তুলসীতলা
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
এই বাড়ির মেজকর্তার ছোটো মেয়ে ঊষারাণী। বড় ছেলের পর পর দুই ছেলে। আর মেজোবৌ এর পর পর দুটো মেয়ে। ছোট মেয়ে জন্মাতেই মেজোবৌ কাঁদতে থাকল। আবার মেয়ে। বংশধর হল না। প্রভু জগন্নাথের কাছে মানসিক করলে। বললে “ঠাকুর। আমার যেন পুত্র সন্তান হয়”।
মেয়েটার জন্ম নিয়ে সবাই দুঃখ করলে। কেউ কেউ বললে “ভগমানের চোখ কানা। ” শুধুই মেজোকর্তার মুখে হাসি। এমন পৌষমাস। উঠোন লক্ষ্মীর পুজো হচ্ছে। ঠাকুর এর ভোগ দিতে বাকি। অমনি আনন্দ অশৌচ হয়ে গেল। বুড়োকর্তা পুজোর আসন থেকে উঠে এল। বললে “মুখুজ্জেকে ডেকে ভোগ দেবার বন্দোবস্ত হোক। আমাদের এখন ছোঁয়ান্যাপা করা যাবে না।”
মেজোবৌ নিজেকে দোষারোপ করতেই মেজোকর্তা বললে “এই তো আমার ঊষারাণী বৌ। মুখখানা দেখো। যেন আলো ঝলমল করছে। “
শাশুড়ি একবার আঁতুরঘরে ঢুকলে। এ বাড়ির গিন্নিমা। রাসমণি। বৌ এর মাথায় হাত দিলে। বললে “জন্ম মৃত্যুর আমরা কে মা? একটা প্রাণের জন্ম হল। তাকে অভিবাদন জানাও। জন্ম মানেই সৃষ্টি। আর সৃষ্টি মানেই আনন্দ “।
শাশুড়ির মুখ থেকে এই কথা শুনে মেজবৌ বললে “জগন্নাথ এর ধ্বজার কী হবে মা। অতগুলো টাকার সদ্গতি হল না”।
বৌ এর কথাতে বিরক্ত হয় রাসমণি। এরা কত ছোটো তবু চিন্তার ক্ষেত্রে মধ্যযুগে পড়ে আছে। বললে “সুস্থ হও বৌমা। তারপর না হয় ভাববে”।
ঘরে এল রাসমণি। আজ আর তুলসী তলায় ওঠা যাবে না। তুলসী পাতা চাই পুজোয়। মুখুজ্জেরা ওদের দৌহিত্রগোষ্ঠী।
অশৌচ এ ওরাই ভরসা।
বাড়িতে সীতানাথ। শালগ্রাম শিলা। নারায়ণ বিষ্ণু। তুলসী ছাড়া নারায়ণ পুজো হয় না। অথচ একটা নারীর জন্ম নিয়ে গর্ভধারিণী দুঃখ করছে। এই তুলসীর তলা বড়ো পবিত্র। ছোট্ট গাছটার মধ্যেই আছে পূর্বপুরুষ দের ছায়া। মনে হয় ওর শিকড় অতল গভীরে। সবাই বলে তুলসী বর্ষজীবী। ভুল বলে। যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্য বহন করে তুলসী। এসব ভাবতে ভাবতেই রাসমণির চোখ থেকে নেমে আসে জলের ধারা। এই নারীজীবন। সবাই যেন পুতুল খেলে।
তবুও তো তুলসীর অভিশাপ থেকে নারায়ণ নিস্তার পাননি। সুন্দরী তুলসীর তপস্যায় সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বলেছিলেন “বলো তুলসী। তুমি কী বর চাও”?
অপাপবিদ্ধ তুলসী চেয়েছিল “হে দেব! আমি নারায়ণ কে পতি রূপে চাই”।
তখন কী জানতো তুলসী তার আরাধ্য পরমপ্রিয় তার সাথেই প্রতারণা করবে।
তুলসীর মতো প্রতিটি নারীর জীবন। রাসমণিও তাই।
আজ সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাবে না রাসমণি। গঙ্গাস্নান করে ষষ্ঠীর পুজো করে তবে তুলসীর তলায় যাবে। এর মধ্যেই বসন্ত মুখুজ্জের ছেলে হাজির। হাঁক দিলে “অ তাতমা। তুলচির পাতা তোলবো তো”।
এই ছেলেটার কথাগুলো বড়ো আধো আধো। রাসমণি ঘর থেকে বের হল। বললে “ছোটন। তুই তুলসীর মন্ত্র জানিস?”
ছোটো বোকা বোকা তাকায়। বলে “টারকেশ্বলে পৈতে হইছে। পৈতেটা থেকালেই সব শুদ্ধু”।
রাসমণি হাঁ হাঁ করে ওঠে। বললে “আমি বলে দিচ্ছি। শুনে শুনে বল”।
রাসমণি আওড়ে চলে “তুলসী তুলসী নারায়ণ/তুমি তুলসী বৃন্দাবন/ডালে কৃষ্ণ পাতায় হরি/সরো নারায়ণ তুলসী তুলি”।
ছোটন আধো বুলিতে কী যে বলে। তা হোক। গলায় পৈতেটা তো আছে।
রাতে কচিটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদছে। ওর মায়ের বুকে এখনও দুধ আসে নি। পেটে ভাত পড়লেই মাতৃকরুণা ধারা নেমে আসবে। খিলখিল করে হাসবে শিশু। কাঁচা নাড়িতে এখন ভাত দেওয়া যাবে না। ঘর থেকে মধু নিলে রাসমণি। কচিটার মুখে মধু দিলে।
রাতের অন্ধকার নেমে এলে রাসমণি ভেবে চলে। লক্ষ্মী মা এর পদচিহ্ন তুলসীর তলায়। শাশুড়ি মা মঙ্গল ঘট বসাতো। রাসমণি বলেছিল “নারায়ণ শালগ্রাম শিলা কেন মা। ভগবান তবে কি পাথর”?
শাশুড়ির মুখ থেকেই কত গল্প শুনেছিল রাসমণি। তুলসীর সাধনাতে ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে তুলসী নারায়ণ কে চাইলে। ব্রহ্মা বললেন “নারায়ণ কে পেতে গেলে আগে এক দানবের সাথে বিয়ে করতে হবে। সে দানবের নাম শঙ্খচূড়”।
দোর্দণ্ডপ্রতাপ শঙ্খচূড় জানতো তার স্ত্রী তুলসীর সতীত্বের শক্তি তাকে দেবলোক জয় করাবে। আর দেবতারা। নারায়ণ এর শরণাপন্ন হলে নারায়ণ শঙ্খচূড়ের ছদ্মবেশে তুলসীর সতীত্ব নষ্ট করলে।
আর দেবাদিদেব শঙ্খচূড়কে হত্যা করলে। একটা নারীর জন্য দেবকূলকে প্রতারক হতে হল। আর অসহায় তুলসীর ভালোবাসাকে পায়ে দলে গেল নারায়ণ। হায় নারী! হায় তোর ভালোবাসা।
রাসমণি চেয়েছিল অনেক লেখাপড়া করবে। রামকালী চাটুজ্জের মেয়ে সে। দাদারা কত বড়ো বড়ো অফিসার। বাবা ব্রিটিশ আমলের জুরি বিচারক।
রাসমণির তখন আঠারো বছর বয়স হয়ে গেছে। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। যেখান থেকেই বিয়ের সম্বন্ধ আসে সেখানেই খবর আসে মেয়েটা বড্ড মোটা। তার উপরে গায়ের রঙ কালো। এ মেয়ে চলবে না।
রাসমণি বীতশ্রদ্ধ। বিয়ে করবে না ঠিক করল। কতবড় নামকরা বাবার রক্ত তার শরীরে বইছে। অথচ তখনকার সমাজ মেয়েদের দায় মনে করে। বড়ো টানাপোড়েন নেমে এল রাসমণির জীবনে। বাড়িতে দাদাদের কাছে লেখাপড়া করে ঠিকই তবে পাড়া প্রতিবেশীদের টিপ্পনি কম নয়। বিয়ের বাজারে ইংরেজি জানা,দেশ বিদেশের কাহিনী পড়া রাসমণির কোনও দাম নেই।
যতবার দেখতে আসে ততবার মনে হয় দেবতা বলির পশু নিজে পছন্দ করতে এসেছে। না না। এমন মেয়ে চলবে না। সব ছেলে মেয়ে কালো কিষ্কিন্ধ্যা হবে।
রাসমণির মনে হয় বিবাহ তার সব কেড়ে নেবে। তার মনের অধিকার অন্যের হাতে। তার শরীরের অধিকার অন্যের হাতে। রোজ রোজ এক একটা অপমান। বারবার শোনানো হয় তুমি কুৎসিত। তুমি কালো। তুমি চলন সই নও।
সেদিন ঘটে গেল ঘটনাটা। মহিষাদল থেকে রাসমণিকে দেখতে এল। ছেলে অবস্থাপন্ন ।পৈতৃক সম্পত্তির আস্ফালন আছে।ছেলের বয়স তেইশ।
পাত্র পক্ষের সামনে হাজির করানো হল রাসমণিকে। কত প্রশ্নের সম্মুখীন হবার পর একজন তার চুল খুলে দিল। তারপর তাকে পা দেখাতে বললে। একজন স্ত্রী লোক বললে “আসলে পাত্রীর খড়ম পা চলবে না।ওটা অশুভ। “
তারপর একটু হেঁটে যেতে হল। চলন ধীরস্থির কি না। কিন্তু যখন পাত্র পক্ষ থেকে নির্দেশ এল “একটু দাঁত বার করে হাসো” তখন রাসমণির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। চেয়ার থেকে উঠে হন হন করে ঘরের দিকে যেতে যেতেই প্রত্যয়দৃপ্ত কণ্ঠে বললে “আপনারা আসতে পারেন। আমি বিবাহ করব না”।
পাত্র পক্ষ বললে “মেয়েটার বয়স হয়েছে। আমাদের ছেলে বয়সে ছোট। “
ওরা গান্ডে পিন্ডে গিলে চলে গেল। আর ঘরের মধ্যে বিছানায় উপুর হয়ে কাঁদতে লাগল রাসমণি। বেশ কিছুটা কাঁদার পর মনের সাথে বোঝাপড়া করল সে। রাতে বাবার ঘরে প্রবেশ করে বললে “বাবা। আমি বিবাহ করব না। আমি নার্সের কাজ করতে চাই। আর্ত পীড়িত মানুষ কে সেবা করতে চাই “।
বিচারপতি রামকালীর জহুরীর চোখ। মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললে “জানি মা জানি। তোমার অপমান আমাকেও বাজে। তবে জানো কী মা এই সমাজ বড়ো পিছিয়ে আছে। আমি তোমার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। তুমি বুদ্ধিমতী। আমার বিশ্বাস একদিন তোমার জন্য সবাই পাগল হবে। সবাই বুঝবে আসল আর মেকির পার্থক্য। একটু সহনশীল হও। যে সয় সে মহাশয়। তোমার বিবাহ আমি দেবো মা। আর খুব সাধারণ কেউ হবে সে। নার্সের কাজের চিন্তা তুমি ত্যাগ করো।
এবারে একটা সম্বন্ধ এল। খুব সাধারণ ঘর। ছেলেরা তিন ভাই। দুই ভাই সংসারী। মা বাবা গত হয়েছেন। জমিজমা কিছু আছে। মাটির বাড়ি তিন মহলা। দাদাদের অবস্থা ব্যবস্থা ভালো। বড়ো জন ব্রিটিশ কোম্পানির বড়ো চাকুরী করেন। মেজোও খুব পড়তি অবস্থা নয়। দুজনের কোঠা বাড়ি। শুধুই পৈতৃক মাটির ভিটে ছোটো জনের। তবে এখনও একান্নবর্তী সংসার। পৃথক অন্ন হয় নি এখনও।
অবশেষে সানাই বাজলো। পাত্র সুদর্শন। সকলেই বললে “এত সুদর্শন পাত্র জুটলো এই মেয়েটার কপালে। “
বিচারপতি রামকালী ভাবলেন মেয়েটার সুখ তো হবে। নাই বা সমৃদ্ধি থাকল। আর ছেলেদের সংসারে মেয়েটাকে অবাঞ্ছিত করে রেখে দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়”।
রাসমণির গহনা দেখে সকলের তাক লেগে গেল। সোনার গহনাতে মুড়ে দিয়েছেন রামকালী চাটুজ্জে। টায়রা,টিকলি,মান্তাসা,বাজুবন্ধ,সাত নরী হার,হরেক রকম বালা,চিক,চুড়ি কী নেই। সে তো সাধারণ ঘরের মেয়ে নয়। বিচারপতির মেয়ে ।
বর্ধমানের এক অজ পাড়া গাঁয়ের বৌ হয়ে প্রবেশ করল রাসমণি। দুই জা এসে বৌ দেখে হেসেই খুন। বড় বউ বললে “বাব্বা। ওইটুকু পালকিতে এই গন্ধমাদন ঢুকেছে কী করে!”
চারিদিকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ নতুন বউ এর কানে এল। বরণপর্ব শেষ হলে মাটির বাড়িতে প্রবেশ করল রাসমণি। মেজো বউ বরবেশী দেওরকে ঠেক দিয়ে বললে “কী বউ আনলে গো ঠারপো। সাতটা শেয়ালেও খেতে পারবে না এমনি গতর”।
এমন ভাষা এর আগে কখনও শোনে নি রাসমণি। তবুও চুপ করেই রইল। বাবা যে সেদিন বলেছেন “যে সয় সে মহাশয়”।
বিবাহবাসর হয়ে গেল। এবার বাস্তবের ঝড় আছড়ে পড়ল রাসমণির জীবনে। রাজনন্দিনী এখন মাটির বাড়িতে। আর কোথায় তার বাউন্ডুলে স্বামী। সারাদিন তার দেখা নেই। জা দুজন সারাদিন ফরমাশ করে এটা করো ওটা করো। সংসারের সব কাজ রাসমণির ঘাড়ে। তার স্বামীর আয় উপায় নেই। অতএব ঝি এর কাজ করে পেটের দাবী মেটাতে হবে।
রাসমণির স্বামীর নামডাক আছে একটা ব্যাপারে। সে জাত শিল্পী। গান ,কথকতা,কবির লড়াই,যাত্রার পালা লেখা এই নিয়েই মেতে থাকে সে। তার খেয়াল নেই ঘরে তার বউ আছে। তার পেটে বেড়ে উঠছে আগামী শিশু। তীব্র অভিমান হয় রাসমণির। তবে কী তার রূপ নেই বলে স্বামীর কাছেও তার মূল্য নেই। দাসত্ব কী তার জীবনের পরিনাম। সে তো বৈভব চায় নি। একটু ভালোবাসার কাঙাল সে। স্বামীর কী সেটাও দেবার ক্ষমতা নেই!
রাসমণি এখন তিন সন্তানের জননী। কিন্তু তাদের বাপের বাউন্ডুলেপনা অব্যাহত। ভাবলে দিন বুঝি এমনি চলে যাবে। বড়ো দুই ভাই এর বউ দেখলে এদের খরচ খরচা বেড়েই চলেছে। অথচ উপার্জনে মন নেই ছোটো দেওরের। আগে দুটো পেট ছিল এখন আবার পাঁচটা। পৈতৃক সম্পত্তির থেকে যা পাওয়া যেত দুজনের খরচা মিটে যেত। সাথে বিনিপয়সার ঝি ছোটো বৌ। কিন্তু এখন এদের পৃথক করতে হবে। ইচ্ছা করে ওরা রাসমণিকে জ্বালাতে লাগল।
রাসমণি দেখলে তার সন্তানেরা কত অবহেলিত। মাতৃহৃদয় তার কেঁদে উঠল। এমনি করে সব শেষ হতে সে দেবে না। একবার ভাবলে বাপের বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু মনে সায় দেয় না।নানা চিন্তা তাকে গ্রাস করে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে দুটো ঘুঁটে ধরায়। চারিদিকে ধুনোর গন্ধ। এর পর তুলসীর মূলে ধূপ দিতে দিতে ঈশ্বর কে স্মরণ করে। সকলের মঙ্গল কামনা করে। তারপর কাঠের উনান ধরিয়ে রান্নাশালে রান্না করবে। বড়ো দুই জা কেউ আসবে না। তারা বড়োলোকের বউ। পায়ের উপর পা দিয়ে থাকবে আর দুটো খেতে দিয়ে রাসমণিকে করুণা করবে।
কাঠের উনুন জ্বালাতে কত কসরত করতে হয়। বাপের বাড়িতে এসব সে দেখে নি। সকালে কাঠের গুঁড়ি চেলিয়ে তার ডানহাতে কত ব্যথা। কে বুঝবে,কে শুনবে তার কথা। কত রাতে স্বামী ফিরবে। তার পর রাসমণি পরিশ্রম ক্লান্ত শরীর নিয়ে টলতে টলতে উঠে খেতে দেবে। তারপর নিজে খাবে। এ বাড়ির নিয়ম স্বামীর আগে খেতে নেই।
আজ কোটাল পুকুরের পাশে যে বাঁশঝাড় আছে সেখানে বাঁশ কাটতে গিয়েছিল রাসমণি। এই বাঁশ শুকালে রান্নার সুবিধা। বাড়ির পুরুষ মানুষ দের কাজটা ও এখন রাসমণির ঘাড়ে। তবে একা একা কাজ করতে করতে তার মনের ভিতরে কে যেন বলে “রাসমণি! তুই সব পারবি। মানুষ সব পারে”।
কোটালপুকুরে মাছ ধরছিল সহায়হরি। খুব সাদাসিধে এই সহায়হরি। জমি জায়গার দালালি করে কমিশন পায়। আর পুকুরের মাছ ধরে। কথায় কথায় বললে “বউঠান। ঘোষেদের এক প্লটে আট বিঘে জমি আছে। ওরা বিক্রি করবে। তা তোমার বাপের বাড়ির অবস্থা তো শুনেছি খুব ভাল। ধনীলোক। আমাদের নরেশটা বাউন্ডুলে। জমিটা রাখতে পারলে তোমার অলাভ হবে না। আর আমার সংসারেও দুপয়সা আসবে।”
সহায়হরির কথায় মৃদু হাসে রাসমণি। বললে “হরি দাদা। মেয়েদের বিয়ের পর শ্বশুরের ভিটেটাই স্বর্গ। আর ওতে তোমার ভাই এর অমর্যাদা হয়।”
হরি তবু বলেছিল “বাচ্চাদের মুখ চেয়ে বললাম বউঠান। যদি হয় বোলো। এসব কথা পাঁচকান কোরো না। দুরাত্মার অভাব নেই। তাদের ছলের ও অভাব নেই “।
আজ তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে গলায় কাপড় জড়িয়ে গড় হয়ে পেন্নাম করতে করতে চোখের জলে ঠাকুর কে বললে রাসমণি “হে তুলসীর তলা। কত যুগ ধরে এই বংশ তোমায় পুজো করছে। পূর্বপুরুষ দের মতো তুমিও সত্য। তুমি আমাকে সঠিক পথে নিয়ে চলো। আমার সন্তানেরা যেন দুধে ভাতে থাকে ঠাকুর।
রান্না করতে করতে একটা বুদ্ধি মাথায় এল। শীতের দিনে কাঠের উনুনের পাশে বসলে বেশ লাগে। ডাল সাঁতলে ফুলকপি ভাজতে লাগল রাসমণি। নুন আর হলুদ দিয়ে লাল করে ভাজলে। বড়ো ছেলেটার খাওয়ার মুখ হয়েছে ভালোই। একটা বাটি নিয়ে এসে বললে
“আমাকে ফুলকপি ভাজা দাও। খাবো আমি”।
সামান্য কপিভাজা। তাই নিয়ে লেগে গেল হুলুস্থূল। কথায় আছে যাকে দেখতে নারি তার চলন ব্যাঁকা। বড়োবউ এর মুখ নয় যেন ক্ষুর। বললে
“হ্যাঁ লা ছোটোবউ! আমাদের বংশের কোনও ছেলেকে এমন আদেখলা হতে দেখি নি। একি তোর ছেলে মানুষ করার ছিরি। সবেতেই অত নোলা ভালো নয়। অমনি বাটিভর্তি করে ছেলেকে খাইয়ে দিলি! কে খেলো কে না খেলো কোনও দেখাশোনা নেই তোর?
পয়সা খরচ করতে তো হয় না। বিনিপয়সার সংসার পেতেছো। দিব্যি সোয়ামীকে নিয়ে সুখের সমুদ্রে ভাসছো। আর আমাদের কর্তারা বোকার হদ্দ। পাগলেও নিজের ভালো বোঝে। ভাই ভাই করে শেষ হয়ে গেল। ওদের চেহারার দিকে তাকাতে পারি না।”
রাসমণির মনে হল মাটিটা দ্বিধা হলে ও ঢুকে পড়ে। নিদারুণ কষ্টে সেদিন ওই দুধে বালক ছেলেটাকে বাখারি দিয়ে পেটালে রাসমণি। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ল। রান্নার পর সব খাবার রান্নাশালে রেখে দিলে রাসমণি। না না। এমন অপমানের অন্ন সে স্পর্শ করবে না। রাতের অন্ধকারে ঘরে কুপি জ্বালিয়ে দেখলে ছেলেটার গায়ে বাখারির দাগ। হাত বুলাতে বুলাতে ডুকরে কেঁদে উঠল রাসমণি।
রাত গভীর হয়। এখনও স্বামী ফেরেনি। চোখ যায় তিজোরির দিকে। এতদিন নিজেকে অসহায় ভেবে এসেছে। আজ মনে হল আমার গয়নাগুলো আছে। বাবা রামকালী চাটুজ্জে বলতেন “গয়না হল স্ত্রীধন। সময়ের আভরণ আবার অসময়ের পেটভরণ। “
আজ রাসমণির মাথার মধ্যে নতুন আলোর ঝলকানি এসেছে।
রাসমণি গয়নাগুলো বার করলে। তারপর শিশুদের মুখের দিকে তাকালে। মনে হল শিশুদের ঘুমন্ত মুখের থেকে এই গয়না অনেক তুচ্ছ। কাল সহায়হরি দাদার সাথে দেখা করতে হবে। ঘোষেদের এক প্লটে আট বিঘে জমি কিনবে রাসমণি। মনে মনে বললে তোদের মা আছে ।তোদের আবার কিসের ভয়। নিজের সন্তানের ভবিষ্যত মা তৈরি করবে।
অনেক রাতে নরেশ এল। বললে “খাবার কোথায়?”
রাসমণি বললে “তোমার খাবারের জোগাড় আমি কেমন করে করব? আমি তো আমার সন্তানের মুখেই খাবার দিতে পারি নি”।
নরেশ চুপ করে গেল। চোখে মুখে তার ভাঁজ। বাচ্চাদের মুখে আজ খাবার ওঠে নি। এতো ভয়ঙ্কর কথা।
ভোরের আলো সবে ফুটেছে। ঘুম ভেঙে গেল রাসমণির। কিন্তু অবাক কান্ড। নরেশ নেই। এই ভোরে সে কোথায় গেল কে জানে? সত্যিই মানুষটার লজ্জার বালাই নেই। রাসমণি উঠে প্রাতকৃত্য সেরে দক্ষিণপাড়ার দিকে গেল। ওখানেই সহায়হরির বাড়ি।
সহায়হরি এত ভোরে বউঠান কে দেখে অবাক হয়ে গেল। বললে “কী সৌভাগ্য আমার। আমার বাড়িতে আজ স্বয়ং মা লক্ষ্মীর আগমন ঘটেছে “।
সহায়হরি গরু পোষে। একটা ঘটি করে এক ঘটি দুধ রাসমণির হাতে দিয়ে বললে
“অধমের আর কী আছে গো মা। এটুকুই দিলাম। তোমার ছেলেদের খাইয়ো”।
রাসমণির চোখ ছলছল করে উঠল। কাল থেকে তার নাড়ি ছেঁড়া ধন অভুক্ত। বললে
“হরি দাদা। আমার একটা কাজ করতে পারবে। আমার গয়নাগুলো আমি বন্ধক রাখতে চাই। ওগুলো আমার নিজস্ব। “
সহায়হরি বললে “এ কেমন কথা বলছো বউঠান। গয়না বন্ধক কেন দেবে!”
রাসমণি উত্তর দিলে “ঘোষেদের আটবিঘে জমি কিনব। তাই”।
সহায়হরির চোখ চিকচিক করে উঠল। বস্তুত এই বউঠান কে সে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। আজ যেন শ্রদ্ধার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। বললে
“আজ দুপুরে গয়না নিয়ে এসো। মাঝেরপাড়াতে দীনবন্ধু তেজারতি ব্যবসা করে। সেখানেই নিয়ে যাবো। তবে নরেশ কি জানে এসব। কোনও অশান্তির সৃষ্টি হবে না তো!”
রাসমণির ওসব কোনও চিন্তাই নেই। বললে “মাটি কিনছি। ফসল ফলবে। গয়নার সদ্গতি হবে। আমি অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর সবাই বিছানা নিয়েছে। খিড়কির দরজায় সহায়হরি এল। আস্তে করে ডাকল “বউঠান! অ বউঠান। চলো। সবকিছু সামলে নাও”।
একটা চাদরের ভিতর গয়নার পোঁটলা নিলে রাসমণি। বিয়ের পর কয়েক বার পরেছিল গয়নাগুলো। তারপর তোলাই আছে। রাসমণির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। একটা কঠিন সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিচ্ছে।
দীনবন্ধু সব গয়না বন্ধক রাখলে। অনেক টাকা পেলে রাসমণি। সাক্ষী শুধুই সহায়হরি। কিন্তু এই টাকা ঘরে বেশিদিন রাখা ঠিক হবে না। তখন বিকেল হয়েছে। রাসমণি বললে “হরি দাদা। ঘোষেদের আটবিঘে জমির দলিল একবার যাচাই করব। তারপর বায়না দিয়ে রেজিস্ট্রি করব”।
সহায়হরির আনন্দ বাঁধ মানে না। শুধুই বললে “এসব কাক পক্ষীও যেন ঘুনাক্ষরে জানতে না পারে”।
বিকেল হয়ে গেলে বাড়ির সবাই লক্ষ করলে রাসমণি নেই। দুই জা আলোচনা করতে লাগল। কোথায় যেতে পারে সম্ভাব্য স্থান আন্দাজ করতে পারছে না। গতকাল তাকে দুকথা শোনানোর পর আত্মপ্রসাদের প্রসন্নতা লাভ করেছিল ওরা।আজ গভীর সন্দেহ দোলায় দুজনে দুলতে লাগল। কাল থেকে নরেশ উধাও। কী করতে চাইছে এরা!
সন্ধ্যাবেলায় রাসমণি বাড়িতে ফিরে আলতা পেড়ে শাড়িখানা পরলে। ঘটে গঙ্গার জল নিয়ে চৌকাঠে সদরে ছটা দিলে। সবার ভালো হবে ভেবে তুলসীর বেদীমূলে প্রদীপ জ্বালালে। মনে মনে কে যেন ওকে বললে
“মানুষ সব পারে রাসমণি। সব পারে। মানুষের অনেক ক্ষমতা। শুধুই ঘুমিয়ে আছে এই মাত্র”। রাসমণির ঘুম ভেঙেছে। কোনও বাধা তাকে আটকাতে পারবে না।
রাত হল। কিন্তু নরেশ এখনও ঘরে ফেরেনি ।আরও এক দুশ্চিন্তার মধ্যেই পড়ল রাসমণি। কখনও তো এমন করে না। সেই যে সেদিন বের হল আর এলো না। এদিকে বাড়িতে এতগুলো টাকা। শত্রু তো ঘরেই। ভীষণ ভয় খেতে লাগল রাসমণি।
বাড়ির লোকজন বললে “নরেশ বাড়িছাড়া হয়েছে। অমন ঢেউনাচানি পাড়াবেড়ানি বউ। তাকে নিয়ে ঘর সংসার চলে না”।
সেদিন রাতে আশ্চর্য কাণ্ড ঘটলো। তুলসীর মূলে প্রদীপ জ্বেলে রান্না করতে আসবে রাসমণি। কিন্তু আজ দুই জা রান্না করছে। কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাসমণি। ওরা ডাকলে না। কথা বললে না।রান্না করে সব খাবার নিয়ে চলে গেল। উনুন এর মধ্যে ছাই চাপা আগুন। রাসমণির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কী করবে ও? ওদের দালান কোঠাতে ওরা খাচ্ছে। আর রাসমণি মুড়ি আর চিনি দিয়ে ছেলেদের পেটের চাহিদা মেটাল। ওরা কাঁদছে। ভাত চাইছে ওরা। রাসমণির একটা বাসন নেই। চাল কিনতে এত রাতে কোথায় বা যাবে?
ও বাড়ি থেকে উঁকিঝুঁকি চলছে। কী করে রাসমণি ওরা দেখবে। ছেলেরা ঘুমিয়ে গেলে রাসমণি তুলসীর মণ্ডপে এসে বসে। একটা অনির্দেশের পথে পা বাড়াতে হবে এবার। হঠাৎই বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল নরেশ। এ কী রূপ! ন্যাড়া মাথা। গলায় তুলসীর মালা। কেমন যেন অন্যরকম। একমুখ হেসে বললে “মায়াপুর গিয়েছিলেম। প্রায়শ্চিত্ত করলাম। মস্তকমুন্ডন করে দীক্ষা। আর বাইরে মন নয়। এবার আমাদের সংসার চলবে রমরমিয়ে”।
হাঁ করে চেয়ে থাকে রাসমণি। এ আবার কী ভাবান্তর! নরেশ হাসতে থাকে। বলে “কী ভাবছিলে? তোমাকে ছেড়ে পালিয়েছি?”
রাসমণির কোনও সাড়া নেই। নরেশ বললে “ছেলেদের খাওয়া মিটেছে”?
রাসমণির এবার চোখের জল বাগ মানলো না। বললে বাছারা আমার না খেয়ে আছে। এখনই ব্যবস্থা করো”।
সব শুনে নরেশ অবাক হয়ে যায়। এমন হতে পারে মানুষ। পৈতৃক সম্পত্তির আয় তো আছে। তবুও এরকম ব্যবস্থা। বেশ! এবার সে নিজের অংশ বুঝে নেবে।”
নরেশ হাঁড়ি কিনলে। চাল কিনলে। কিছু সব্জি কিনলে। সেই রাতেই আবার উনানে হাঁড়ি চড়লো। ছেলেরা ঘুম থেকে উঠে পেট ভরে খেল। তারপর নরেশ আর রাসমণি খেতে বসল। এখনই জমি কেনার কথা নরেশ কে জানাবে না রাসমণি।
পরের দিন নরেশ বাড়ি থেকে বের হওয়া তো দূরের কথা, ঘরের কাজে মন দিল। বড়বউ বললে “আজ কোন দিকে সূর্য উঠেছে ঠারপো। এতো দেখছি আশ্চর্য ব্যাপার “।
নরেশ গম্ভীর হয়ে বললে “দাদারা বাড়িতে এলে বোলো। আজ সম্পত্তির হিসাব বুঝে নেবো। এতদিন ভাবতাম মাথার উপরে তোমরা আছো। কিন্তু এখন সন্তানের ভবিষ্যত বুঝে নিতে হবে। সংসার যখন পেতেছি”।
বড়বউ নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। দিব্যি বাউন্ডুলে ছিল। ওর ভাগের জমির ফসল নিয়ে সামান্য খাওয়া পড়ায় কাজ মিটে যাচ্ছিল। খুব ভুল হয়ে গেল চালে। এখন যে করে হোক এদের থামাতে হবে। নাটক করে কাঁদতে লাগল বড়বউ। বললে
“আমরা একান্নবর্তী সংসারে আছি। একসাথে থাকতে গেলে থালা বাসনেও ঠোকাঠুকি হয়। না না। তাই কখনও হয় নাকি। আমরা কেন ভেন্ন ভাতে পাড়াপড়শি হতে যাবো? আর ছোটোবউ সাক্ষাত অন্নপুন্নে। ওর হাতের রান্নার সোয়াদটাই আলাদা।”
রাসমণি বুঝতে পারলো এর পিছনে আসল কোন উদ্দেশ্য কাজ করছে। তবে এখন সে কিছুই বলবে না। চুপচাপ আবার সকলের রান্না করতে লাগল। গৃহকাজে নরেশ সাহায্য করতে লাগল। তবে একবার হাঁড়িতে ভাঙন ধরলে তাকে আটকানোর সাধ্য বিধাতার নেই।
নরেশ ভাবলে নিজের জমিটুকু পেলে সে চাষ করবে। নইলে বেকার বাউন্ডুলে নাম ঘুচবে না। কয়েকদিন পর দাদাদের কাছে গিয়ে বললে “আমার জমি আমি নিজেই চাষ করতে চাই। আমার দশ বিঘে জমি বুঝিয়ে দাও”।
দাদাদের কিছুই করার থাকে না। বললে “বেশ। তাই হোক। জমি যেহেতু বাপুতি সম্পত্তি সেখানে ওজর আপত্তি চলে না। তবে এতদিন তোমরা আমাদের সংসারে প্রতিপালিত। তাই দুই বিঘা কম পাবে। আর ভিটের ভাগ বলতে মাটির ভিটে তোমার “।
নরেশ বললে “দশবিঘে জমির ফসল সংসারে ঢুকলো সেই হিসেব টা কী দেবে”?
দাদারা আমতা আমতা করে। কী বলবে বুঝতেই পারে না। বললে “তাহলে কী ভেন্ন হতে চাও!”
বড়বউ আর মেজোবউ বললে “ভালোই আইন শিখেছো। আইনবাজ শ্বশুর, তার আইনবাজ মেয়ে বউ কি না”!
রাসমণির কানে এল কথাটা। সে গিয়ে বললে “যার জমি সে দানপত্র করে স্বর্গে গেছে। এখন কী করে দুবিঘে জমি নেবেন? আইনে তা বলে না।”
হাঁ করে তাকায় সবাই। দানপত্র দলিল নরেশকে দেয় ওর বড়দাদা। বলে বেশ। তোর সম্পত্তি তুই চাষ করে খা। “
দলিল নিয়ে নরেশ ঘরে আসে। বাক্সে দলিল রাখতে গিয়ে দেখে লক্ষ লক্ষ টাকা। কোথা থেকে এল এই টাকা। ঠিক সেইসময় সহায়হরি আসে। ডাক দেয় “বউঠান। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি আসবে। তুমি তৈরি হয়ে নাও”।
নরেশ আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য হয়ে গেল। বললে “হরি দাদা। তোমার বউঠান কোথায় যাবে?”
সহায়হরি বুঝতেই পারে নি যে নরেশ এই সময় বাড়িতে থাকবে। বললে “কেন? তুমি কিছুই কি শোনো নি ? বউঠান কিছুই বলে নি”?
নরেশ না সূচক মাথা নাড়ে। বাস্তবিক সে কিছুই জানে না।
কিছুক্ষণ পর গাড়ি আসে। বাক্সে রাখা টাকা নিতে গেলে নরেশ বলে “এই টাকা কোথা থেকে এলো? তুমি কোথায় চললে”?
রাসমণি বললে “এ টাকা আমার নিজস্ব। আমি জমি কিনব। আজ দলিল হবে। আট বিঘে জমি।”
নরেশ বললে “সেটাই তো জিজ্ঞেস করলাম। টাকা কোথা থেকে এলো? “
রাসমণি বললে “আমার গয়না বন্ধক দিয়েছি”।
নরেশ চিৎকার করে উঠল “তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এখন সেসব গয়না ছাড়াবে কী করে? আর এতকিছু করেছো আমাকে জানাবার প্রয়োজন মনে করোনি। এতে আমার সম্মান নষ্ট হয়”।
রাসমণির চোখদুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। বলল “এতদিন পর কী ঘুম ভাঙলো তোমার। এত জোরে চিৎকার করে পৌরুষত্ব না দেখাতেই পারো। সংসার কোনও যাত্রাপালা নয় বুঝেছো। আর যা বলার আমি এসেই বলব। এখন শুভ কাজে যাচ্ছি। যে মায়ের সন্তান না খেয়ে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে সেই মা গয়না পরে পটের বিবি সাজতে পারবে না”।
ঘোষেদের বুড়োকর্তা মরেছে। যতদিন কর্তা বেঁচেছিল জমি কেউ বিক্রি করতে পারে নি। ওদের ছেলেরা এখন চন্দননগরের বাসিন্দা। গাঁয়ে ঘরে থাকবে না ওরা। ধান রোয়া জমি বিক্রি করছে ওরা। সহায়হরি বললে “বউঠান। কদিন পরেই ধান উঠবে। ওটা তোমার বিরাট লাভ। “
রেজিস্ট্রি হয়ে গেল জমি। রাসমণির খুব আনন্দ হল। একহাঁড়ি রসগোল্লা কিনলে বাড়ির জন্য। এদিকে সহায়হরির সাথে যখন সে গাড়িতে উঠল তখন দুই বউ নরেশের কাছে এসে বলতে লাগল “হ্যাঁ ঠারপো। ছোটোবউ এর দেমাক দেখলে। তা পরতা বেটাছেলের সাথে কোথায় গেল বলো দিকিন। কদিন থেকেই ভাই গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর চলছে। বলি ও কি বাপের বাড়ি গেল নাকি?”
নরেশ চুপ করে থাকে। বাপের বাড়ির কথায় সম্বিত ফিরে পায়। বললে “ঠিকই বলেছো। ওর বাপের বাড়ি আমিও যাবো। শ্বশুর মশাইকে সব জানানোর প্রয়োজন “।
নরেশ বেরিয়ে গেল। বিকালে রাসমণির প্রত্যাবর্তন দেখে দুই বউ হাঁ। বললে “কী ব্যাপার! ঠারপো যে তোমার বাপের বাড়ি গেল। সে কী থেকেই গেল শ্বশুর বাড়ির আদর খেতে।
রাসমণির বুঝতে বাকি থাকলো না যে আকাট নরেশ তার বাবার কাছে গয়নার কথা বলতে গেছে। তা যাক। আজ মনটা তার খুশিতে ভরে গেল। একটা পরিবর্তনের হাওয়া যেন তাকে বদলে দিল।
সন্ধ্যার সময় আজ তুলসীর পুজো করবে রাসমণি। সন্ধ্যার কত মাহাত্ম্য। পিতামহ ব্রহ্মার একমাত্র কন্যা সন্ধ্যা। যখন তার দাদা মদনের সাথে রতির বিয়ে হল তখন স্বয়ং ব্রহ্মা পাঁচটা বাণ দিয়েছিল মদনকে। মদন তখন কামদেব। আর ওই বাণ পিতা ব্রহ্মার উপর প্রয়োগ করলে সামনের কন্যা সন্ধ্যার দিকে দৃষ্টি গেল পিতার। সাথে সাথেই কালো হয়ে গেল সন্ধ্যা। তখন ব্রহ্মা বর দিলেন কন্যাকে। দিনের শেষে তুই যে ঘরে যাবি সেখানেই আলো দিয়ে প্রদীপ জ্বেলে তোকে অভিনন্দন জানাবে প্রতিটা ঘর। আর সেই ঘর সুখ সমৃদ্ধিতে ভরে যাবে।
রাসমণি আজ ঘিয়ের প্রদীপ জ্বাললে। আরতি করলে তুলসীদেবীকে। প্রদক্ষিণ করলে তুলসীর গাছ। বড়োবউ আর মেজোবউ বললে “আদিখ্যেতা দেখলে বাঁচি না”।
সন্ধ্যার পুজো সেরে রান্নাঘরে গেল রাসমণি। আজ মাংস রান্না করবে। রেজিস্ট্রি হল আজ। সবাই কে মাংস রান্না করে খাওয়াবে আজ।সাথে রসগোল্লা।
বাড়ির উঠোনে লঙ্কা গাছে কুললঙ্কা হয়েছে। কী ঝাল এই লঙ্কার। সেদিন যখন রাসমণি আলুসিদ্ধ দিয়ে মুড়ি খাচ্ছিল তখন ও খেয়েছিল। বাপরে বাপ।ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গিয়েছিল। আজ আটটা লঙ্কা তুলল।
একটা বাটিতে লঙ্কা চিরে রেখে পেঁয়াজ কুটছিল রাসমণি। অনেকটা মাংস। পেঁয়াজ তো লাগবেই। বড়ো বড়ো করে আলু কাটা। তাতে জল দিলে। দারুচিনি, লবঙ্গ আর এলাচ নিলে কয়েক টা। শিলে আদা রসুন বাটতে হবে। মাংস রান্নার অনেক ফিরিস্তি। বড়োবউ তক্কে তক্কে ছিল। এ বাড়িতে এসে বললে “কী রান্না করবি জিজ্ঞেস করলি না অথচ রান্নার আয়োজন। কী ব্যাপার ছোটোবউ “?
ছোটোবউ বললে “সবার জন্য মাংস এনেছি দিদি। আসার পথে দেখলাম খাসি কেটেছে হাটে। কেজি তিনেক নিলাম। “
দুইবউ মুখ তাকাতাকি করতে লাগল। বললে “সে তো অনেক দাম। কোথায় পেলি এত টাকা? তোর বাবা নিশ্চয়ই দিল!”
বড় হাঁড়িতে মাংস চাপিয়েছে রাসমণি। গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সহায়হরি আজ এখানে খাবে।দুই জা কাজে হাত দিয়েছে। কত মিষ্টি তাদের ব্যবহার। গোটা পরিবার যেন হরিপদ আত্মা। শুধুই নরেশ এখনও আসে নি। আশ্চর্য মানুষের সাথে সে ঘর বেঁধেছে বটে।
আজ দুই দাদা মাটির বাড়িতে উঠে এসেছে। মাটির রোয়াকে বসে রেডিও শুনছে। কতদিন এ বাড়িতে মাংস হয় নি।রাসমণির আনন্দ ধরে না। তবুও চিন্তা করে কী এমন হল সবাই আজ এত ভালো হয়ে গেল কী করে! ওরা কী জেনেছে ছোটোবউ আটবিঘে জমি কিনেছে। তাই তার সমাদর বেড়ে গেছে। কে বলল ওদের। নিশ্চয়ই নরেশ বলেছে।
রাতে সবাই হৈ হৈ করে খেতে বসলে। রাসমণির মাটির উঠানে হ্যাচাক জ্বেলেছে সহায়হরি। সত্যিই সে সহায়হরি বটে। কিন্তু সেই সময়ই নরেশ প্রবেশ করল। কিন্তু সঙ্গে বৃদ্ধ রামকালী চাটুজ্জে। বাবাকে অনেক দিন পর দেখে রাসমণি ছুটে এগিয়ে এল। রামকালী চাটুজ্জে বললে “কী লক্ষ্মীর শোভা এই মাটির ঘরে। সবাই কেমন একসাথে আছো। তুলসীর তলা কত সুন্দর, আলোকিত। জামাই এর মুখে শুনলাম তুমি গয়না বন্ধক দিয়ে জমি কিনেছ। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। তবে গয়নাগুলো আমি ছাড়িয়ে দিতে চাই। পরিবারের এই অবস্থার মধ্যে জমি কেনা খুব প্রয়োজন ছিল “।
রাসমণির মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে গেল। পারিবারিক অভাব অভিযোগ এর কথা সে তো কখনও বাবাকে বলে নি। তবে কী নরেশ সব বলে দিল। তবুও সাহসে ভর করে বললে “কী অবস্থার কথা তুমি বলছো বলো তো বাবা। আমি তো ভালোই আছি”।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রামকালী বললে “নরেশ এর দুই দাদার চাকরি আর নেই। দেশের স্বাধীনতার সাথে ওদের কোম্পানি লাটে উঠেছে। কেন! তুমি এসব শোনেনি? রাসমণির মুখে রা কেড়ে না।
গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ। রাসমণির কাছে সব পরিস্কার হয়ে গেল। এখন চাষবাস ই ভরসা।
আজ রাসমণির বয়স হয়েছে। যৌবনের সেই দিন গুলোর কথা মনে হলে একটা কথাই তার মনে হয় “মানুষ হল সম্পদ। তার অসীম শক্তি। “
সারাজীবন ফসল ফলায় মানুষ। তারপর রাশি রাশি ধান ওঠে খামারে। ধান মানেই ধন। পৃথিবীর মানুষ শুধুই ফসল নেয়।সব নেবে। কীর্তি, যশ সব।শুধুই দিন ফুরালে নতুনের হাতে সব তুলে দেওয়া।পূর্বপুরুষ থেকে যাবে ওই তুলসীরতলার মতো অকুণ্ঠবিশ্বাসে।যুগ পাল্টাচ্ছে। নতুন যুগের উষারাণী খিলখিল করে হাসছে। রাসমণির অসমাপ্ত গল্প নতুন দিনের ঊষারাণী শোনাবে। এসব ভাবতে ভাবতেই বৃদ্ধা রাসমণির চোখে আঁচলের খুট চলে যায়। চোখ মুছে ঊষারাণীর হাসি দেখে রাসমণি। সেই আটবিঘে জমি কেনার পর যখন সোনার ধান উঠেছিল তখনও এই হাসির টোল পড়েছিল প্রতিটি ধানের শীষে।নতুন এই ভাবেই ধরা দিক। ষষ্ঠীর পুজোর পর তুলসীর মূলে দীপ জ্বেলে দেয় রাসমণি।