“আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, এই দিনে ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। এই দিনটি স্মরণ করার লক্ষ্যে আমারা সবাই এই সভাগৃহে উপস্থিত হয়েছি। মূলত আজকের প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা উপস্থিত, যারা আগামী দিনে এই বাংলা ভাষা উৎকর্ষের সাথে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ধারক ও বাহক হবে। আমাদের এই আলোচনা সভার সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করতে, আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন, গোবর ডাঙা হিন্দু মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা প্রখ্যাত সাহিত্যিক উষাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়।সভা কতৃপক্ষের তরফ থেকে ওনাকে আমরা ছাত্রদের উদ্দেশ্য ওনার মহা মূল্যবান বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করছি”।
গৌরবর্ণ হালকা চেহারার, ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত, সদাহাস্যময় মধ্যবয়স্ক মানুষটি মঞ্চে উপস্থিত হলেন এবং ওনার মহামূল্যবান বক্তব্য শুরু করলেন –
“উপস্থিত শ্রদ্বেয় ভদ্রমণ্ডলী ও আমার সন্তানসম ছাত্র-ছাত্রীরা, সবাইকে আমার সন্মান ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমি অল্প কয়েকটি কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করবো। আমি যে কথাগুলো বলবার চেষ্টা করবো, তা উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলীদের জন্য নয়, কারণ আমি যা বলবো সেটা তাঁরা জানেন। আমি তোমাদের (ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে) জন্য সামান্য কয়েকটি কথা বলবো। দেখো, আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। আমরা সবাই যে একত্রিত হতে পেরেছি এটা আমাদের কাছে গর্বের বিষয়। কারণ এই সুমধুর বাংলা ভাষায় শুধু কথা বললেই হবে না, এটিকে আরো সমৃদ্ধ করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সারা বিশ্বে এই একটি ভাষা আছে যে ভাষাতে একটা সাংকেতিক চিহ্ন বদলে মনের ভাব বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ করা যায়। সেই জন্য বাংলা ভাষা ভীষণ কঠিন, আবার খুব সুন্দরও বটে। এই প্রসঙ্গে তোমাদের একটা গল্প বলি শোনো – বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা। একটি স্কুল পরিদর্শনের জন্য নৌকাতে চলেছেন চারজন। উনি আর মাঝি ছাড়া সাহেব আর তাঁর ব্রিটিশ চাকর আছে। কথা প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয় সাহেবকে বললেন যে, ইংরাজীর থেকে বাংলা অনেক কঠিন ভাষা। কিন্তু সাহেব তো মানবার পাত্র নয়। তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় সাহেবকে বললেন, ঠিক আছে, আপনি আপনার ভৃত্যকে আপনাদের মাতৃভাষায় কিছু বলুন। তারপর দেখুন সে বোঝে কিনা। আর আমি ঐ মাঝিকে কিছু বলবো দেখবো সে বোঝে কিনা। সাহেব তো সম্মতি জানিয়ে ভৃত্যকে ইংরেজিতে কয়েকটি কথা বল্লেন। ভৃত্য কথাগুলি বুঝে উত্তরও দিলেন। এইবার বিদ্যাসাগর মশাইয়ের পালা। উনি মাঝিকে বললেন – ওহে কান্ডারী, তোমার তরী তুমি তীরে ভিরাও। মাঝি আপন মনে দাঁড় বাইতে থাকলো। সে কোনো মন্তব্য করলো না। কারণ সে বোঝেইনি তাকে কি বলা হলো। এবার বিদ্যাসাগর মহাশয় সাহেবকে বললেন, দেখলেন তো সাহেব, মাঝি আমার বাংলা কথা বুঝলো না। যাইহোক, এই যে বাংলা ভাষাকে আমরা সুমধুর ভাষা বলি, এই স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। (Bengali language is the sweetest language of the world.) বিশ্বে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রাণ দিয়ে লড়াই করেছেন আমাদের পূর্বসূরি মহাপ্রাণ বাঙালিরা। যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই পূর্ববঙ্গের মানুষ ছিলেন। তাঁরা যে অস্ত্রকে (কবিতা, গল্প, উপন্যাস , গান ইত্যাদি) পাথেও করে লড়াই করেছিলেন, সেই সব অস্ত্র সম্ভার তৈরী করেছিলেন – রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, নজরুল , মধুসূদন, জসীমউদ্দীন আরো হাজারো নাম আছে। সেইসব সৃষ্টিগুলো পাথেও করে আমরা আজও এগিয়ে চলেছি। নুতন করে আর সৃষ্টি হচ্ছে কই ? ওইসব মনীষীদের আমি সাধক বলি। তাঁরা ভাষা দেবীর সাধক। অনেক সাধনা করে মা সরস্বতীর বর পেয়ে এইসব গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই সম্পদ স্বযত্নে সুব্যবহার করাই তোমাদের লক্ষ হওয়া উচিৎ। কিছুদিন আগে, আমার একটি ছাত্র আক্ষেপ করে আমাকে বলল, স্যার, সেই সব মানুষ কত ভাগ্যবান যারা এই সব মনীষীদের জীবিত কালে তাঁদের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছেন। আমি ওকে বললাম কে বলেছে আমরা তাঁদের সান্নিধ্যে নেই। তারা আজও বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন তোমাদের মধ্য দিয়ে। তোমাদের মনে আর বই এর পাতায় জাগ্রত দেবীর মত। একটা কথা সর্বদাই মনে রাখবে। তাঁরা সশরীরে যতদিন বাঁচেন, অশরীরে বাঁচেন তার থেকে অনেক বেশি দিন, তাঁদের কর্মের মধ্য দিয়ে। তাই তোমাদেরও সেই পথ অনুসরণ করতে হবে, যে পথে তোমরা মাতৃভাষাকে বয়ে নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারো। তার মানে আমি কিন্তু বলছি না যে, তোমরা অন্য ভাষা পরিত্যাগ করে শুধু বাংলা ভাষাই জানো। তাহলে বিশ্বায়নের যুগে অন্নের সংস্থান হবে না। অনেক বাঙ্গালী ভিনদেশে বা ভিনরাজ্যে কর্মরত। তাকে তো সেখানকার ভাষা জানতেই হবে। কিন্তু দেশে ফিরে কথা-বাত্রায় যেন ভিনদেশী ভাষার প্রভাব না থাকে। ভাবখানা যেন এমন না হয়, দেখো আমি কেমন অন্য ভাষা শিখেছি। বাংলা ভাষায় আমরা আমাদের মনের ভাব যত সুন্দর প্রকাশ করব, তা অন্য ভাষায় কখনোই সম্ভব নয়।
আর একটা কথা বলি, সমস্ত পিতা মাতার উদ্দেশ্যে – কয়েক দিন আগে আমি একটা মুদি দোকানে কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম। ঠিক সেই সময় সেখানে একটা বছর বারোর বাচ্চা ছেলে এসে দোকানদারের কাছে পাঁচশো মুসুর ডাল কিনলো। দোকানদার ঊনপঞ্চাশ টাকা দাম চাইলে, বাচ্চাটি দোকানদারের মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো তার মানে ? তখন দোকানদার একটু মুচকি হেসে ফোরটি-নাইন বললে বাচ্চাটি ওকে দাম মিটিয়ে চলে গেলো। অর্থাৎ ঐ বাচ্চাটিকে সরাসরি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। ও ধারাপাত, সহজপাঠ, বর্ণ পরিচয় কিছুই জানেনা। বাড়ি এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে যেটুকু বাংলা শুনছে সেইটুকু শিখছে। মনে রাখতে হবে, সাহেবরা ভারতীয়দের সঙ্গে কথা বলতে হলে, যতটুকু ভারতীয় ভাষার প্রয়োজন হতো ততটুকুই বলতেন। কিন্তু নিজেদের মধ্যে কথা বলবার সময় মাতৃভাষায় কথা বলতেন। আমরা ঠিক তার উল্টোটা করবার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের মধ্যে আমিত্ব প্রমাণ করার প্রবণতা প্রবল।
পরিশেষে বলি, স্থানভেদে ভাষা অপভ্রংশ হয়ে যায়। তবে বাংলা বাংলাই থাকে। তার মধ্যে ইংলিশ, চাইনিজ, জাপানিজ বা হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি যেন মিশেল না থাকে। আমরা যদি এটা ঠিক মত মেনে চলতে পারি তো, এই ভাষা অন্য ভাষার মত সারা বিশ্বে মহীরূহ হোয়ে বিরাজ করবে এবং সেটা আগামী প্রজন্মের উপর আমরা ভরসা করতে পারি। ধন্যবাদ ।
Valo uposthapona.Suveccha roilo.
ধন্যবাদ 💐