রবিঠাকুরের সাথে পরিচয় সেই কোন ছোটবেলায়।তখনও সহজ পাঠের গণ্ডি পেরোই নি। বুঝতাম কিছু বলে মনে হয় না। শুধু এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মন ভরে থাকত। কেবলই মনে হোত আরো পড়ি। আবার পড়ি। মা বলতেন ” মন দিয়ে পড়। তবে বড় হলে রবিঠাকুরের অনেক কবিতা পড়তে পারবে।” ” রবি ঠাকুর কে মা? কোন ঠাকুর?” মা হাসতেন। ” ঠাকুর বৈকি। মস্ত বড় ঠাকুর।” ” তার পুজো হয়?” ” হয় তো” , মা বুঝিয়ে দিতেন, ” ওই যে পঁচিশে বৈশাখ। সেদিন তার পুজো।” ” আর বিসর্জন” মার চোখ জলে ভরে আসতো। রুদ্ধ স্বরে বলতেন, ” বাইশে শ্রাবণ” মার মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যথায় ভরে উঠত মন। চুপি চুপি প্রশ্ন করতাম, “রবিঠাকুর এর পুজোয় কি লাগে মা ?'” মা বলতেন ” সব পুজোর মতই মন্ত্র লাগে। এইতো তার মন্ত্র। নাও।” সেদিন বুঝিনি। কী সেই অমূল্য জিনিস যা মা হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ” গীতাঞ্জলি”। অবাক চোখে দেখেছিলাম ! এই মন্ত্র! এত! ” এগুলো কে লিখেছেন মা?” মা বলতেন ” সব তিনি লিখেছেন। “ সব তিনি লিখেছেন! বিস্ময় যেন বাঁধ মানতো না! মা গুনগুন করে গেয়ে উঠতেন,” আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে” স্তব্ধ হয়ে বসে শুনতাম। ভাব , ভাষা বোঝার শক্তি তখন ও জন্মায়নি। শুধু সুরের আকুতি মন প্রাণ কে আকুল করে তুলত। এমন গান সব রবিঠাকুর লিখেছেন? আমাদের রবি ঠাকুর! ওই যে মার টেবিলে যার ছবি! সেই রবি ঠাকুর! তখন থেকেই কেমন যেন আপন হয়ে গেলেন তিনি। আনন্দে রবিঠাকুর, দুঃখে রবিঠাকুর , আলোয় রবিঠাকুর, অন্ধকারে রবিঠাকুর। পঁচিশে বৈশাখ এলে মার মুখে যেন আলো ঝলসাতো। সকাল থেকেই শুরু হত প্রস্তুতি। আমাদের দুই ভাই বোনকে সুন্দর করে সাজিয়ে, নিজে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়তেন। সারাদিন শুধু তার গান, তার কবিতায় ডুবে থাকা। মা যেন আর তখন মা নন। যেন স্বপ্ন লোকে বিভোর হয়ে থাকা এক আনন্দ প্রতিমা। আবার সেই মাকেই বড় অচেনা মনে হত বাইশে শ্রাবণ এলে। সকাল থেকেই অবিরাম ঝরছে শ্রাবণের ধারা। টেবিলে গম্ভীর মুখে রবিঠাকুর। গলায় গোড়ের মালা। ধুপ জ্বলছে। মা চোখ বুজে তানপুরা কোলের কাছে টেনে নিয়ে গাইছেন, “শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে আমার এই সুরটি তোমার মুখের পরে, বুকের পরে। “ মার দুই নিমীলিত চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ত অশ্রুধারা। শিশু মন ব্যাথায় অধীর হয়ে উঠত। কিছু না বুঝেও এক বোবা কান্না চেপে ধরত মনকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মার কোলে মুখ লুকোতাম। “রবি ঠাকুর কেন চলে গেলেন মা?” মা সম্বিত ফিরে পেতেন বোধ হয়। আদর করে গায়ে হাত বুলিয়ে বলতেন ” তিনি কোথাও যান নি। তিনি আত্মার শান্তি। তিনি চিত্তের আরাম। তিনি অতীত, তিনিই বর্তমান। তিনি অমর, তিনি অবিনশ্বর। “ আজ বাইশে শ্রাবণের পূণ্য তিথিতে তার চরণে শতকোটি প্রণাম।