শান্তিভবন চত্ত্বরে সবে সন্ধ্যে নামবে নামবে করছে। তপ্ত দুপুরের গরমের পরে একটু মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়া ছেড়েছে। রবিবার। ঘড়িতে কটাই বা বাজে, সাড়ে পাঁচটা কি পৌনে ছটা। বিষ্টুদার চায়ের দোকানে সবে ভীড় জমতে শুরু করেছে। চলছে বিষ্টুদার রোজ পাঁচালি, “এই দেশটা গোল্লায় গেলো। সব নেতাগুলো শালা বজ্জাত। বিষ্টুদার বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। এই চা দোকানটা তার পিতৃসূত্রে পাওয়া। প্রথমে তার বাবা এই দোকানটা চালাতো। তাও বছর চল্লিশেক হবে। তারপর হরির হঠাৎ মৃত্যুতে তাঁর বড়ছেলে বিষ্টু এই চা দোকানের হাল ধরেছে। আগে ছিল বেড়ার দোকান এখন ফ্ল্যাট হয়েছে।রোজকার মত পচাদা, হোঁদলা আর ভোম্বল বিষ্টুদার চায়ের দোকানে এসেছে সান্ধ্যকালীন চা সহযোগে একটা নিখাদ আড্ডার উদ্দেশ্য নিয়ে। সেদিন পচাদাই চায়ের অর্ডার দিয়েছে। তিনটে ছোট। পচাদা একসময় এতৎঞ্চলের ডাকসাইটের দাদা ছিল। পচাদার বয়সও ৫৯, ৬০ হবে। তাঁর কথায় বহু কেষ্টবিষ্টু ওঠাবসা করতো। এখন বয়সের ভারে আর রাজনৈতিক পালাবদলের জন্য একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। সুঠাম দেহটাও যথেষ্ট ভাঙন ধরেছে। চোখে চশমা উঠেছে। নেকটাইট গেঞ্জির থেকে হাতের গুলিও বেরিয়ে থাকে না। কথাবার্তাও কেমন মিইয়ে যাওয়া মুড়ির মত হয়ে গেছে। পচাদার চা দোকানের বেঞ্চে একটা সবুজ ফতুয়া আর সাদা পায়জামা পরে বসে রয়েছে। ভোম্বল পাশে বসা। হোঁদল দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভোম্বল আর হোঁদল পচাদার বহুদিনের সঙ্গী। বয়সও নেহাৎ কম হয়নি। ভোম্বলের ৫০ আর হোঁদলের মেয়ে সেদিন হোঁদলের ৪৫ বছরের জন্মদিন পালন করলো।
তা এহেনও সান্ধ্যকালীন চায়ের আসরে- চায়ে একটা আলগা চুমুক মেরে পচাদা বললঃ “ধরে নে পার্টি করে হঠাৎ বড়লোক হয়ে গেছে কোনো লোক, তাকে কিভাবে চিনবি?
ভোম্বল থমকালো দেখে পচাদা-ই শুরু করল,
“প্রথমেই দেখবি গলায় একটা মোটা কাছির মতো সোনার চেন এবং জামার ওপরের তিনটে বোতাম খোলা।
২) ডান হাতে একটা মোটা রিস্টলেট থাকবেই।
৩) দশ আঙ্গুলে দশটা আংটি।
৪) জামায় কড়া পারফিউম বা আতরের গন্ধ।
৫) একটা বুলেট বাইক (জোরে আওয়াজ সহ)।
৬) ঠোঁটের যে কোনো কোণে একটা সিগারেট।
ঠিক এইসময় চায়ের দোকানের সামনে ভুঁচকিদার বুলেট এসে থামল। মাথায় হেলমেট নেই, ঠোঁটের কোণে দামী সিগারেট, জামার খোলা বোতামের মধ্যে দিয়ে মোটা সোনার হারের ঝিলিক! হুবহু পচাদার ডেফিনেশন!!! একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ভুঁচকিদা পচাদাকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা পচা, ধারেকাছে ভালো কোনো অঙ্কোলজিস্টের খোঁজ দিতে পারিস?”
পচাদা চমকে তাকাল, “কেন, কার কি হল আবার?”
ভুঁচকিঃ- “নাহ, কারো কিছু হয় নি! আসলে আমার ছেলেটাকে কেউ যদি একটু অঙ্কটা দেখাত … “
একটু সামলে নিয়েই পচাদার সুপার জিনিয়াস সাজেশন, “তাহলে ফিজিক্সের জন্যে সঙ্গে আর একজন ভালো ফিজিসিয়ানও দেখি ?” ভুঁচকিদা নির্লিপ্ত নির্বিকারভাবে বললো, “না ফিজিক্সটা দেখানোর জন্য জনের মা একজন ভালো ফিজওথেরাপিস্টের সাথে কথা বলেছে। মাসে ৩০০০/- করে নেবে।” পচাদাও কম যায় না, বললো, “তা ভুঁচকি, অঙ্কোলজিস্টকে কত মাইনে দেবে ঠিক করেছো?” ভুঁচকিদা:- ওই হাজার দুয়েকের মধ্যে। পচাদা:- তা ভুঁচকি ফিজওথেরাপিস্টের থেকে তো অঙ্কোলজিস্টের চার্জ বেশি। তা তুমি ফিজিওথেরাপিস্টকে তিন হাজার আর অঙ্কোলজিস্টকে দুই হাজার দেওয়ার মতলব করেছো কেন? ভুঁচকিদা:- আসলে ফিজিওথেরাপিস্ট বৌকে বলেছে প্রতিদিন আসবে। আর আমার জনের অংকের মাথাটা বরাবরই ভালো। তাই ভাবছি অংকটা সপ্তাহে দুদিন করাবো। তাই আর কি? হেঃ! হেঃ! ভোম্বল (পাশ থেকে):- ভুঁচকিদা জন তো মাধ্যমিকে অংকে ডাব্বা মেরেছিলো। তাই না? ভুঁচকিদা:- কি যাতা বলছিস ভোম্বল? জেনেশুনে বল। জেনেশুনে বল। ওটা আমার ভাই পুঁচকির ছেলে ল্যাব। ভোম্বল সত্যিটা জেনেও চুপ মেরে গেলো। পাছে চড়থাপ্পড় খায়।
ভুঁচকিদা ইতিমধ্যে দ্বিতীয় সিগারেটটাও শেষ করে, কাউন্টারটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে, একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বুলেটটা বিকট শব্দে স্টার্ট দিয়ে:- আর হ্যাঁ, পচা! পারলে একটা ড্রাগিস্টেরও খোঁজ দিস। ছেলেকে কেমিস্ট্রিটিও তো পড়াতে হবে।
পচাদা, ভোম্বল, হোঁদল ঘাবড়ে ঘোড়া হয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ভুঁচকিদার দিকে তাকিয়ে থেকে স্বগতোক্তি করলো:- শালা! এই অশিক্ষিত চামারটা ছেলেকে পড়ানোর নামে বাড়িটাকে হসপিটাল বানিয়ে ছাড়বে।
ততক্ষণে ভুঁচকিদার বাইক গর্জন করতে করতে তিনমাথার মোড় পেরোচ্ছে।