক আশা করে ওর জন্য সাজিয়ে রেখেছিল মিষ্টি, জল আর একটা নতুন সাদা কাপড়……..
—oooXXooo—