আজ পনের দিন হল রাগ করে মোনালিসা এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। শুধু যে চলে গেছে তাই নয়, তার অগোছাল পারিপাট্যে সে রেখে গেছে সংসার পাতার অর্থহীন কিছু অমোঘ চিহ্নগুলিকেও।
অজিতেশ নিজেও সেদিন যতটা পরাক্রমে স্ত্রী’র কাছে নিজের যুক্তিতে অনড় থেকেছিল, আজ হয়ত সেই দৃঢ়তায় লেগেছে অনবধানের অযত্নলালিত আল্পনার মায়া, তা সেটাও নিজেকেও বোঝাতে যথেষ্ট অর্থহীন সময় লেগেছে। …… অনেক্ষণ আজ তার রাতের খাবারটুকু টেবিলেই অধরা থেকে গেছে। মনখারাপের আবছা আলোয় কেবল প্রায়ান্ধকার ঘরে জ্বলছে উদাসীন নাইটল্যাম্প।
এটাও হয়ত অনস্বীকার্য যে মোনালিসার বিজ্ঞাপন জগতের কর্মব্যস্ততা কোভিড পরবর্তী সময়ে যেমন ধীরে ধীরে বেড়েছে ঠিক তেমনই তাল মিলিয়ে কমেছে উঠতি কবি অজিতেশের সাফল্যের রেখাচিত্র।
তবে তিন চারটি পত্রিকা এখনো তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে বলে পেটে টান এখনও ধরেনি। সম্পর্কের টানাপোড়েনে অনেকদিন ধরে জ্বলছিল দুজনেই, ফলতঃ এই অবধারিত বিচ্ছেদ। …..
এদিকে হু হু করে জোলা বাতাস এসে অস্থির করে তুলছে। আর একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। আর সেটাই সত্যি হল। আকাশ ভাঙা বৃষ্টি নামল ছায়াচরাচর জুড়ে।
এই প্রাকৃতিক আলোড়ন যেন আরো বেশী করে অজিতেশকে মোনালিসার অভাব যেন তার চোখে আঙুল দিয়ে আজ বুঝিয়ে দিচ্ছে।
এবাড়িতে টেবিলক্লথ থেকে এমনকি চায়ের কাপ সবেতেই তো তার উপস্থিতিটি বড় বেশী নির্লজ্জ যেন । অজিতেশের নতুন চশমার ফ্রেমের বাহারেও থেকে গেছে পাগলী মেয়েটার লজ্জাহীন অনুরাগের চিহ্ন।
যত্তসব! কি যে ঝামেলা! আর পারা যাচ্ছে না। ….
ঘরের মধ্যেই কিছুটা নিজের মন শক্ত করে বসে থাকে অজিতেশ। এদিকে বৃষ্টির তেজ ক্রমশ বেড়ে চলে বাইরে। অন্ধকারের চাদর ভেদ করে চলতে থাকে কেবলই ধারাপাতের তীব্র অসহযোগ আন্দোলন।
খানিকক্ষণ পরে তারমধ্যে সে নিজেকে আবিষ্কার করে যে সে এখন গলি ছাড়িয়ে রাস্তার মোড়ে। চুপ্পুড় ভিজে তার পোশাক।
যেন দীর্ঘকায় শালবিথীর একটি বিষাদবৃক্ষ আজ অনন্ত যাত্রায় ফেলে এসেছে বনজ চোরা গলির সমস্ত টান। মনখারাপের আবিলতাও কি বৃষ্টিতে অবলীলায় ধুয়ে যেতে সক্ষম?
কেবলই মনে হচ্ছে যেন মোনালিসাকেই আজ তার বড্ড দরকার। কি করে পারল মেয়েটা এতটা অধৈর্য্য হয়ে সব ছেড়েছুড়ে চলে আসতে!
তারপর একটা ঘোরের মধ্যে পা চালায় অজিতেশ। তার মস্তিষ্কের ভিতরে একদিকে যেমন বিলাসখানি টোড়ির ঝঙ্কার উঠে আলাপকে এনে পৌঁছে যায় ঝালায়, ঠিক তেমনই সে মন্ত্রচালিত এক পুতুলের মত বিড়বিড় করে স্বগতোক্তির ঢংএ বলে ওঠে,
” ..বৃষ্টি পড়ে হেথায় বারোমাস এখানে মেঘ গাভীর মত চরে পরান্মুখ নরম নালিঘাস পিছন থেকে দূয়ার চেপে ধরে….”
সে কি আদৌ জানে? চিরবিরহের এক অন্য জাগৃতিটুকু আর একটি বাড়িতেও হয়ত একইভাবে জেগে আছে এই বর্ষণের সুতীব্র অনুশোচনায়!