প্রিয়দর্শী
*******
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
বসন্তের মনোরম প্রভাতকাল। উত্তরাপথে মৃদুমন্দ মলয়পবন বয়ে আনছে আসন্ন মদনউৎসবের মন্মোহিনী আমেজ। আকূল বসন্তসখ কূজনে মত্ত। মসৃণ কৃষ্ণকায় প্রস্তররাজির মধ্যে মধ্যে রক্তপলাশের অগ্নিময় উপস্হিতি নাগরিকাদের মন উন্মনা করে তুলেছে। পক্ষকাল পূর্বে রাজধানী মগধ থেকে সপ্তাশ্ববাহী শকটে প্রিয়দর্শী এখন উজ্জয়িনীর পথে প্রজাসম্মীলনের উদ্দেশ্যে। বৎসরের এক একটি ঋতু এক একটি জনপদে প্রজাসম্মেলন করে প্রজারঞ্জনের পরিতুষ্টিবিধানে তিনি সচেষ্ট। প্রিয়দর্শী বর্তমানে পঞ্চশীল তত্ত্বে অভ্যাসী। কলিঙ্গবিজয়ের পর থেকেই তিনি তথাগতের স্মরণাগত। অস্ত্র, আক্রমণ আর রুধির স্রোত তাঁকে বর্তমানে বিব্রত করে। চন্ডমূর্তির রুদ্রপ্রতাপ পরিত্যাগে তিনি এক্ষণে ধীর ও মৃদুভাষী। অন্তরের মধ্যেও তিনি অনুভব করেন পূর্বের মনোবিকলনের অবসান।
*****
তপ্তকাঞ্চন বর্ণের মুখমন্ডল তাপের নিমিত্ত স্বেদবিন্দুময়। প্রিয়তমা ভার্যা দেবীকার সঙ্গলাভে প্রিয়দর্শী কিঞ্চিৎ উন্মুখ। বেসনগরীর নাগরিকা তিনি, ধনীক শ্রেষ্ঠী তন্ত্রপালের কন্যা। ষোড়শমহাজনপদের এই অংশে প্রথমবার পদার্পণ তাঁর। তাঁর এই নিয়ে চতুর্থবার পাণিগ্রহণ কি শুধুই কূটনীতিকের রাজনৈতিক অভীপ্সা রক্ষা না কি এই বসন্তমঞ্জরীর নবনীত মৃণালভূজ আশ্রয়ের দূর্জেয় আকাঙ্খা তা আপাতত অকথিতই থাক! এক্ষণে পথশ্রমে তিনি শ্রান্ত। প্রধান অমাত্য গ্রন্হীক একটি মৃৎপাত্রে শীতল তক্র তাঁর পানের জন্য সম্মুখে ধারণ করেন। অদূরে স্বচ্ছতোয়া বেসনদীর জলরাশি রৌদ্রালোকে ঝিকিমিকি করে ওঠে। গন্তব্য সমাসন্ন প্রায়।
*****
শ্রেষ্ঠীর প্রাসাদে আজ লোকারণ্য। প্রিয়দর্শীর আগমনে নগরীতে মদনউৎসবের প্রারম্ভ হয়েছে। পুরনারীবৃন্দ পুষ্পহারে আজ বসন্তদূতীকার ভূমিকায়। নৃত্যগীতে রাজপথ মুখরিত। নগরের তোরণ স্বর্ণাদি ধাতুর শৃঙ্খলে ইন্দ্রপুরীসদৃশ সুসজ্জিত। একটি অনুচ্চ শৈলচূড়ায় শ্রেষ্ঠীর প্রাসাদ। সম্প্রতি সিংহল থেকে বাণিজ্য শেষে প্রত্যাবর্তন করেছেন তিনি। প্রচুর স্বর্ণ,রত্ন, মশলা ও মৃগনাভী এবার তাঁর সংগ্রহে।
*******
প্রিয়দর্শীকে একটি হীরকখচিত ধর্মচক্র প্রদান করে নিজ ভবনে স্বাগত জানান শ্রেষ্ঠী। একশত পরিকর ও একশত মনোরঞ্জিকা নিযুক্ত করেন প্রিয়দর্শীর পরিচর্যায়। সন্ধ্যায় গন্ধর্ব সুষেণের সুললিত সংগীত ও অপরূপ নৃত্যপটিয়সী মঞ্জুলিকার নৃত্য সহযোগে প্রিয়দর্শীর মনোরঞ্জনের আয়োজন। প্রথমবার শ্বশুরালয়ে জামাতার আপ্যায়ন ত্রুটিমুক্ত রাখতে শ্রেষ্ঠী কার্পণ্য করেননি।
নৈশাহারের পর বধূ সন্দর্শনে অন্তঃপুরে প্রিয়দর্শীর সমভিব্যাহারে অগ্রবর্তী হন তাঁর একমাত্র শ্যালিকা রত্নমালা। সে আর বালিকা নয়। যৌবনের কুসুমে সে মঞ্জরিত হয়ে উঠছে। আগামী মার্গশীর্ষেই মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার পুত্র প্রসেনের সাথে তার বিবাহ স্হির হয়েছে। প্রসেন প্রিয়দর্শীর একান্ত বিশ্বাসভাজন। প্রিয়দর্শীর ইচ্ছা তাকে মালবরাজ্যের উপরাজ্যপাল পদে অভিষিক্ত করা। শ্যালিকার নবীন গ্রীবায় একটি বহুমূল্য রত্নহার পারিতোষিক প্রদান করে রাজকন্যা দেবীকার কক্ষে প্রবেশ করেন প্রিয়দর্শী।
********
শ্রেষ্ঠীকন্যা দেবীকার এই প্রথম পতিসন্দর্শন। বিবাহের সময় প্রিয়দর্শী প্রেরিত স্বর্ণখচিত ভল্লের সাথে পরিণয় সম্পন্ন হয়েছে। সমগ্র উত্তরাপথস্বামী আজ তার প্রিয়তম পতি, এটি তার সুকুমারী জীবনের পরমপ্রাপ্তি।প্রিয়দর্শী অবগুন্ঠনবতীর করস্পর্শ করে নিকটে আমন্ত্রণ করেন। পদ্মরাগমণি খচিত অপূর্ব ললন্তিকা হার উপহার প্রদানপূর্বক পত্নীর মুখদর্শন করেন তিনি।
শ্রেষ্ঠীকন্যার কাছে মূল্যবান রত্নরাজি অবিদিত নয়, কিন্তু স্বয়ং প্রিয়দর্শীর উপহারে তার মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে।
********
প্রিয়দর্শী মধ্যমাকৃতির হলেও যুবাসদৃশ। মুখমন্ডল মুন্ডিত ও সুগৌর। তাঁর দীর্ঘ কেশগুচ্ছ বৃষস্কন্ধের উপর পারিপাট্যে বিন্যস্ত। চক্ষুদ্বয় বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু উদাস। তথাগতের কৃপাধন্য হবার অনতিকাল পর থেকেই তাঁর এই উদাসভাব। কোথাও যেন শাক্যপুত্র বুদ্ধের নির্লিপ্তি তাঁকে আচ্ছন্ন করছে ক্রমশঃ।
দেবীকা শয্যার পার্শ্ব থেকে গজদন্তের একটি সুদৃশ্য আধার প্রিয়দর্শীকে নিবেদন করেন। প্রিয়দর্শী বিস্মিত হন,অযাচিত উপহারে। আধারটি উন্মুক্ত করে তিনি পুলকিত হন। এ সম্পদের জন্য তিনি এতদিন উতলা হয়েছিলেন। সকলোত্তরপথনাথ হয়েও এ বস্তু তাঁর থেকে অধরাই ছিল এতদিন। ধন্য ভট্টারিকা দেবীকা ! ভগবান বুদ্ধের পূতঅস্হি এই শরণাগত ভক্তকে প্রদান করার জন্য। সহস্র মাণিক্য এই সম্পদের কাছে ম্লান হয়ে যায় নিমেষে। বিগলিত চিত্তে দেবীকার কোমল দেহবল্লরীতে প্রিয়দর্শী নিমজ্জিত হন।
********
বিদায়কালে বেসনগরী সকরুণ দৃষ্ট হয়। গত দুইদিনের উৎসবসমাপনে সকলে ম্রিয়মাণ। দেবীকার হস্ত আপন মুষ্ঠিতে গ্রহণ করে প্রিয়দর্শী প্রাসাদের অলিন্দে এসে সূর্যোদয়ের নবোন্মেষিত রক্তিম আলোকবিন্দুতে স্নাত হন । বিগলিত কন্ঠে প্রিয়দর্শী বলেন আজকের পর থেকে বেসনগরী ‘বিদিশা’ নামে পরিচিত হোক। তথাগতের মঙ্গলময় দিশা সমগ্র মধ্যাঞ্চলকে আলোকিত করুক। এই স্হলে শৈলচূড়ায় একটি স্তুপ রচনা করার জন্য তিনি উন্মুখ। ভগবান বুদ্ধের দেহাবশেষ সসম্মানে রক্ষিত থাকবে এই মহাবিহার স্তুপে। বহুদেশবিদেশ থেকে অগণিত শ্রমণের পদরেণুতে এই মহাস্হান হয়ে উঠবে সারনাথেরতূল্য বৌদ্ধমহাজনপদ !
দেবীকা সাশ্রুনেত্রে পতিকে আলিঙ্গন করেন। প্রিয়দর্শী সম্মত হন মগধের প্রাসাদে দেবীকাকে সমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য।
*******
সপ্তাশ্ববাহনরথে অরুণরাগে উজ্জ্বল প্রিয়দর্শী অগ্রসর হন উজ্জয়িনীর পথে। বিদিশার নবজন্ম প্রদান করে প্রিয়দর্শী এগিয়ে চলেন মহাকালের স্রোতে। রাজধ্বজা পরিবর্তিত হয় শাক্যপুত্রের ধর্মচক্রে। আজও সে ত্যাগ,শরণ ও শান্তির জাগরণ ঘটিয়ে চলেছে নিরন্তর।
**********