কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পঞ্চদশতম রাত্রি। আগামী কাল যুদ্ধের ষোড়শ দিন। রাজা দূর্যোধন সেনাপতি হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন অঙ্গরাজ কর্ণকে।মহামতি ভীষ্মের পতন হয়েছে যুদ্ধের দশম দিনে। একাদশ দিনে সেনাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন কৌরব, পাণ্ডব উভয়ের অস্ত্রগুরু মহাবীর দ্রোণাচার্য। আজ পঞ্চদশ দিবসে ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে তার মৃত্যুর পর পাণ্ডব শিবিরের উল্লাস বন্ধনহীন। জয়ের একান্ত কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে পাণ্ডব পক্ষ। একমাত্র বাধা এবার কর্ণ। আগামী কাল প্রত্যুষে তিনিই সেনাপতি হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। এই প্রথম কর্ণ অর্জুন মুখোমুখি সমরে অবতীর্ণ হবেন। উৎসাহে , উদ্দীপনায় বিনিদ্র প্রায় পান্ডব শিবির। দুশ্চিন্তায় প্রহর অতিক্রান্ত হচ্ছে কৌরব শিবিরে। কর্ণ বীর। সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু পাণ্ডব পক্ষে রয়েছে পাণ্ডব সখা কৃষ্ণ। কোন অভিসন্ধি খেলা করছে তার ওই আপাত নিরীহ সারথী রূপের আড়ালে সেই আশঙ্কায় শঙ্কাকুল রাজা দূর্যোধন। প্রহর অতিক্রান্ত হয়। সর্ব তাপ হারী নিদ্রা একে একে মায়া অঞ্জন বুলিয়ে দেন সবার চোখে।সুষুপ্তির কোলে ঢলে পড়ে গোটা কুরুক্ষেত্র। শুধু বিদুরের প্রাসাদে খোলা গবাক্ষে দাঁড়িয়ে এক নারী। নিদ্রা তার নয়ন স্পর্শও করতে পারেনি। এক অপরিসীম বেদনার্ত হৃদয়ে ক্লান্ত, অবসন্ন দেহে শুধু চেয়ে আছেন শূন্যে। শ্রবণ উন্মুখ। প্রতি মুহূর্তে কালের পদধ্বনি যেন কোন অশুভ সংকেতের বার্তা দিচ্ছে।অশুভই তো। কাল প্রত্যুষে দুই সহোদর মুখোমুখি হবে রণে। একজন জানে অন্যজন তার ভাই আর অপরজন জানে সম্মুখের যুদ্ধরত ব্যাক্তিটি সূতপুত্র। তার পরম শত্রু। ওহ! দুহাতে চোখ ঢেকে ফেলেন কুন্তী। “ আর্যা” কার ডাকে চমক ভাঙ্গে। “ কে?কি সংবাদ ভদ্রা?” “ প্রাসাদ দ্বারে এক সাক্ষাৎ প্রার্থিনী উপস্থিত হয়েছেন” সাক্ষাৎ প্রার্থীনি ! অর্থাৎ নারী ! বিস্মিত হলেন কুন্তী।“ এখন? কে ?” “ পরিচয় দিতে অস্বীকার করেছেন। শুধু আপনার সাক্ষাতেই নিজেকে প্রকাশ করতে চান।” অবাক হলেন কুন্তী। এত রাতে কে সাক্ষাৎ প্রার্থীনী?কোন সে গুঢ় কারণ ? তবে কি বাসুদেব কোন সংবাদ পাঠিয়েছেন? কাল ভোরে মহারণ। তারই কি কোন আগাম সাবধানতা?কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিলেন কুন্তী। বিদুরকে কি এই সংবাদ জ্ঞাত করবেন ? না। থাক। বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি। এই অবস্থায় আর তাকে জাগ্রত করার প্রয়োজন নেই। দেখাই যাক। ভদ্রা কে আদেশ করলেন, “ অতিথিকে উপবেশন করাও। আমি শীঘ্রই আসছি।” বিদুরের অতিথিগৃহ। ঈষৎ আয়তাকার। সুসজ্জিত কিন্তু বাহুল্যের লেশ মাত্র নেই। দেওয়ালে এবং মেঝেতে পংখের কারুকার্য। কয়েকটি চর্ম নির্মিত আসন ইতস্তত কিন্তু বিন্যস্ত ভাবে রক্ষিত। কুন্তী কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই উঠে দাঁড়ালো সাক্ষাৎ প্রার্থীনি। “ কে আপনি ? এত রাতে কিই বা প্রয়োজন?” “ প্রয়োজন আছে আর্যা। ” কণ্ঠটি চেনা চেনা! অশ্রুসিক্ত। কে এই রমণী? তবু নিজেকে সংযত রাখেন কুন্তী। “ বিস্তারে বলুন। এত রাত্রে কি সে প্রয়োজন যার জন্য আমার শরণাপন্ন হয়েছেন আপনি। রাজ্যহীন, গৃহহীন পঞ্চ পুত্রের মাতা আমি। “ “ পঞ্চপুত্র? না ষষ্ঠ? মাতা কুন্তীর কি গণনায় ভ্রম হচ্ছে ?” তীব্র শ্লেষ ধ্বনিত হয় রমণীর কণ্ঠস্বরে। বিস্ময়ে বাক রোধ হয়ে যায়। কে এই নারী ? তার জীবনের অতি গোপন এই অধ্যায়ের কথা ইনি জ্ঞত হলেন কি করে? “ কে আপনি? অবগুণ্ঠন সরান।” সরে যায় আবরণ। খসে যায় আড়াল। চমকিত হন কুন্তী। “ রাধা ! তুমি ?” “ হ্যাঁ। আমি রাধা। অধিরথ ভার্যা। মহাবীর কর্নের জননী। অঙ্গরাজ্যের রাজমাতা আমি।” “ রাধা। এত রাতে তুমি? সব কুশল তো? “ কুশল? কার কুশল সংবাদ জানতে চান পাণ্ডব জননী? যাকে আজ সন্ধ্যায় সর্বস্বান্ত, রিক্ত করে দিয়ে এসেছেন — তার?” “ রাধা তুমি কি বলছ আমার বোধগম্য হচ্ছে না। ” “বোধের অগম্য হয় এমন কিছু তো আমি বলিনি দেবী? ” “ রাধা। সংযত কর নিজেকে। বিস্মৃত হয়ো না কার সম্মুখে দন্ডায়মান তুমি?” “ নিশ্চয়ই। ” আবার বিদ্রুপ রাধার কণ্ঠস্বরে। কিন্তু কি চায় ও? অস্থির বোধ করেন কুন্তী। “ আমি কথা বলছি মহাবীর পঞ্চপাণ্ডব এর মাতা কুন্তীর সাথে। কিন্তু পঞ্চ পাণ্ডবদের মাতা হয়েও কি হৃদয় অপূর্ন দেবী? পঞ্চ মুখে মা ডাক কি যথেষ্ট নয়?” “ এ প্রশ্নের অর্থ কি ?” “ অর্থ ? অর্থ তো আপনি বলবেন ? আপনার এই অদ্ভুত আচরণের অর্থ জানতেই তো আমি এসেছি। ” “ আমার আচরণের ! আমি বিস্মিত রাধা। তাছাড়া আজ আমি বড় ক্লান্ত। কি বলতে চাও স্পষ্ট বল। ” “ যথা আজ্ঞা দেবী।আমি বলতে চাই যাকে জন্ম মাত্রই ভাসিয়ে দিয়েছিলেন অনিশ্চয়তার ভবিষ্যতে, যাকে ভুলেছিলেন এই এতদিন , সুতপূত্র পরিচয়ের অবজ্ঞা আর অসম্মানের অন্ধকারে যার জীবনের এতগুলো বৎসর অতিক্রান্ত — আজ হঠাৎ কেন তাকে দিতে গেলেন আপন মাতৃ পরিচয়? কি সে উদ্দেশ্য আর্যা ? কোন সে কারণ?” “ ওহ ! রাধা। সে আমার প্রথম সন্তান। আমার কুমারী জীবনের —” “ কলঙ্ক।” “ না না। কলঙ্ক নয় ” “ অবশ্যই কলঙ্ক। তাই তো গোপন করেছিলেন নিজের মাতৃত্ব। জন্ম মাত্রেই তাকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন অশ্ব নদীতে।” “ রাধা। আমি ষোড়শী ,অবিবাহিতা। কুমারী অবস্থায় গর্ভ ধারনের ভয়ে, লজ্জায় সংকুচিতা। ” “ অর্থাৎ মাতৃ স্নেহ তখন লুক্কায়িত লোক লজ্জার অন্তরালে।” “ এছাড়া কিই বা করনীয় ছিল ?” “ না। ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন করি আজ হঠাৎ সেই মাতৃ স্নেহ জাগ্রত হল কেন? এতদিন যাকে ভুলে ছিলেন আজ সেই পুত্রকে দেখা দেবার ব্যাকুলতা জাগল কেন দেবী?” “ জাগবে না ? আসন্ন সমরে আমার দুই পুত্র মুখোমুখি হতে চলেছে। সহোদর তারা। একে অপরের পরিচয় অজানা। এই সময় মাতৃ স্নেহ কি বশে থাকে? ” “ মাতৃ স্নেহ ! হা হা হা। কোন্ মাতৃ স্নেহের কথা বলছেন আর্যা? সেই মাতৃ স্নেহ যা একটি সদ্যোজাত শিশুকে পেটিকায় ভাসিয়ে দেয় অনিশ্চয়তার দিকে ? সেই মাতৃ স্নেহ যা সূত পুত্রের পরিচয়ে অপমানিত লজ্জিত পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়েও নীরব থাকে? সেই মাতৃ স্নেহ যা আসন্ন যুদ্ধের কথা জেনেও পুত্রের হৃদয় চুর্ন করে দিতে এগিয়ে আসে? যাতে নিজের পঞ্চ পুত্র সুরক্ষিত থাকে? কোন মাতৃ স্নেহ দেবী কুন্তী?” “ কি বলছ তুমি রাধা? আমি –” “ হ্যাঁ আপনি। আজ আপনি স্বেচ্ছায়, উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই সম্মুখীন হয়েছিলেন রাধেয় র। চেয়েছিলেন যুদ্ধের আগেই তার মনোবল চূর্ন করে দিতে। আপনি জানতেন সে যদি কোন ক্রমে জ্ঞাত হয় পঞ্চপাণ্ডব তার সহোদর ভাই তবে সে সম্পূর্ন উদ্যমে আর যুদ্ধ করতে পারবে না। জয় হবে পাণ্ডবদের। তাই না? এই আপনার মাতৃ স্নেহ? এরই বড়াই করছিলেন এতক্ষণ ধরে?” “ রাধা। এ তোমার ভ্রান্ত ধারণা। আমার সন্তানকে সসম্মানে তার ভ্রাতাদের নিকট ফিরিয়ে দেবার জন্যই আমি –” “ আর সেই সময়টা বেছেছেন ঠিক তার যুদ্ধে নামার পূর্ব দিন। চমৎকার মহারানী। চমৎকার। এতদিন কি করছিলেন? এই পঞ্চ দশ দিন পর্যন্ত? এতদিন বিস্মৃত হয়ে ছিলেন কেমন করে? ” “ বিস্মৃত ! ঈশ্বর সাক্ষী। কি যন্ত্রণায় দিনপাত করেছি আমি।আমি তার গর্ভধারিনি. আমি মা রাধা।” “ গর্ভধারিনি। মা নন। শৈশব থেকে কৈশোর তাকে লালন করেছি আমি। আপনি নন। যৌবনের প্রারম্ভে একের পর এক অপমানের আঘাতে যখন বিদীর্ণ হয়েছে তার হৃদয় — তখন স্নেহ , মমতা বাৎসল্য দিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি আমি । আপনি নন। আর আজ সন্ধ্যায় ভগ্ন হৃদয়, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যখন সে প্রাসাদে ফিরেছে তার সেই শুষ্ক মুখ, আরক্ত চক্ষু দেখে যন্ত্রণায় নিজের মরণ কামণা করেছে যে — সে আমি। আপনি নন। ” “ রাধা – আমিও কি সারা জীবন একই দুঃখ পাইনি?” “ না। নিজের পঞ্চ পুত্রকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছেন আপনি। আর সেই সঙ্গে জ্যেষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুর আশ্বাস। ” “ না রাধা। এ মিথ্যা। ” “ মিথ্যা? কর্ণ আপনাকে প্রতিশ্রুতি দেয় নি যে যেভাবেই হোক আপনার পঞ্চ পুত্র জীবিত থাকবে ?” “ হ্যাঁ। কিন্তু তার মধ্যে সেও আছে রাধা।” “ না। সে নেই। কারণ সে রাধেয়। পাণ্ডব নয়। সে অধীরথ পুত্র। কৌন্তেয় নয়।“ “ রাধা। ” “ দেবী। প্রগলভতা মার্জনা করবেন। আজ আমার সব সংযম, সব আগল চুর্ণ হয়ে গেছে। সারা জীবন যাকে অপমানিতের অন্ধকারে ঠেলে রাখলেন আজ কেন এলেন তাকে নিজের পরিচয় জানাতে? জন্ম থেকে সে আমাকে তার জননী বলে জানে। এই সন্তান হীনা রমণীর থেকে কেন কেড়ে নিলেন এইটুকু গৌরব? কেন যুদ্ধের পূর্বেই হতোদ্যম করলেন আপন গর্ভ জাত পুত্রকে? কেন দেবী ? কেন ?” “ রাধা। আমি আশীর্বাদ করছি –” “ না। ক্ষমা করবেন দেবী। আপনার আশীর্বাদের প্রয়োজন নেই আমার পুত্রের। কাল যুদ্ধের পরিণতি কি হবে আমি জানি না কিন্তু আজ এক ভবিষ্যত বাণী করে যাই আমি। ভাবিকাল কখনো ক্ষমা করবে না আপনাকে। আর যে পুত্রের জন্য আপনার মাতৃ হৃদয় এতই আকুল— আগামী প্রজন্ম সেই পুত্রকে কখনোই কৌন্তেয় বলে অভিহিত করবে না। চিরকালই তার পরিচয় হয়ে থাকবে সে রাধেয়। অধিরথ পুত্র। ” “ রাধা ” কান্নায় কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে কুন্তীর। “ এবার বিদায় নেব দেবী। রাত্রি শেষ হতেও আর বেশি বাকি নেই। আর রাত প্রভাতেই যুদ্ধ। তার আগেই পুত্রের কাছে পৌঁছতে হবে আমাকে। দু চোখ ভরে দেখে নিতে হবে সেই মুখ। যা আমার সারা জীবনের একমাত্র সম্পদ।বিদায় দেবী। সুখে থাকুক আপনার পঞ্চ পুত্র। জগতে অক্ষয় কীর্তি লাভ করুক তারা। চিরজীবী হোক আপনার মাতৃত্ব। আমি রইলাম বঞ্চিত হতাশের দলে। আর রইল আমার পুত্র।বিদায় দেবী। বিদায়। ”
অসাধারণ !!! অসাধারণ !!! …. ক্ষুরধার লেখনী !! …. আরো চলুক, অপেক্ষায় রইলাম …..